মিলান শহরকে সত্যি সত্যি আমি অনেক ভালোবেসে ফেলেছিলাম। মিলান শহরের পুরনো বাড়িঘর, গলি ঘিঞ্জি, পাথুরে রাস্তাঘাট, সন্ধ্যারাতের নির্জন পার্কার ততধিক নির্জন বেঞ্চি, ঘিঞ্জি এলাকার গমগম করা বার, বারের মেশিনে বানানো কফির তীব্র গন্ধ, বৃষ্টির দিনে সিগারেটের ধোঁয়ায় নিকষ কালো পাথুরে রাস্তাকে পেছনে ফেলে একাকি হাঁটতে থাকা সময়- সবকিছুই আমাকে আকর্ষণ করত। ছোটবেলায় বাংলা সিনেমার সাপুড়ের বীণ বাজানোর শব্দে মন যেমন ছুটে যেত কোথায় কোথায়- মিলানে থাকার সময় বীণ বাজানোর মতো একটা শব্দ সব সময় আমার কানে লেগে থাকত।
ভাবলাম দেশে ফিরে যাবার আগে হিমু দাদার সঙ্গে দেখা করে যাব। আমার মেঝ দাদার নাম হিমু। ৮৪ সাল থেকে আমার ভাই সুইডেনে থাকে। শহরের নাম মালমো। ছোট্ট ছিমছাম শহর। মালমোর পাশেই কোপেনহেগেন। গেলাম ওখানে। গরম নিয়ে মিলান থেকে বিমানে উঠে ঠাণ্ডার দেশে নামলাম। বরফ না পড়লেও আমার হিম হয়ে যাবার দশা।
বেশ কয়েক দিন ছিলাম মালমোতে। অনেক ঘোরাঘুরি করলাম। নিশ্চিন্তে ইউরোপে থাকার সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেশে চলে এসে অনিশ্চয়তার জীবনে পড়ব, কী করব না করব, সংসার চলবে কিভাবে, ছেলেমেয়ের পড়াশোনারই বা কী হবে! এসব সাত-পাঁচ ভেবে ভেবে মন খারাপ।
ভাই-ভাবি কাজে চলে গেলে আমি একা একা ঘুরতাম। ইউরোপের শহর দেখার মধ্যে রয়েছে আরেক আকর্ষণ। প্রথম দেখায় মনে হবে ইউরোপের প্রত্যেকটা শহর বুঝি একইর কমের!
আসলেই কি তাই! আমার মনে হয়েছে এখানকার একেক শহরের রয়েছে একেক রকম ক্যারিশমা।
আমি মালমো শহর দেখি। আর ইউরোপের যেকোনো শহরে আমি যাই না কেন আমি আমার মতো করেই সেই শহর দেখি। কেউ যদি আমাকে শহর দেখার নির্দেশিকা ধরিয়ে দেয় আমি সেটা নেই। কিন্তু শহর দেখি আমার নিজস্ব নিয়মে। বরাবরের আমি যেভাবে দেখি সেভাবেই দেখি।
আমি শহরের কী কী দেখি!
দেখি একটা শহরের অলি গলি।
সেই শহরের পুরনো রাস্তাঘাট।
রাস্তাঘাটের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বার।
পুরনো বাড়িঘর।
ক্যাসেল।
গির্জা।
মানুষজন।
নিঃসঙ্গ গাছেদের মতো হাত ধরাধরি করে চলে যাওয়া প্রবীণ দম্পতি।
ট্রাম লাইন।
পুরনো ট্রেন স্টেশন।
আর!
আর খুঁজে বেড়াই শহরের হাওয়ায় হাওয়ায় উড়তে থাকা স্বজনহীন অভিবাসী মানুষের কার্পাস তুলোর মতো নিঃশ্বাস…।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)