বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ‘এক্সিট ওয়ে’ এখন নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন আর রাষ্ট্রপতির সাথে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংলাপ সংলাপ খেলা। যা না করলে মুখ রক্ষা করে বিএনপি কোনোভাবেই নির্বাচনে যাবার পথ বা উছিলা খুঁজে পাচ্ছে না। এখন বিএনপি’র একটা ইস্যু দরকার তার দলের কর্মীদের চাঙ্গা করার জন্য। যাতে তারা আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে যায়, প্রার্থী হতে সাহসী হয়।
এই কথা বলার কারণগুলো ব্যাখ্যা করার দাবি রাখে। দিন তারিখ উল্লেখ ছাড়াও সবার মনে আছে যে, বিএনপি বহুবার বলেছে এই নির্বাচন কমিশন অথর্ব, অকার্যকর, সরকারের তল্পীবাহক, ইত্যাদি ইত্যাদি তাই এই নির্বাচন কমিশনের অধীন তারা আর কোনো নির্বাচনে যাবে না। একই কথা বলে তারা জেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জন করেছে কারণ তারা সেই নির্বাচনে জিততে পারবে না তা একদম নিশ্চিত। জেলা পরিষদ নির্বাচন শেষ হয়নি, এর ফাঁকেই কী করে বর্তমান নির্বাচন কমিশন ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ হয়ে গেলো যে তার অধীনে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে গেলো বিএনপি! তাহলে কি তাদের আগের কথা মিথ্যা, নাকি ছিল নির্বাচন বর্জনের ফালতু কৌশল, যা মানুষ এখন আর খাচ্ছে না।
এবার আসি নির্বাচন কমিশন নিয়ে সংলাপ প্রসঙ্গে। বিএনপি সব সময় বলে আসছে বর্তমান সরকার অবৈধ, নির্বাচিত সরকার না। খুব ভালো কথা। তো এই অবৈধ সরকার যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছে তা কি করে বৈধ হয়। অবৈধ কর্তৃপক্ষের সব কর্মকাণ্ডই অবৈধ হয়। অন্তত বাংলাদেশের আইনে তাই বলে। মনে করুন আমি একটি শিল্প কারখানার অবৈধ দখলদার। আমি ঐ কারখানার পক্ষ থেকে যদি কারো সাথে কোনো কিছু বিক্রির বা সরবরাহের চুক্তি করি তবে সেই চুক্তি অবৈধ হতে বাধ্য। অন্তত বাংলাদেশে চুক্তি আইন তাই বলে। তাই বর্তমান সরকার যদি অবৈধ হয় তবে তার নিয়োগ দেওয়া বা করা সব কাজ অবৈধ। যেমন এর আগে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে করা জিয়া আর এরশাদ সরকারের বেআইনি কাজ বাংলাদেশের মহামান্য আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে।
এবার আসি ভোটারবিহীন নির্বাচন আর মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ না করতে দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে। যার অপর নাম ভোটারবিহীন নির্বাচন বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ার বিষয়। প্রথমে দেখবো কেন মানুষ ভোট দিতে যায়নি। স্বেচ্ছায় না ভয়ে? ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ বর্জন করেছিল কিন্তু তারা ভোট প্রতিহত করেনি। কারণ আওয়ামী লীগ জানে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা বাংলার মানুষের অধিকার, এই অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জনগণকে ভোট দিতে না দেওয়া বা বাধা সৃষ্টি করা অপরাধ জেনেও ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি আর তার জোট জাতীয় সংসদ বর্জন করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে মাঠে ছিলো। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে সারা দেশে বহু ভোটকেন্দ্র, প্রাথমিক বিদ্যালয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বিএনপির জোট শুধু নির্বাচন বর্জন করে আগুন জ্বালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, রাতের অন্ধকারে, ভোটকেন্দ্রে ব্যাপক বোমাবাজি করেছিল, মানুষ হত্যা করেছিল, যাতে মানুষ ভোট কেন্দ্রে না যেতে পারে। এর অর্থ হলো বাংলার জনগণকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হয়নি, যা অপরাধ। তাই বাস্তবে মানুষ খুব কম সংখ্যক ভোট কেন্দ্রে গেছেন। ১৯৯৬ সালের মতো ভোট বর্জন করে না, প্রাণের ভয়ে সেটা কিন্তু খুব পরিস্কার।
এবার আসি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবার ইতিহাস কিন্তু এবারই প্রথম নয়। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যায় যে, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা ও প্রার্থী সল্পতার কারণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অধীন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর পরে ১৯৭৯ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ১১ জন, ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৮ জন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকা কালে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির একক নির্বাচনে ৪৯ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। অনেক দল বা জোট বর্জন করলেও কোনো দল প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়নি এ সব নির্বাচনে। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে কিছু রাজনৈতিক দল বা জোট বর্জন করে আর নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। আপ্রাণ চেষ্টা করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার, কিন্তু পারেনি। ভোটারের উপস্থিতি কম ছিল ১৯৯৬ সালে বিএনপি’র করা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের সেই সরকারকে অবৈধ বলেনি। বিএনপি’র নেত্রী বেগম জিয়া সেইবার কয়েকদিনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাই তারা সব সময় বলে থাকেন খালেদা জিয়া তিন তিন বারের প্রধানমন্ত্রী।
বিএনপি’র পক্ষ থেকে আরেকটি অভিযোগ করা হয় প্রায়ই। বলা হয় তিন তিন বারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে আন্দোলনে মাঠে নামতে দেওয়া হয়নি, জনসভা করতে দেওয়া হয়নি। বিএনপি এখনো একটা জনপ্রিয় দল। মাঠে তাদের অনেক সমর্থক আছে। খালেদা জিয়া মাঠে গেলে হাজার হাজার মানুষ মাঠে নামে। উনাকে নিয়ে ছড়ানো একটা মিথ্যা গুজবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মুহূর্তেই ঘোলাটে হয়ে অনেক প্রানহানির ঘটনা ঘটতে পারে, যা বাস্তব। স্বল্প শিক্ষিত বাংলার মানুষ এমনই। তাই তো তারা কুখ্যাত রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে নিয়ে গিয়ে তাণ্ডব করেছিল। যা হোক, ধনী গরীব নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের চোখে অজ পাড়াগাঁয়ের রিমা খাতুন আর বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুইজনেরই একটা করে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কারো বেশি নেই। তাদের জীবনও একটা। আছে তাদের পরিবার। ব্যক্তি একজনের খোলামেলা চলাচলে যদি আগুনে পুড়ে বা বোমায় রিমা খাতুন বা তার স্বামী বা তার ছেলে মেয়েরা মারা যায় তবে কী সরকার সেই দায়িত্ব এড়াতে পারে।
বিএনপি’র ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে যে ভুল করেছে তার সংশোধন করা খুব কঠিন। আগামী নির্বাচনে না গেলে বিএনপি মুসলিম লীগ হয়ে যাবে অচিরেই। তাই যে কোনো অজুহাতেই বিএনপি’কে আগামী নির্বাচনে যেতে হবে। আর তার জন্য দরকার একটা উছিলা। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন আর রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপ একটা উছিলা। এই সংলাপ ব্যর্থ হলেও তারা তা মেনে নিয়ে নির্বাচনে যাবে, যেতে তাদের হবেই নিজেদের অস্তিত্বের জন্য। আগামী নির্বাচনে যাবার জন্য বিএনপি’র একটা উছিলা বা ‘এক্সিট ওয়ে’ দরকার। তারা বুঝে গেছে যে, আগুন খেলায় সরকার পড়বে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)