স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিময় দিন আজ। ১৯৯০ সালের ওই দিন ওই সময়টি ঢাকায় আমার মতো তরুণ রিপোর্টারদের জন্যেও ছিলো বিশেষ চনমনে স্মৃতির। প্রথা বিরোধী রাজপথের সাংবাদিক বলতে যা বোঝায় আমরা ছিলাম তাই। বিচিন্তা নিষিদ্ধের পর আমাদের ঠিক নির্দিষ্ট কোনো পত্রিকা ছিলো না। এখানে সেখানে লিখি। পুরানা পল্টনে মোজাম্মেল বাবু’র নেতৃত্বাধীন ‘পূর্বাভাস’, জিগাতলার মোড়ের নাঈমুল ইসলাম খান নেতৃত্বাধীন ‘খবরের কাগজ’কে কেন্দ্র করে আমাদের তরুণ সাংবাদিকদের আড্ডা।
দিনের বেশিরভাগ সময় আমাদের দুই অফিসে কাটে। এরপর মিছিলে, মধুর ক্যান্টিনে, টিএসসিতে অথবা আওয়ামী লীগ-বিএনপি-সিপিবি-জাসদ-বাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টির অফিসে, নেতাদের বাসায়, সচিবালয়ে ঘুরে তুমুল সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির আপডেট, আমাদের ছাড়া আর কে জানে? অনেক সিনিয়র সাংবাদিকও তখন পথেঘাটে দেখা হলে থামিয়ে জানতে চাইতেন অনেক আপডেট। রাজপথের খাওয়া-না খাওয়া সব লিকলিকে গড়নের সাংবাদিক! দেশের বাঘা সিনিয়ররা অনেক কিছু জানতে চান আমাদের কাছে! ওই বয়সে এসব ভাবতে বেশ ভালোই লাগতো।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে কারফিউ’র শহর ঢাকা। স্বৈরাচারী সরকারের এক নির্দেশের প্রতিবাদে দেশের সব পত্রিকা ছাপা বন্ধ হয়ে গেছে! নির্দেশটি ছিল পত্রিকায় যা ছাপা হবে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক) আব্দুল হামিদ চৌধুরীকে দেখিয়ে নিতে হবে! এর প্রতিবাদে সব দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। দেশজুড়ে তখন তথ্যবিহীন এক রকম ভূতুড়ে পরিবেশ!
ওই অবস্থায় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আন্দোলনের টেলিগ্রাম পত্রিকা বের করবো। মুশতাক হোসেন, জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু (অকাল প্রয়াত) প্রমুখ নেতা এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। আমাদের রাজপথের সাংবাদিকদের অঘোষিত নেতা বর্তমানে নিউইয়র্ক প্রবাসী আমান-উদ-দৌলা ভাই। সিদ্ধান্ত হয় দুটি করে টেলিগ্রাম পত্রিকা বেরুবে প্রতিদিন। একটা বেরুবে খবরের কাগজ অফিস থেকে আরেকটা পূর্বাভাস অফিস থেকে।
৩ ডিসেম্বর সারাদিন লিখে আমরা পত্রিকা দুটির কাজ শেষ করি। এরশাদের গোয়েন্দারা যাতে টের না পায় সেজন্যে এই কাজটি নিয়ে আমাদের বেশ গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হয়েছে। আমিসহ কয়েকজন দুটি টেলিগ্রাম পত্রিকার জন্যেই লেখা দেই। কিন্তু লেখা, কম্পোজ, পেস্টিং এর পর দেখা দেয় আরেক সমস্যা! পত্রিকা ছাপবো কোথায়? প্রতিষ্ঠিত কোন প্রেস আমাদের পত্রিকা ছাপতে রাজি হলো না। অত:পর আমাদের পেস্টিং করা পত্রিকার সেলুফিন নিয়ে গেলেন ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু। আরামবাগের একটি প্রেসকে রাজি করাতে পারেন টিংকু ভাই। কিন্তু প্রেসের বাইরে আমাদের পাহারায় থাকতে হয়েছে। এভাবেই বেরোয় আন্দোলনের বুলেটিন ‘বিদ্রোহ আজ বিপ্লব চারদিকে’।
৪ ডিসেম্বর প্রেসক্লাবের বিপরীত প্রান্তের রাস্তায় ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা বিক্রি করি সেই আন্দোলনের পত্রিকা। দু’ টাকা দামের পত্রিকা মুহূর্তের মধ্যে সব বিক্রি হয়ে যায়। এরপর আমরা আবার ছুটি পরের দিনের পত্রিকা বের করার জন্যে। সারাদিনের নানা ঘটনা লিখতে বসেছি পূর্বাভাস অফিসে। কিন্তু কী বাদ দিয়ে কী লিখি! ঘটনা প্রবাহ দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। ২৭ নভেম্বর জাসদ নেতা ডা: মিলনকে হত্যার পর চিকিৎসক পেশাজীবীরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। এরপর বিদ্রোহ ঘটে সচিবালয়ে। ৪ ডিসেম্বর যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিস ছেড়ে আন্দোলনে একাত্মতা জানাতে রাজপথে নেমে আসেন তখন এরশাদের সব শেষ!
সিনিয়র সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন মোস্তান ভাই’র সঙ্গে সচিবালয়ে এরশাদের প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরের অফিসে গেলে তিনি আমাদের আধ্যাত্মিক কবিতা শোনান! আমাদের বলেন, তিনি রাজপথের গন্ধ বোঝেন! এ আন্দোলন টিকবে না! আবার আঁধারের শেষে সূর্য হাসবে! এরশাদের আরেক পা চাটা উপ-রাষ্ট্রপতি ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ টেলিভিশনে সংবিধান বোঝাচ্ছিলেন! কিন্তু ওই সময়েই টেলিভিশনে প্রচারিত হয় এরশাদের পদত্যাগের সিদ্ধান্তের ঘোষণা! কবে কোথায় কিভাবে এসব জানার কোন সুযোগ ছিলো না কারো! ওই একটা ঘোষণা স্ফূলিঙ্গের মতো সৃষ্টি করে গণঅভ্যুত্থান! লাখ লাখ মানুষ নেমে পড়ে রাস্তায়।
প্রেসক্লাবের সামনের পথসভায় ড. কামাল হোসেন, ব্যারিষ্টার আমীর-উল-ইসলাম প্রমুখ আন্দোলনের বিজয় ঘোষণা করেন। টেলিগ্রামের লেখার টেবিল ছেড়ে আমরা চলে এসেছি রাজপথে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! মানুষ চিৎকার করে আনন্দে কাঁদছে, নাচছে! প্রেস ক্লাবের সামনে আমরা রাজপথের সাংবাদিকরা আরেক অবস্থার মধ্যে পড়ি! রাজনৈতিক কর্মীরা আমাদের জড়িয়ে ধরছিলেন, কোলাকুলি করে বলছিলেন, ভাই আপনারা অনেক কষ্ট করেছেন। আপনাদের কষ্ট সার্থক হয়েছে। স্বৈরাচার বিদায় হয়েছে।
এরশাদের মাধ্যমে কর্মচ্যুত চাকরিবিহীন বেকার জীবনের হাজার কষ্টের জীবন পেরিয়ে এসে মানুষের এই ভালোবাসা স্বীকৃতিতে সে রাতে আনন্দে কেঁদেছি। ভেবেছি আমাদেরও বুঝি অবসান হলো বেকার জীবনের! সে রাতে বুঝি অনেকে এমন অনেক কিছু ভেবেছে যে যার অবস্থান থেকে! প্রেসক্লাবের সামনের একটা মিছিলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বেইলি রোডে এসে দেখি জনতার বিজয় উল্লাস চলছে রাস্তার ওপর। আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণাকারী শিল্পীরা সেখানে নানান অনুষ্ঠান করছিলেন।
বেইলি রোডের আরেক মাথায় আরেক স্পর্শকাতর পরিস্থিতি! লোকজন মন্ত্রীপাড়ায় হামলার চেষ্টা করছে! এরশাদের মন্ত্রীদের তারা ধরে ছিড়ে ফেলতে চায়! বদলা নিতে চায় নয় বছরের দু:শাসনের। কিন্তু সেনা সদস্যরা তাদের নিরস্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তাদের বলছিলেন মন্ত্রীপাড়ায় কেউ নেই। সব মন্ত্রী তাদের বউ-বাচ্চা নিয়ে পালিয়েছে!
বেইলি রোড থেকে ভোররাতের দিকে একটা রিকশা নিয়ে ইস্কাটনের বাসায় ফিরছিলাম। আমার সঙ্গী হয় প্রিয় প্রজন্ম মানস ঘোষ। এখন টিভি তারকা। তখন স্কুলে পড়তো মানস। পাশের রিকশায় মাথায় তোয়ালে মোড়ানো একজনকে দেখে চিনতে পারি। আবু হোসেন বাবলা। এরশাদের নানা দুষ্কর্মের অন্যতম কান্ডারী! মগবাজার মোড় থেকে আমার রিকশা বাম দিকে নিউ ইস্কাটন রোডে ঢুকেছে। আর বাবলাকে বহনকারী রিকশা সোজা চলে গেলো তেজগাঁও-ক্যান্টনমেন্টের দিকে। আমার রিকশা চালককে বললাম, কে গেল ওই রিকশায় চিনতে পেরেছেন? বিস্ফোরিত জিজ্ঞাসা তার, কে গেলো? আবু হোসেন বাবলা বলতেই ক্ষেপে যায় রিকশাচালক! আমাকে আগে বলবেন না! পিষে মেরে ফেলতাম না! এদের কারণে এতদিন পেটে পাত্থর বাইন্দা চলছি। ঠিকমতো কাজ করতে পারিনি।’
গণঅভ্যুত্থানের সেই রাতের অনেক স্মৃতির সঙ্গে সেই শ্রমজীবী রিকশাচালকের সেই প্রতিক্রিয়ার কথা কোন দিন ভুলতে পারিনি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)