চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ: বিশেষজ্ঞ নই, গর্বিত

মহাকাশে বাংলাদেশ নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। লাল-সবুজের গৌরব স্মারক ভাসবে আকাশে- এটা আমাদের জন্যে দারুণ খবর।

বাংলাদেশের জন্য এ ঐতিহাসিক মুহূর্তটি এল শনিবার ভোররাতে; ২টা ১৪ মিনিটে। পুচ্ছে আগুনের হলকা লাগিয়ে রকেটযান ফ্যালকন ছুটল আকাশপানে। নির্ধারিত সময়ে কক্ষপথে পৌঁছাল, এরপর যথানিয়মে রকেট ফিরল পৃথিবীতে। এরই মধ্যে সমূহ কাজ সারল সেটা। মহাকাশে লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব রেখে গৌরবের এ স্যাটেলাইট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা করল। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে সফলভাবে উৎক্ষেপণ হওয়া এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশ নাম লেখাল অভিজাত ক্লাবে। বিশ্বের মাত্র ৫৭টি দেশের একটা দেশ হলো বাংলাদেশ।

এই স্যাটেলাইট কেবল বাংলাদেশের আভিজাত্যের স্মারকই নয়, এর সঙ্গে আছে দেশের বাণিজ্যিক যোগও। দেশের টাকা দেশেই রাখার ব্যবস্থা, একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সুযোগও। তাই এটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা উপায় হিসেবেও ভাবা যেতে পারে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের আগে-পরে এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলছেন, এই যোগাযোগ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মূলত তিন ধরনের সেবা পাওয়া সম্ভব। এগুলো হলো- সম্প্রচার, টেলিযোগাযোগ ও ডেটা কমিউনিকেশন।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে, যার ২০টি বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে এবং বাকিগুলো ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে মার্কিন মহাকাশযান ও রকেট প্রস্ততকারক এবং উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০০২ সালে স্পেসএক্স যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির মহাকাশযান সিরিজের নাম ড্রাগন এবং রকেট সিরিজের নাম ফ্যালকন। ফ্যালকন সিরিজের সর্বশেষ প্রযুক্তির ভার্সন-৫ রকেটে করে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। প্রকাশিত তথ্যে আরও জানা যায়, ফ্যালকন-৯ রকেটের প্রথম সংস্করণ মহাকাশযাত্রা শুরু করে ২০১০ সালে। মহাকাশে বাণিজ্যিক কার্গো সেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার পরিকল্পনা অনুসারে এই রকেট তৈরি করে স্পেসএক্স। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্করণের ফ্যালকন-৯ রকেট মোট ৫৮ বার মহাকাশে গেছে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। তারা প্রথম তিন বছর বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে এই স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ করবে। এরপর বাংলাদেশ এককভাবে এটা নিয়ন্ত্রণ নেবে। মহাকাশে কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে স্যাটেলাইটটি নিয়ন্ত্রণের জন্য দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন (ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা) তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে জয়দেবপুরের গ্রাউন্ড স্টেশনটিই স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে; বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে রাঙামাটির বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশন। জয়দেবপুরের গ্রাউন্ড স্টেশনে স্যাটেলাইটের সঙ্কেত আদান-প্রদানে ১০ টন ওজনের দুটি অ্যান্টেনা স্থাপন করা হয়েছে। গ্রাউন্ড স্টেশনে কাজ করার জন্য ১৮ জন বাংলাদেশি তরুণকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে থ্যালেস। এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের সম্পর্কে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, থ্যালেসের লোকজন বলেছে আমাদের ১৮ জন ছেলেমেয়ে এখনই এই স্যাটেলাইট পরিচালনার দক্ষতা অর্জন করেছে।’

ফলে এটা যে দারুণ এক সংবাদ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণের আগে-পরে এনিয়ে দেশে নানা রকমের বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আংশিক কথোপকথনের এক ভিডিওচিত্র প্রকাশ করে কিছু লোক স্যাটেলাইটের মালিকানা সরকারঘনিষ্ঠ দেশের একটি শিল্পগ্রুপের বলেও অপপ্রচার চালিয়েছে, এখনও সেটা চলছে। তবে এই প্রচারণা যে মিথ্যা তার প্রমাণ এই স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের জন্যে বিটিআরসির অধীন বিসিএসসিএল নামের পৃথক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব। পুঁজিবাজারে এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছাড়ার পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হওয়া ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকার মধ্যে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার এবং বাকি ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এই ঋণ দিয়েছে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি। এসব তথ্য প্রমাণ করে স্বতন্ত্র কোন শিল্পগ্রুপের একক মালিকানায় নেই এই স্যাটেলাইট।

এই অপপ্রচারেও গা ভাসিয়েছে বিএনপি। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর শনিবার রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মালিকানা দুই ব্যক্তির কাছে চলে গেছে। তাদের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনতে হবে। তিনি স্যাটেলাইট সম্পর্কে আলোচনার এক পর্যায়ে বলছেন, এটা আগে ঘুরক, আবর্তন করুক পৃথিবী, পরিক্রমা করুক, তখন দেখা যাবে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ শেষে বলা যায় নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় অর্জনে আমরা গর্বিত। বাংলাদেশকে ‘তলাবিহিন ঝুড়ি’ আখ্যা দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের দেশ থেকে উৎক্ষেপিত এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রমাণ দিয়েছে তার সামর্থ্যের। বিশ্বে স্যাটেলাইটের মালিক দেশের সংখ্যা ৫৭টি হলেও মাত্র ১০/১২টি দেশের রয়েছে উৎক্ষেপণ সেন্টার। যুক্তরাষ্ট্রের স্পেসএক্সকে বেছে নেওয়ার পেছনে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের তাদের পেশাগত দক্ষতা ও সামর্থ্যের দিকটি মুখ্য হলেও আমাদের কাছে হেনরি কিসিঞ্জারের সেই অপমানসূচক উক্তির এক জবাব হিসেবেই দেখছি, যদিও রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এধরনের বিষয়গুলো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হয় না।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পুরোপুরি অপারেশনে যাওয়ার আগে-পরে এর বাণিজ্যিক দিকগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ভাববেন এবং সে হিসেবে তারা সিদ্ধান্তও নেবেন, তবে একজন নাগরিক হিসেবে এখনই আমরা গর্বিত। আমাদের এই গর্ব আপাত আভিজাত্যের দিক থেকে প্রকাশিত হলেও যখন অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা রিটার্ন পেতে শুরু করব তখন রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে লাভবান হবে আমরা নাগরিকরাও।

রাষ্ট্রীয় অর্জনে নাগরিকদের গর্বিত হওয়ার কথা, হয়েছে অধিকাংশ নাগরিকই। তবে এর মধ্যেও আছে অখুশি কিছু লোক। যারা বাংলাদেশের এমন অর্জনে খুশি ও গর্বিত হয়নি/হচ্ছে না তারা রাষ্ট্র সমীপে তাদের পরিচয়কে প্রশ্নের মুখেই ফেলছে কেবল, আর কিছু নয়!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।