বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের ভেতরে এবং গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্থাপনাগুলো অপসারণের লক্ষ্যে গত ২৯ জানুয়ারি থেকে বড়সড় অভিযান শুরু করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ); যা কয়েক ধাপে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে।
জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালে দেয়া উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে রাজধানী ঢাকার চারদিকে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করতে বিআইডব্লিউটিএ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গত ৯ বছরে বেশ কয়েকবার এমন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে।
শুধু এই পাঁচ নদীই নয়; নদীমাতৃক বাংলাদেশের অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সকল নদ-নদী রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে রায়ের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানোর নির্দেশনাও দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। এরপর সেই রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণের আলোকে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বিশেষ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বপ্রথম গঠিত হয় নদী বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্স; যার সভাপতি হয়েছিলেন তৎকালীন নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
এছাড়া গঠন করা হয়েছিল স্বতন্ত্র ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’। আলাদা জনবল সৃষ্টি ও দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা না হলেও জাতীয় টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিআইডব্লিউটিএ বিভিন্ন সময় ঢাকা ও এর আশেপাশে অভিযান চালিয়েছে এবং পাঁকা-আধাপাঁকা ও কাঁচা মিলিয়ে ছোটবড় শত শত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। যদিও কিছুদিন পরই প্রভাবশালী দখলদাররা সেসব স্থানে পুনরায় স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।
অন্যদিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের জন্য স্বতন্ত্র জনবল কাঠামো সৃষ্টি করে পৃথক দপ্তর প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারি নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সংস্থাটির জন্য প্রতিবছর আলাদা বাজেটও বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু মারাত্মক দূষণ ও দখলে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলো বাঁচাতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে না। তাই নদী রক্ষা তথা নদীর জায়গায় গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও নদী দূষণমুক্ত রাখতে কার্যত বিআইডব্লিউটিএ-ই এখন ভরসা।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, অভিযানের প্রথম দিন ২৯ জানুয়ারি বুড়িগঙ্গার কামরাঙ্গীরচর এলাকায় ছয়টি পাকা ভবনসহ বেশকিছু আধাপাকা ও কাঁচা স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়; যার মধ্যে দুটি সাততলা ভবনও রয়েছে। একইদিন খোলামোড়ার নবাবচর এলাকায় তিনটি চারতলা ভবনের অংশবিশেষসহ ১০টি পাকা ইমারত ভেঙে দেয়া হয়। সব মিলিয়ে এদিন উচ্ছেদ করা হয় ১৬৪টি অবৈধ স্থাপনা।
দ্বিতীয় দিন ৩০ জানুয়ারি কামরাঙ্গীরচর এলাকায় উচ্ছেদ করা হয় ১৫১টি স্থাপনা; যার মধ্যে ছিল দুটি দ্বিতল ভবন, বিভিন্ন ধরনের সাতটি কারখানা, ২০টি স’ মিল, ৩০০ ফুট পাকা দেয়াল, ৯৫টি টিনের ঘর ও টংঘর। তৃতীয় দিন ৩১ জানুয়ারি কামরাঙ্গীরচরের হুজুরনগর, আশ্রাফাবাদ ও সিরাজনগর এলাকায় পাঁচতলা, তিনতলা ও দোতলা মিলিয়ে ৩০টি ভবন, ২৫টি আধাপাকা ভবন, ৬০টি স’ মিল এবং ১৫টি টিনশেড ও টংঘরসহ ১৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।
সব মিলিয়ে প্রথম দফায় তিনদিনে অপসারণ করা হয় মোট ৪৪৫টি অবৈধ স্থাপনা। এর মধ্যে ঢাকার সরকারদলীয় এক প্রভাবশালী সাংসদের স্থাপনাও ছিল; যে ঘটনা সকলকে আশাবাদী করে তুলেছে।
ঢাকা নদীবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক (বন্দর) এ কে এম আরিফ উদ্দিনের (আরিফ হাসনাত) ব্যক্তিগত ফেসবুক টাইমলাইনের তথ্য মতে, দ্বিতীয় ধাপে ৫-৭ ফেব্রুয়ারি বাদামতলী থেকে কামরাঙ্গীরচর পর্যন্ত পুনরায় অভিযান চলবে।
এ লেখার শুরুতেই বলেছি, ‘বিআইডব্লিউটিএ গত ৯ বছরে বেশ কয়েকবার এমন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে এবং কিছুদিন পরই প্রভাবশালী দখলদাররা সেসব স্থানে পুনরায় স্থাপনা নির্মাণ করেছেন।’ এবারও যে অভিযান শেষে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না- সে নিশ্চয়তা কে দেবে? তাই দিনক্ষণ নির্ধারণ করে অভিযান শুরু ও শেষ করলে এর দীর্ঘস্থায়ী সুফল না-ও মিলতে পারে; অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সুতরাং স্থায়ী সুফল পেতে নদী দখলমুক্ত কার্যক্রমও দীর্ঘস্থায়ী হওয়া দরকার।
আমি ব্যক্তিগত গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্য উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি তুলেছিলাম। তাতে ঢাকার চার নদী ও চট্টগ্রামের একটি নদীর সীমানা নির্ধারণপূর্বক অবৈধ স্থাপনাসমূহ উচ্ছেদের কথা বলা হলেও আদালত তার রায়ে বেশকিছু যুগান্তকারী পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ও পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার আলোকে সারা দেশের নদ-নদীগুলো রক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; বিশেষ করে শেখ হাসিনা নিজেই নদ-নদীসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় তাঁর আন্তরিকতা ও কার্যকর উদ্যোগের কথা বারংবার দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাঁচ নদী ছাড়াও দেশের অনেক বড় নদীর অবস্থাও এখন মরণাপন্ন। দূষণ, দখল, ভরাট, অপরিকল্পিত নগরায়ন-শিল্পায়ন, অদূরদর্শী প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং অনাদর-অবহেলায় নৌপথ সংকুচিত হচ্ছে, এককালের স্রোতস্বীনি নদীগুলো যৌবন হারিয়ে বিপন্ন তালিকাভুক্ত হচ্ছে।
এ ধরনের উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে ধলেশ্বরী, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, মহানন্দা, পুনর্ভবা, চিত্রা, ভৈরব, কপোতাক্ষ, বলেশ্বর, পানগুছি, আঠারোবাঁকি, আড়িয়াল খাঁ, আত্রাই, কুমার, ভোলা, মরা ভোলা, পশুর, বেতনা, ভদ্রা, ভূবনেশ্বর, ইছামতি, মধুমতি, কাজিবাছা, কুশিয়ারা, সুরমা ও মুহুরীসহ দু’শতাধিক নদী। আমার নিজস্ব গবেষণা ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, উল্লেখিত সবগুলো নদীরই কোনো না কোনো অংশে অবৈধ দখলদারদের হিংস্র থাবা পড়েছে; যথাযথ তদারকি ও রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে মাত্রারিক্ত দূষণে দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে নদীগুলো।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের স্বার্থে প্রাকৃতিক পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে এসব গুরুত্বপূর্ণ নদীকে পুনরায় প্রবহমান করে তোলা যে এখন অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়েছে, সে কথা নিশ্চয়ই নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এ কাজটি করার আগে নদীগুলোকে অবশ্যই দখলমুক্ত করা প্রয়োজন; একই সঙ্গে প্রয়োজন দূষণ প্রতিরোধ করা। নদী যদি জনগণের মালিকানায় না থেকে অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে যায়, তাহলে সেগুলো রক্ষা হবে কীভাবে? আর এ জন্যই দরকার বছরজুড়ে দেশব্যাপি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। কাজটি অনেক কঠিন হলেও বিআইডব্লিউটিএ জনস্বার্থে দুঃসাহসিক এ কাজটি করবে এবং এ ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সকল প্রকার সহায়তা দেয়া হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)