সামরিক কায়দায় ক্ষমতা দখল, জাগদল ও জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট হয়ে বিএনপিতে পরিণত হয় দলটি। যার পুরো নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। ক্ষমতার মধু খেতে অনেক ডান বাম, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার এ দলটিতে ভিড় করে। যদি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রনায়ক না থেকে কেবলই একজন নাগরিক হিসেবে এমন একটি দলে যোগদানের আহ্বান করতো। সে আহ্বানে কয়জন সাড়া দিতো তখন? জিয়া তখন আওয়ামী লীগ এন্টিদের খুঁজে খুঁজে বের করে দলে টেনে নেয়।
আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। সে সংগ্রামে স্বাধীনতাবিরোধীরা পরাস্ত হয়েছে। নিজস্ব ক্ষমতা ও দলীয় শক্তি বাড়াতে জিয়া স্বাধীনতা বিরোধীদেরকেও দলে নিয়েছেন ও তাদেরকে মন্ত্রীত্ব দিয়েছেন। অথচ তিনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি দলে এনেছেন আওয়ামী লীগ এন্টি বামদেরকেও। শেখ মুজিবের আমলে বাম আদর্শ বাস্তবায়নে জানবাজী করা বামেরা ক্ষমতার মধু খেতে সংবিধান হতে সমাজতন্ত্র ডিলিট কারীর দলে যোগ দেয়। এভাবেই ডান বাম হতে মধুপিয়াসীদের নিয়েই গড়ে ওঠে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। আওয়ামী লীগ হতে তাদের আদর্শিক স্বাতন্ত্র দৃশ্যমান করতে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বদলে বলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। জিয়া নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবী করে। জিয়াপন্থীরা জনসম্মুখে এমন কথাও বলতে থাকে যে শেখ মুজিব পাকিস্তানীদের কাছে আত্মসমর্পন করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতা চাননি।
ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল গঠনের সূত্রপাত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। খুনী মোশতাক ডেমোক্রেটিক লীগ নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। জিয়া গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলকারী লে: জে: হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ গঠন করেন জাতীয় পার্টি। ক্ষমতার মধু পিয়াসীরা তখন ভিড় করে এরশাদের দলে। বিএনপির অনেক মধুপিয়াসী তখন বিএনপি ত্যাগ করে যোগ দেয় জাতীয় পার্টিতে। জাতীয় পার্টির মধু খেয়ে এরশাদের পতন হলে তারা অনেকেই আবার বিএনপিতে ফিরে যায় ১৯৯১ সালে দলটি ক্ষমতাসীন হলে। এর প্রকাশ্য উদাহরণ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। মোশতাকের স্বল্পকালীন মধু খেয়ে জিয়ার মধু খায় কে.এম ওবায়দুর রহমান। ডান বাম, মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা, প্রগতিশীল, প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক অসাম্প্রদায়িকের মিলন মেলা হয়ে ওঠে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামের দলটি। ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও সুবিধাই এ দল গঠনের ভিত্তি। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দল ক্ষমতায় যায়নি ও লড়াইয়ের সহযাত্রী করে দলীয় নেতাকর্মী বাড়ানো হয়নি। এ দল বেড়ে উঠেছে ক্ষমতার সুবিধাভোগের উপর ভিত্তি করে। সেজন্যই রাজপথের লড়াইয়ে দলটি বারবার ভুল করছে।
নড়বড়ে আদর্শিক ভিতের ফলে মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার মুক্তিযুদ্ধের শত্রু রাজাকারদের কোলে তুলে নিতেও বাধেনি। এখন কেউ কেউ বিএনপিকে জামায়াত সঙ্গ ত্যাগ করতে বলছে। মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ পক্ষ শক্তিতে রূপান্তরিত হতে দলটি কি পারবে জামায়াত সখ্যতা পরিহার করতে? জামায়াত দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না। বিএনপি তাদেরকে জোটের মার্কায় নির্বাচন করতে দিয়ে হয়তো জামায়াত প্রীতিকে আরও অধিকতর দৃশ্যমান করতে প্রয়াসী হচ্ছে।তাই নয় কি? তারা এ সরকারকে অবৈধ বলছে আবার এ সরকারের অধীনে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এই অংশগ্রহণে তাদের রাজনৈতিক কী লাভ হল? দলীয় চেয়ারপার্সন জেলে গেলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বানানো হলো আরেক দণ্ডিত ও ফেরারী আসামীকে। যে দেশেই নেই ও দেশে আসারও সুযোগ নেই, সে করবে দেশের রাজনৈতিক দল পরিচালনা! দলটির ভেতরে যে চলছে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের বিশ্বাস অবিশ্বাসের খেলা। খালেদা জিয়া দলীয় বাঁধনকে বিশ্বাস করতে পারেননি তাই পারিবারিক বাঁধনের দিকেই গেলেন। কারণ দলটিতে নানা মতের নানা পথের সুবিধাভোগীরা নেতৃত্বের জায়গা দখল করে আছে। জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া হয়তো তাদের কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন নি।
বিএনপি নেতারা এক সময় বলেছে অবৈধ সরকারের সাথে কিসের সংলাপ। পরবর্তিতে আবার নিজেরাই সংলাপের প্রস্তাব দিচ্ছে।পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ মেরেও এ সরকারের প্রতি তারা অনাস্থা প্রদর্শন করেছে। অনির্দিষ্টকালের অবরোধ দিয়েছে। সে অবরোধ তারা প্রত্যাহার করেনি তা অটো প্রত্যাহার হয়ে গেছে। পরবর্তীতে তাদের কথিত অবৈধ সরকারের অধীনেই তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলের মৃত্যুতে সান্ত্বনা দিতে গুলশানের বাসায় গেলে খালেদা জিয়া তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাততো দূরের কথা তাকে বাসায় ঢুকতেও দেননি। কিন্তু কেন? কী হতো তাকে বাসায় ঢুকতে দিলে? এতে কি খালেদার ইমেজ কমতো না বাড়তো? যে তারেক রহমান বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে গ্রেনেড মেরে হত্যার পরিকল্পনাকেও স্বাগত জানিয়েছে সেই তারেক রহমান আজ বলছে এ সরকার দমন পীড়ন করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করছে। কিন্তু সেদিন কি শেখ হাসিনার গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করতে তার প্রাণনাশের চেষ্টা হয়নি? গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের চেয়ে জীবনের অধিকার হরণ কি ভয়াবহ নিষ্ঠুর নয়?
বিএনপি নেতারা বলছে, খালেদাবিহীন নির্বাচনে তারা যাবে না। তারা সরকারের কাছে খালেদার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছে। সাজা দিয়েছে আদালত সরকার কি পারে মুক্তি দিয়ে দিতে? সুতরাং এই অযৌক্তিক দাবির পরিণতি কী আর হতে পারে? খালেদার জেলমুক্তি না হলে কি তারা সত্যি সত্যিই নির্বাচন বর্জন করতে পারবে? তারা দাবী জানাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এই দাবীর ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য তাহলে এ সরকারের অধীনে বিগত দিনের নির্বাচনগুলো কেন বর্জন করলো না তারা? এসব নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির কি কোন রাজনৈতিক লাভ হল? বিএনপির চলমান রাজনীতি দেখে বলতে ইচ্ছে করে, পথিক তুমি কি পথ হারিয়েছ? এই পথহারা দলটিকে আওয়ামী লীগ যদি প্রস্তাব দেয় তাদের নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিতে এখন হয়তো তাতেও রাজী হবে। অথচ এ সরকারকে অবৈধ বলে কত কত মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছে তারা। রাজপথের লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে না গড়ে উঠলে কী হয় বিএনপি দেশবাসীকে তা বুঝিয়ে দিল। ক্ষমতকেন্দ্রিক বাঁধন যে সাহসী ও বিচক্ষন হয় না তা-ই দৃশ্যমান হল আজ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)