প্রতিবছরের মতো এসেছে ঈদ-উল-ফিতর, মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আনন্দ-উৎসব। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে যেসব প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয়, সেগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর হচ্ছে সময়ের মাপকাঠিতে কনিষ্ঠতম। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর, সংযম, আত্মত্যাগ কঠোর অনুশীলন, ব্যক্তিগত আত্মশুদ্ধি এবং গরিব-দুঃখী-অনাহারীদের কষ্ট অনুভবের প্রেরণার মাধ্যমে এলো খুশির এই উপলক্ষ।
ঘরে ঘরে, জনে জনে, দেশে বিদেশে আনন্দ ও খুশির বার্তা বয়ে এনেছে এই ঈদের চাঁদটি। ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলকে এককাতারে দাঁড়ানোর চেতনায় উজ্জীবিত করে, কল্যাণের পথে ত্যাগ ও তিতিক্ষার মূলমন্ত্রে দীক্ষিত করে।
ধনী-দরিদ্র সবাই এই দিনে আনন্দে মেতে ওঠে। নতুন চাঁদ দেখা মাত্র রেডিও-টেলিভিশনে ঘোষিত হয় খুশির বার্তা ‘ঈদ মোবারক’। সেই সঙ্গে শোনা যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গানটি, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।’
অষ্টম শতকের দিকেই বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন ঘটে। ফলে, এই সুফি, দরবেশ এবং তুর্ক-আরব বণিকদের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশে রোজা, নামাজ ও ঈদের সূত্রপাত হয়; তবে সে যুগে তা ছিল বহিরাগত ধর্মসাধক, ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীদের ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব। বঙ্গদেশীয় ধর্ম-সামাজিক পার্বণ নয়।
বঙ্গদেশে রোজা পালনের প্রথম ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় ‘তাসকিরাতুল সোলহা’ গ্রন্থে। আরবের জনৈক শেখউল খিদা হিজরি ৩৪১ সনে (৯৪১ খ্রিস্টাব্দ) ঢাকায় আসেন। বঙ্গদেশে ইসলাম আগমন পূর্বকালে শাহ সুলতান রুমি নেত্রকোনা এবং বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুরের রামপালে আস্তানা গেড়ে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
শেখউল খিদা চন্দ বংশীয় রাজা শ্রীচন্দের শাসনকালে (৯০৫-৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় আগমন করেন। তাঁদের প্রভাবে বঙ্গদেশে রোজা, নামাজ ও ঈদ প্রচলিত হয় বলা সমীচীন নয়; অবশ্য তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে এসব ইসলাম ধর্মীয় কৃত্য ও উৎসব পালন করতেন। বাংলাদেশে ‘নামাজ’, ‘রোজা’ বা ‘খোদা হাফেজ’ শব্দের ব্যাপক প্রচলনে বোঝা যায় যে, ইরানীরাই বাংলাদেশে ইসলাম-ধর্ম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কারণ শব্দগুলো আরবীয় ভাষার নয়, বরং ফার্সি ভাষার।
১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহসুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম একটি ঈদগা নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ্য ছিল ২৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১৩৭ ফুট। নির্মাণকালে ঈগদাটি ভূমি থেকে বার ফুট উঁচু ছিল। ঈদগাহের পশ্চিম দিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সেখানে মেহরাব ও মিনার নির্মাণ করা হয়। মুঘল আমলে দরবার, আদালত, বাজার ও সৈন্য ছাউনির কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল এই ঈদগা। প্রথমদিকে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মুঘল কর্মকর্তা এবং তাদের স্বজন-বান্ধবরাই এখানে নামাজ পড়তে পারতেন। পরে ঈদগাটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
বাঙালির সংস্কৃতি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ মানব-সংস্কৃতি, উদার সামাজিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতিতে আছে সামাজিক সম্মিলন ও সমন্বিত ভাবধারা। বাঙালি সংস্কৃতির সামাজিক উপাদানগুলো সংস্কৃতির শক্তিকে বলিষ্ঠতা দেয়। এমনকি ধর্মীয় উৎসব-পার্বণগুলোও পরিণত হয় বাঙালি সংস্কৃতির উপাদানে। উজ্জীবিত করে মানুষকে। সেই সঙ্গে সামাজিক আনন্দের উজ্জীবনে এবং সামাজিক সম্প্রীতি ও ঐক্য গঠনেরও প্রেরণা জোগায়। ঈদও আজ বাঙালির কাছে বাঙালি সংস্কৃতির মাধ্যমেই উদযাপিত হয়। এমনকি, সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপারেও বাঙালির মধ্যে আনন্দ ও খুশির উৎসব হিসেবে ঈদ উদযাপিত হয়। আর তাই ঈদ নামাজে হাজার হাজার বাঙালির ঢল নামে, বিশেষ করে লন্ডনে।
লন্ডন পশ্চিমা জগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। এই শহরকে ইউরোপের বাণিজ্যিক রাজধানীও বলা হয়। লন্ডন শহরের জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ৮৫ লাখ, এর মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১১ লাখ, যা গোটা জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ। গোটা লন্ডন শহরে সর্বমোট ৩৩টি স্থানীয় সরকার রয়েছে। এ স্থানীয় সরকারগুলোকে সংক্ষেপে ‘বারা’ (কাউন্সিল) বলা হয়। ইস্ট লন্ডন মসজিদের অবস্থান হচ্ছে টাওয়ার হ্যামলেটস ‘বারা’তে। ব্রিটিশ সংসদ ভবন, হোয়াইট হল এবং প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ডাউনিং স্ট্রিট থেকে পাতাল-রেলে মাত্র ১৫ মিনিটের দূরত্বে অবস্থান করে ‘লন্ডন বারা অব টাওয়ার হ্যামলেটস’। এখানে মাত্র তিন বর্গমাইলের মধ্যে এক লাখেরও অধিক মুসলমান বসবাস করেন। আবার এদের ৯০ শতাংশের বেশি হচ্ছেন বাংলাদেশী মুসলমান।
শুধু টাওয়ার হ্যামলেটসে মসজিদের সংখ্যা হচ্ছে ৪০-এরও বেশি। টাওয়ার হ্যামলেটসের বাইরে বেশি মুসলমান বাস করেন ‘নিউহাম‘ ও ‘রেডব্রিজ’ বারাতে। যুক্তরাজ্যে মসজিদের সংখ্যা ১৬ শ’রও অধিক। লন্ডনে মসজিদের সংখ্যা হচ্ছে প্রায় চার শ’র মতো। নামকরা মসজিদগুলোর মধ্যে আছে আরবদের তৈরি ‘রিজেন্ট পার্ক ইসলামি ক্যাচারেল সেন্টার’ (মসজিদ) এবং ‘হ্যকনি’ বারাতে তুর্কিদের তৈরি ‘সোলায়মানিয়া মসজিদ’।
এছাড়া আছে টাওয়ার হ্যামলেটস-এ ইহুদিদের উপাসনালয় (সিনাগগ) খরিদ করা ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও ব্রিকলেইন জামে মসজিদ। এসব মসজিদেই পালিত হয় ঈদের নামাজ, নারী-পুরুষ-শিশু সবাই এক সঙ্গেই নামাজ আদায় করতে পারেন। ১৯৮০-দশকে ‘লন্ডন বারা অফ ক্যামডেন’ ও ‘লন্ডন বারা অফ ইজলিংটন’-এর বাঙালিরা ‘রিজেন্ট পার্ক ইসলামি ক্যাচারেল সেন্টার’ (মসজিদ)-এই ঈদের নামাজ আদায় করতেন। এক সঙ্গে সমস্ত পরিবারের সদস্যরা নামাজ আদায় করে রিজেন্ট পার্কে ঈদ-উপলক্ষে বনভোজন করতেন।বিভিন্ন জাতি এতে অংশগ্রহণ করতেন।
বর্তমানে বাঙালিরা তাদের নিজস্ব মসজিদেই ঈদের নামাজ আদায় করে থাকেন। ‘রেডব্রিজ’-এর বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে ভ্যালেন্টান পার্কে, খোলা আকাশের নীচে, কয়েক হাজার মুসলমানরা একই সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারেন। অবশ্য বর্তমানে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন পার্কে এর আয়োজন হয়ে থাকে। একই সঙ্গে থাকে ঈদ-মেলাও।
পবিত্র ঈদুল ফেতর উপলক্ষে মুসলিম কমিউনিটিকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরন। এক ভিডিও বার্তায় তিনি পবিত্র রমজানে দান খয়রাতের মাধ্যমে দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য মুসলিম কমিউনিটির প্রশংসা করেন। প্রায় ১ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের ভিডিও বার্তায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ঈদের শুভেচ্ছায় সার্বিয় মুসলিমদের গণকবর এবং সিরিয়ায় আইএসের যুদ্ধে গৃহ হারাদের কথা স্মরণ করেন। মুসলিম ও বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের মেয়র জন বিগস ও বাঙালি এমপি রোশনারা আলী পৃথক বার্তায় ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আরেক বাঙালি এমপি টিউলিপ সিদ্দিকও তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ঈদের জামাতে অংশ নিয়েছেন।
সবকিছু ছাপিয়ে ইষ্ট লন্ডন মসজিদের সামনে একটি ব্যানার সবার দৃষ্টি কেড়েছে। ব্রিটেনে বাঙালিদের সর্ব বৃহৎ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র কারি শিল্পের শ্রমিকদের ঈদের ছুটির দাবি সম্বলিত একটি ব্যানার। সর্ব বৃহৎ ধর্মীয় এই উৎসবে এর কর্মচারীরা থাকেন ছুটি বিহীন। যেখানে বাংলাদেশি রেষ্টুরেন্ট মালিকদের প্রায় ৯৯ শতাংশই মুসলিম ধর্মালম্বী।
একসঙ্গে নামাজ আদায় করে পরিবারের সকল সদস্য ( বৃদ্ধ-যুবক-পুরুষ-নারী-শিশু সবাই) এসব ঈদ-মেলাতে অংশগ্রহণ করে সারাদিন আনন্দ-উৎসব পালন করে থাকেন। শাব্দিক অর্থে ‘ঈদুর ফিতর’ হচ্ছে ‘প্রাতরাশ উৎসব’, অর্থাৎ আনন্দ ও খুশির উৎসব। ঈদ প্রতিবছর চন্দ্র বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট রীতিতে এক অনন্য আনন্দ-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে। পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করে বাণিজ্যের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, ফলে এখানে ঈদ উৎসব ভোগের বিষয় হয়ে উঠেছে।
ঈদ-উল-ফিতরের মূল তাৎপর্য বিভেদমুক্ত জীবনের উপলব্ধি। ভুল-ভ্রান্তি, পাপ-পঙ্কিলতা মানুষের জীবনে কমবেশি আসে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়। কিন্তু পরম করুণাময় চান মানুষ পাপ ও বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে সৎপথে ফিরে আসুক। সম্প্রীতির আনন্দধারায় সিক্ত হয়ে উন্নত জীবন লাভ করুক। ঈদ-উল-ফিতর মানুষকে এই শিক্ষা দেয়। দিবসটির উৎসব তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে সমাজের সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার মধ্য-দিয়ে। শ্রেণীবৈষম্য বিসর্জনের মধ্য-দিয়েই এই আনন্দ সার্থক হয়ে ওঠে। এই অর্থে বিলাতে ঈদ উৎসব সার্থকই উৎসব।
প্রতি বছরই ঈদের সময় বিলাতে ও দেশে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় দেখা যায় নানা আয়োজন। প্রবন্ধ, গান, ছড়া-কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান কোনও কিছুই বাদ যায় না। ঈদকে কেন্দ্র করে কবি-সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, অভিনেতাদের ব্যস্ত সময় কাটে।
ঈদ বিভেদ-বৈষম্যহীন, ভ্রাতৃচেতনায় ঋদ্ধ এক নির্মল আনন্দ-উৎসব-বিনোদনের উপলক্ষ। এই উৎসবের দিনে সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে হবে আনন্দ। রমজান চিত্তশুদ্ধির যে শিক্ষা দিয়েছে, সেই শিক্ষার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শান্তি ও শ্রেয়বোধের চেতনায় স্থিত হতে হবে।
ঈদ-উল-ফিতর উদযাপনের মধ্য-দিয়ে বিশ্ব সকল প্রকার হিংসা, হানাহানি মুক্ত হোক। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসের বিভীষিকা দূর হোক। সকল শ্রেণীপেশার মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দরে বন্ধন সুদৃঢ় হোক, আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি দিন- এই প্রত্যাশায় ঈদ মোবারক, সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছ।