‘হুমায়ূন আহমেদ শুধুমাত্র আমার বন্ধু ছিলেন না, বন্ধুর চেয়েও অনেক বেশি কিছু ছিলেন। বন্ধুর চেয়েও বেশি বলতে আসলে এই অর্থে যে তিনি ছিলেন আমার অভিভাবক, বড় ভাই ও পিতা এবং সেই সাথে সাহিত্যের একজন কিংবদন্তি তুল্য লেখক হিসেবে, আমার অগ্রজ হিসেবে সব মিলিয়ে তিনি আমার বন্ধুর চেয়েও অনেক বেশি কিছু ছিলেন। আজ তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমরা তাকে গভীরভাবে স্মরণ করছি, ভালবাসছি এবং অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আজ তিনি হয়ত শারীরিক ভাবে আমাদের মাঝে নেই, তবে তার রচনা, স্মৃতি ও ভালোবাসা এখনো আমাদের মাঝে রয়ে গেছে। এখনো বাংলাদেশের কোটি কোটি পাঠক তার লেখাগুলোকে পড়ার জন্য উম্মুখ হয়ে থাকে।’
বাংলা কথাসাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক ও কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন এই সময়ের আরেক জনপ্রিয় সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন।
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে চ্যানেল আইয়ের বিশেষ ‘তৃতীয় মাত্রা’য় অতিথি হয়ে এভাবেই বলছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। ফরিদুর রেজা সাগরের উপস্থাপনায় এদিন বিশেষ ‘তৃতীয় মাত্রা’য় অতিথি হয়ে মঞ্চে আরো ছিলেন সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও অন্য প্রকাশের কর্ণধার মাজহারুল ইসলাম।
হুমায়ূন আহমেদের সাথে পরিচয়ের শুরুর দিকের কথা তুলে ধরে ইমদাদুল হক মিলন বলেন, হুমায়ূন আহমেদ এর সাথে আমার পরিচয়ের শুরুটা মূলত ১৯৮৪ অথবা ৮৫ সালের দিকে। এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যাই আমরা একসাথে কাটিয়েছি। এরপর আরো কিছুটা সময় যাওয়ার পর আমাদের সাথে যুক্ত হলো মাজহার। হুমায়ূন ভাইয়ের শেষ সময়গুলোতে মাজহার ও হুমায়ূন ভাই পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকতেন। মাজহার এখনো সেখানে আছেন, হুমায়ূন ভাইয়ের ফ্ল্যাটটিও আছে। বর্তমানে সেখানে শাওন থাকে, কিন্তু হুমায়ূন ভাই সেখানে আর নেই। তবে তার স্মৃতি, ভালোলাগা ও ভালবাসাগুলোকে নিয়ে মানুষগুলো ঠিকই রয়ে গেছে।
হুমায়ূন আহমেদের সাথে স্মৃতির শেষ নেই জানিয়ে এই কথাসাহিত্যিক আরো বলেন, হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে আমার স্মৃতির কোন শেষ নেই। তার সাথে আমার অনেক স্মৃতি। একটা সময় আমি ও হুমায়ূন ভাই প্রতিটা দিন বাংলাবাজারে গিয়ে বসে থাকতাম। বসে থাকতাম বলতে এই জন্য যে, আমাদের বই গুলো হয়তো ছাপা হবে, কোন প্রকাশক হয়ত আমাদের কিছু টাকা দিবেন এজন্যই। একটা দিনের কথা আমার মনে আছে যে, একদিন সকাল বেলা একজন প্রকাশক আমাদের বলেছিলেন সকাল ১১টার সময় যাওয়ার জন্য। সেসময় আমি গেন্ডারিয়াতে থাকতাম এবং আমি সেখান থেকে হেঁটে চলে এসেছিলাম। হুমায়ূন ভাই থাকতেন আজিমপুরে, সেখান থেকে তিনিও চলে এসেছিলেন, সেদিন তার ইউনিভারসিটিতে ক্লাস ছিল না। তো যথারীতি আমরা সকাল সকাল সেখানে গিয়ে বসেছিলাম প্রকাশক কিছু টাকা দিবে এই ভেবে। কিন্তু সেখানে ১১টা পার হলো, ১২টাও পার হয়ে গেলো এমনকি ১টার পরও কেউ আসলো না। সেই দোকানের কর্মচারীটি আমাদের একবার চাও খাইয়েছিল। কিন্তু আমাদের কাছে কোন টাকা ছিল না যে আমরা কিছু কিনে খাবো। সুতরাং আমাদের বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করতেই হলো। অবশেষে প্রায় ৪টার দিকে সেই প্রকাশক সেখানে আসলেন এবং আমাদের বললেন যে, আজ তিনি টাকা দিতে পারবেন না। কারণ সেদিন টাকা যোগাড় হয়নি। তো আমাদের দুজনেরই খুব মন খারাপ হলো এবং আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। তো হুমায়ূন ভাই সেখান থেকে বেরিয়ে আমাকে জিজ্ঞাস করলেন যে তোমার কাছে কয় টাকা আছে? তো আমি বললাম যে, এই ১০ থেকে ১৫ টাকা হবে। তো এই হুমায়ূন ভাই ও আমি একসময় যে প্রকাশকদের কাছে গিয়ে টাকার জন্য বসেছিলাম, এই হুমায়ুন ভাইকে মাজহার একসঙ্গে ১০ লক্ষ টাকা এডভান্স করেছিলেন! তাও আবার বস্তা ভরে। এবং সে সময় হুমায়ূন ভাই বলেছিলেন যে এর আগে তিনি এত টাকা কখনোই একসাথে দেখেননি।
তো যে এক প্রকাশক আমাদের টাকার জন্য ঘুরিয়েছিলেন ঠিক তার বিপরীতে মাজহারের মত একজন প্রকাশক হুমায়ূন ভাইয়ের জন্য ১০লক্ষ টাকা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। মূলত সেখান থেকেই মাজহারের সাথে হুমায়ূন ভাইয়ের সম্পর্কটা ভালো হলো এবং আমার ব্যাপারটা এমন যে বিকেল হলেই আমার হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে দেখা করতেই হবে। দক্ষিণ হাওয়ায় যাবো হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিবো এমন। তো এমন অনেক স্মৃতি আছে হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে যা বলেও শেষ করা যাবে না।