‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ, বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না…গানে গানে এই বায়োস্কোপের কথা শুনলেও নতুন প্রজন্মের অনেকেই চেনেন না বায়োস্কোপ। তবে এবার এই রাজধানীতেই দেখা মিললো দেশের সংস্কৃতির প্রায় হারানো ঐতিহ্য বায়োস্কোপের।
বাংলা একাডেমি চত্বরে পা রাখতেই ‘কী চমৎকার দেখা গেলো…’ সুর কানে ভেসে আসছিল। নজরুল মঞ্চের পাশে বয়স্ক একজন লোককে দেখা গেল ছন্দে ছন্দে কিছু পাঠ করতে, প্রায় পুঁথি পাঠের মতো। তিনি পাঠ করছিলেন আর সামনে থাকা বাক্সে একটি চাবি ঘুরাচ্ছিলেন। পাঁচ-ছয়জন শিক্ষার্থী চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে বায়োস্কোপ দেখছে আগ্রহভরে।
বাংলা একাডেমিতে সম্পন্ন হয়ে গেলো ১০ দিনের বৈশাখী মেলা-২০১৮। সেখানেই দেখা মিলেছিল আব্দুল জলিল মন্ডলের- ‘বায়োস্কোপ’। পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু হওয়া ওই মেলার শুরু থেকেই বায়োস্কোপ নিয়ে বসেছিলেন আব্দুল জলিল। বাংলা একাডেমিই তাকে সেখানে বসার অনুমতি দেয়।
বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই বায়োস্কোপ। এক সময় গ্রাম-বাংলার এমনকি শহরের শিশু-কিশোরদের বিনোদনের মাধ্যম ছিল বায়স্কোপ। কারণ তখন রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের এত প্রসার ছিল না। তাই গ্রামের হাঁট-বাজার বা মেলায় বায়োস্কোপ দেখা যেত। আবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরেও এই বায়োস্কোপ দেখানো হতো কিছু পয়সা কিংবা চাল, ডাল, ফল, শস্য বা শাকসবজির বিনিময়ে। কিন্তু এখন এই বায়োস্কোপ বিলুপ্ত প্রায়। নতুন আবিষ্কার ও হাতের কাছে ডিজিটাল সিনেমা দেখার জন্য সহজ লভ্য মোবাইল ফোন, টিভি, ডিভিডি,ল্যাপটপ ইত্যাদির মাঝে “বায়স্কোপ-এর ঠায় হতে যাচ্ছে জাদুঘরে।
তবে হারিয়ে যেতে বসা এই দিনেও দেশের নানা প্রান্তে বায়োস্কোপ নিয়ে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাজশাহীর মো: আব্দুল জলিল মন্ডল। ভেঁপু বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে আহবান জানিয়ে দুলদুল ঘোড়া, মক্কা-মদিনা, আজমির শরীফ, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, লালবাগ, আগ্রার তাজমহল, লন্ডন, আমেরিকার বায়োস্কোপ দেখিয়ে আনন্দ দিয়ে চলেছেন তিনি।
সত্তরোর্ধ্ব আব্দুল জলিল রাজশাহী ছেড়ে দেশের এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে বায়োস্কোপ নিয়ে বিভিন্ন মেলা, পূজা-পার্বণে থেকে শুরু করে নানা উৎসবে বায়োস্কোপ প্রদর্শন করে থাকেন।
কিন্তু বায়োস্কোপের দিনকাল ভালো যাচ্ছে না বলে জানালেন আব্দুল জলিল। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বায়োস্কোপের আকাল চলছে এখন। মানুষের হাতের নাগালে বিনোদনের ডিজিটাল মাধ্যম থাকায় বায়োস্কোপের কথা এখন কেউ মনে করে না। ফলে আয়-রোজগারও হয় না তেমন। তবু তিনি চালিয়ে নিচ্ছেন। বায়োস্কোপের সঙ্গে যে আত্মার বন্ধন তৈরি হয়েছে তা ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব নয়।
আব্দুল জলিল মন্ডল জানান, বায়োস্কোপে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৬ জন একটি প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারেন। রিল হিসেবে টিকেট মূল্য নির্ধারিত হয়। প্রদর্শনীর সময়সীমা অনুযায়ী টিকেটের মূল্য কমবেশিও হয়ে থাকে। আবার শহর অঞ্চল-গ্রামাঞ্চল ভেদে প্রদর্শনী মূল্যের তারতম্য আছে। গ্রাম্য মেলাগুলোতে প্রতি শো ১০-২০ টাকা এবং শহরাঞ্চলে শো প্রতি ২০-৫০ টাকা নির্ধারিত হয়ে থাকে।
বাংলা একাডেমিন মেলাতে তিনি মাত্র ২০ টাকায় নগরের নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করিয়েছেন বায়োস্কোপের সঙ্গে। মেলা কেন্দ্রিক এই পরিবেশনায় সাধারণত দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিড় ছিল বেশি। ভিড়ের ওপর নির্ভর করে রিল টানার গতি। ১০ দিনের বৈশাখী মেলায় বায়োস্কোপ প্রদর্শন করে আব্দুল জলিল প্রতিদিন গড়ে ৫০০-১০০০ টাকা আয় করেছেন বলে জানান তিনি।
এই সামান্য আয় দিয়ে পরিবার চালানো কঠিনই বলছেন তিন সন্তানের জনক আব্দুল জলিল। সন্তানদের পড়ালেখা করাচ্ছেন। নিজের বয়স হয়ে গেছে। বায়োস্কোপের ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিজ সন্তানদের কাউকে বায়োস্কোপ প্রদর্শনীর জন্য নিযুক্ত করবেন কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি সরাসরি নাকচ করে দেন। এগুলো করে চলবে না।
জলিল জানান, এই পেশায় এখন কেউ আসতে চায় না। কারণ বায়োস্কোপে নানা রং-ঢংয়ের মাধ্যমে বর্ণনা দিয়ে একটি দৃশ্যকে বাস্তবে রূপান্তর করতে হয়, যা একটি কষ্টসাধ্য কাজ। নতুনরা এই কষ্ট স্বীকার করতে আগ্রহী নন। আবার প্রযুক্তি ভিত্তিক নানা বিনোদনের মাধ্যম আসায় বায়োস্কোপের প্রতি আগ্রহও কমে যাচ্ছে লোকজনের।
কিন্তু বায়োস্কোপ বাংলার যে ঐতিহ্য, এই ঐতিহ্য ধরে রাখার ব্যাপারে নিজের কোনো উদ্যোগ কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো সহযোগিতার আশা করেন কিনা, এমন প্রশ্নে আব্দুল জলিল কিছুটা বিরক্তি আর হতাশা নিয়ে বলেন, আমি নিজে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সারাদেশে ঘুরে বেড়াই। ভালো লাগা থেকেই তা করি। এগুলো নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। কে শুনবে আমার কথা? কাকে বলবো?
আব্দুল জলিলের বিরক্তি আর হতাশার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতা হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে বায়োস্কোপ! বাঙালি সভ্যতা আর ঐতিহ্যের অসামান্য এই উপাদানকে হয়তো টিকিয়ে রাখতে পারে সরকারি-বেসরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা।