হাসুর নিজের এক মনোরসায়নের কথা মনে পড়ছে। অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছিল। টুঙ্গিপাড়া দিগন্ত ছোঁয়া মাঠের কিনারে দাঁড়িয়ে দেখছে – ঢালু ঢেউ খেলানো সবুজ – মাঠ ও মাটি পেরিয়ে আকাশ যেখানে শেষ; সেখানে বাবার মুখখানি। তিনি চুপটি করে বসে। মৃদু হাসছেন। সেই স্বপ্নের গল্প সবাইকে বলল। মা বললেন, খুব ভালো স্বপ্ন দেখেছিস। তার মানে তোর বাবাকে হত্যা করতে পারেনি।
মায়ের কথায় ভাইবোনেরা প্রচণ্ড আশাবাদী হয়ে উঠল। নিরুদ্দেশ পিতার সন্তানদের ক্ষেত্রে যা হয় – পরের কয়েকদিন অন্য ভাইবোনও ভালো ভালো স্বপ্ন দেখতে লাগল।
সবাই বাবাকে দেখছে। কেউ বাবার সঙ্গে কথাও বলেছে – এমনটাও দেখল। চরম হতাশা, কঠিন দুরাশার দিনে ওরা স্বপ্নগুলোকে সাক্ষী করেই আশার দিন গুনছিল। আবার একদিন দূর দিগন্ত ঢেউ খেলানো অনিশেষ মাঠের স্বপ্ন দেখল হাসু। ছোট্ট শিশুটি হয়ে গেছে সে। বাবাকে ছুঁতে ছুটছে এবং ছুটছে। সেকি কষ্ট। বাবাকে কিছুতেই ছুঁতে পারছে না। এই স্বপ্নের কথা অন্য কাউকে ভয়ে বলেনি। এমন কি আম্মাকেও না। বুকের মধ্যে চেপে রেখেছিল একাই। নিজেই নিজেকে বলেছে – এই স্বপ্ন শৈশবের কষ্টের ছবি। কারাবন্দি বাবাকে নিয়ে শৈশবের মানসপটে কত দু:খঝরা ক্ষত রয়ে গেছে। একটা দুঃস্বপ্ন দেখল সে। বাবা বাক্স-পেটরা গুছিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন; একটা রিকশা এসে সদর রাস্তায় দাঁড়াল। গুটানো তক্তপোষ তোলা হলো। যেতে নাহি দেব। হাসু বাবার পাঞ্জাবি ধরে টানছে।
এই স্বপ্নটা গুম হয়ে মাথায় কেমন চাপল। এমন কাণ্ড কেনো দেখল? কী অর্থ হতে পারে এসবের? কোথায় যাচ্ছেন বাবা! কেনোই বা পথ আটকে দিতে চাইল ওরা? কোনো মনোবিজ্ঞানীকে বললে হয়তো বৈজ্ঞানিক কোনো বিশ্লেষণ দিতে পারেন! হয়তো বলবেন – স্বপ্ন মস্তিষ্কের মধ্যে ক্রিয়াশীল নানা দুশ্চিন্তার যৌগ ফল। স্বপ্নের বিশেষ কোনো মানে নেই!
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2024/02/Channeliadds-Reneta-16-04-2024.gif?fit=300%2C250&ssl=1)
হয়তো তাই ঠিক! কিন্তু যে পরিস্থিতি ও বিরূপ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন বিজ্ঞান নিয়ে ভাববার কিংবা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় সান্ত্বনা পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। এ কষ্ট কেবল তার বেলাতেই সত্য, যার বাবা নিরুদ্দেশ।
সেই নিরুদ্দেশ বাবার উদ্দেশ পাওয়া গেল এপ্রিলে। ঠিক উদ্দেশ বলা যায় না, বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল, তিনি প্রাণে বেঁচে আছেন। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে তাকে রাখা হয়েছে। কোথায়, কীভাবে কোন অবস্থায় আছেন, তা বিস্তারিত জানা গেল না। তিনি বেঁচে আছেন, ওরা তাকে অপহরণ করলেও চিরতরে গুম করে দেয়নি; এ খবরটিই তখন দুশ্চিন্তাক্লিষ্ট পরিবারের জন্য যথেষ্ট। মাসের পর মাস যার খোঁজ পেতে ওরা হন্যে, তার সম্পর্কে জানতে পেরে বড় স্বস্তি।
প্রাণহীন হয়ে পড়েছিল ওরা। সকলের দেহে যেন প্রাণ এলো। মা তখন খোদার দরবারে শুকরিয়া জানিয়ে আবারও চোখের পানিতে অস্থির। এই সময়টাতে কোনো খবর সংবাদপত্রেও প্রকাশ পায়নি। শেখ মুজিবরের কী খবর – পত্রিকার পাতায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পায়নি। আরও পরে মে মাসে জানা গেল, বাবার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। অবাস্তব কাল্পনিক ইউটোপীয় এক মামলা। আগরতলায় ষড়যন্ত্রের অভিযোগ।
এই সময় জানতে পায় – ক্যান্টনমেন্টে একটি রুদ্ধ কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে বাবাকে। নির্জন কুঠুুরি। বাইরের জগত থেকে পুরোই বিচ্ছিন্ন। কারও সাথেই দেখা করতে দেয়া হয়নি। নিউজপেপার ছিল না। হাঁটা চলাও করতে দেয়া হয়নি। জীবন্মৃৃত বানিয়ে ফেলার সুকৌশলী চক্রান্ত। অমানুষিক মানসিক নির্যাতন। এই অন্তহীন নির্জনতায় উন্মাদ হয়ে পড়েন অনেকে। হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্য। জালিমরা তেমনটাই চাচ্ছিল। মুজিবকে উম্মাদ বানানোর ষড়যন্ত্র মোটেই কাজে লাগল না।
বাবার মনোবল তুঙ্গস্পর্শী। এ সময়ের কবরের মতো নিঃসঙ্গ দীর্ঘ নিস্তরঙ্গ জীবনও তাকে কাবু-পঙ্গু করতে পারেনি।
নিজের পিতাকে চোখের আলোয় দেখতে পাওয়া কত আনন্দের – মে মাসের মাঝামাঝি একদিন ওরা সেই অনাবিল সুখের দেখা পেল। দু’জন আর্মি অফিসার এসে সকালে জানাল – বিকেল তিনটায় শেখ সাহেবের সঙ্গে বেগম সাহেবা ও সন্তানেরা দেখা করতে পারবেন। সেদিন মুহূর্তগুলো কিছুতেই কাটতে চায় না। কামাল, জামাল, রেহানা অস্থির হয়ে উঠল। আম্মা যে কি করবেন, তিনি চোখের পানিতে একাকার হয়ে থাকলেন।
ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে গিয়ে দেখা গেল – সত্যিই আব্বা বেঁচে আছেন। শুকিয়ে গেছেন তিনি। ক্লান্ত বিষণ্ন লাগছিল। ওরা কেউ নিজেদের সম্বরণ করতে পারেনি। হাউ মাউ করে কাঁদছিল। আম্মার কোলে রাসেল। তখন এত্তোটুকুন ভাইটা। সবার কান্না দেখে সেও কাঁদছে।
আব্বাও হতভম্ব হয়ে পড়লেন। কামাল আব্বাকে ধরে দেখল। ওর বুঝি এই আনন্দময় সত্যকে বাস্তব বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই স্পর্শ করে দেখল – সত্যি সত্যি আব্বা সামনে। এটা নিশ্চয়ই কোনো দিবা স্বপ্ন নয়।
হাসু বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি মাথায় হাত রাখলেন। কি প্রশস্ত-প্রগাঢ় সেই স্পর্শ। মনে হলো, শৈশবে টুঙ্গিপাড়ার সেই বাড়িতে, বিরাট উঠোনে কোনো এক জ্যোৎস্নাভরা রাতে বাবার পশমী চাদরের ভেতর তার স্নেহের উষ্ণতায় নিজেকে যেভাবে আবিষ্কার করেছিল – তারপর এতকাল দেখা হয়নি তার সঙ্গে। এবার এই প্রথম দেখা। সেই শৈশবের বাবাই সামনে। স্বপ্নের ভেতরে মাঠের দূর দিগন্তে যে মানুষটার জন্য ছুটে হয়রান হয়ে পড়েছিল; তবুও তাকে স্পর্শ করতে পারেনি – সেই বাবাকেই এখন পেয়েছে। তারুণ্যভরা উন্নত সেই দীর্ঘ পুরুষ।
বাবা গমগম করা কন্ঠে কিছু বললেন; বাবাকে দেখার আনন্দে হাসু শিশুর মতো উতলা হয়ে পড়েছিল।
ওরা আমাকে মেরেই ফেলতে চাইছে মাগো। সেই প্ল্যানই ওরা আঁটছে। হয়তো এবারই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নির্জনতায় ডুবিয়ে লাশ বানাতে চাইছিল। কিন্তু ওরা জানে না ওদের সকল ষড়যন্ত্র ছিন্নভিন্ন করে আমি এ পর্যন্ত এসেছি। আমি মরব একদিন সত্য। কিন্তু বাঙালির মুক্তি না দেখে আমার আত্মা এই দেহ ছেড়ে যাবে না।
তাছাড়া উভয় সঙ্কটে পড়েও ওরা আমায় হত্যা করতে পারছে না। বল প্রয়োগে, বিষ প্রয়োগে যেভাবেই আমার প্রাণবায়ু কেড়ে নিক; ওদের মনে ভয় ধরে গেছে – সে খবর আমার বাঙালি ভাইদের কানে পৌঁছালে ওরা এক মুহুর্তও তখতে তাউসে থাকতে পারবে না। বাঙালি ওদের প্রাণ বায়ু বের করে ছাড়বে।
ভয় পাসনে মা গো; ওরা ভীরু প্রচণ্ড। ওরা কাপুরুষ। মসনদের মোহে ওরা এমনই মশগুল, আমাকে গুম খুন করে নিজেদের অস্তিত্বকে অকাতরে বিলিয়ে দেবে না। বরং এখন হাস্যকর কাল্পনিক মামলা করেছে। ভাবছে, প্রহসনের বিচার করে ভুজুং ভাজুং দিয়ে আমাকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝোলাবে। ওরা মুর্খের স্বর্গে বাস করছে। তুই দেখিস – একদিন জনগণ ওদের সমুচিত বিচার বিধান করবে। জনতার চেয়ে বড় বিচারপতি কেউ নয়। কোনো প্রহসন মানুষ মেনে নেবে না। ওরা জনগণের শক্তিমত্তা এখনো দেখেনি। গণঅভ্যুত্থানের কী অসম্ভব শক্তি – রাওয়ালপিন্ডি তা জানে না। ওরা অন্ধের মতো উপায় হাতড়ে ফিরছে। ওদের পরিণতি জানতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।
বাবা নিশ্চয়ই ভবিষ্যত দ্রষ্টার দিব্য দৃষ্টিতে ইতিহাসের যে অনিবার্যতাকে ছবির মতো দেখতে পাচ্ছিলেন, তাই জয়ধ্বনির মতো অকুণ্ঠে বলেছেন। কিন্তু মায়ের যাপিত সংসারে অমল ঋষির ভাবচৈতন্যর কোনো সুযোগ ছিল না। সেখানে জীবন পূর্ণিমার চাঁদের মতো ঝলসানো রুটি। আরও খোলাসা করে বললে জীবন সেখানে মধ্যাহ্নের জলন্ত সূর্যের অসহ্য খরতাপ।
বাবাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়ছিল। তাকে মৃত্যুকূপের অনিশ্চয়তায় রেখে ওরা একটি দিনও সুস্থির থাকতে পারেনি।
চারপাশে দুঃসময়। মোনেমশাহী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে সারা বাংলায়। ৩২ নম্বর বাড়িকে ঘিরেও কঠোর ছায়া প্রহরা। এক রকম একঘরে করে রাখার সকল আয়োজন চূড়ান্ত। বাড়িটার মধ্যে ওরা ভেতর মরে না বেঁচে আছে – কেউ যেন খবর নিতে না পারে। কেউ এ বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে কিনা, বাবার মামলা লড়তে মা কী করছিলেন – শত গোয়েন্দা চিলের মতো নজর করে রয়েছে। আর মোনেম খান গভর্নর হাউসে বসে শকুনের মতো অপেক্ষায় – মুজিবকে ফাঁসি দিতে পারলেই তার লক্ষ্যভেদ। তার জল্লাদ-দিলে পরম প্রশান্তি।
আগরতলা প্রহসন শুরু হলো। ওরা ওদের কল্পনাশক্তির মাজেজা দেখাতে লাগলো। বাবা প্রধান আসামী। আরও ৩০ জন তার সঙ্গে। রূপকথার কল্পনানির্ভর নাটক। কয়েকশ’ দালাল, চামচা, শিখন্ডিকে তারা সাক্ষ্য সাজিয়ে মঞ্চে নামাল পুতুল নাচের মহড়ায়। পিন্ডির সূতোয় শিখন্ডিরা নাচছে।
মা তখন বলতে গেলে একঘরে। তাকে কোথাও কোনো যোগাযোগ করতে দেয়া হচ্ছে না। কী করবেন, কীভাবে মামলা লড়বেন। তিনি হন্যে হয়ে উপায় খুঁজছেন। উকিল কোথায় পান, যিনি অন্তত বাবার জন্য লড়বেন? দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায় মাকে রীতিমতো শুকিয়ে যেতে দেখছে চোখের সামনে। অবশেষে আত্মীয়দের মধ্যে এক সিনিয়র উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ। বাবাই বলেছিলেন তার কথা। কয়েকজন তরুণ আইনজীবী স্বেচ্ছায় বাবার জন্য আইনি প্যানেলে যোগ দিলেন। তারপরও কোথায় স্বস্তি!
বাবা যেমন ক্যান্টনমেন্টের বন্দিশালায়; ওরা ৩২ নম্বরেই বিচ্ছিন্ন-জনমানবহীন দ্বীপে যেন থাকছে!
আম্মা যাতে সুষ্ঠুভাবে আইনি লড়াইটাও চালাতে না পারেন – তারও শাহী ষড়যন্ত্র চলছিল।
আওয়ামী লীগের ত্যাগী-জানবাজি কর্মী ছিল কম নয়। তরুণরা জানসর্বস্ব কবুল করতেও পিছপা হতো না। কিন্তু সবার বিরুদ্ধে হুলিয়া। আত্মগোপনে পালিয়ে ফিরছে। পুলিশ সশব্দ বুটের আওয়াজ তুলে মধ্যরাতেও বাড়িতে বাড়িতে তাদের খুঁজছে। কারোরই ৩২ নম্বরের কাছে পিঠে আসার উপায় ছিল না।
পরিস্থিতি কত শোচনীয় – হাসু তখন রোগভোগের মাধ্যমে তা জানল। একদিন ভার্সিটি থেকে ক্লাস করে ফিরেছে। হঠাৎ পেটে ভীষণ ব্যথা। হাসু কাতরাচ্ছিল। ডাক্তার খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, ৩২ নম্বরে আসতে ভয় পাচ্ছে অনেকে। মুজিব কন্যার চিকিৎসা করে জুলমশাহীর শকুন নজরে পড়তে সবার আতঙ্ক। অবশেষে সাহসী একজন এলেন। প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তিনি জানালেন, এপেনডিসাইটিস হতে পারে। এক্স-রে দিলেন। কিছু ওষুধপত্রও দিলেন। তা খেয়ে যন্ত্রণা কিছুটা কমলো। পরে আবার ব্যথা বাড়ছে। এক্স-রে রিপোর্ট এলো। ডাক্তার জানালেন, ক্রিটিকাল স্টেজ। অনতিবিলম্বে অপারেশন না করালে অবস্থা সঙ্গীন হতে পারে।
ওই চিকিৎসক নিজে সার্জন নন। অপারেশনের জন্য কোনো বড় হাসপাতালে নিতে হবে।
তেমন কোনো বিরাট ঘটনা নয়। এপেনডিসাইটিস-এর অপারেশন হলেই ক’দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু মোনায়েমের বৈরী দুঃশাসন এই সামান্য চিকিৎসাকেই কঠিন জটিল করে তুলল।
মায়ের তখন হাহাকার। কেমন করে হাসপাতালে ভর্তি করানো হবে? মোনেম চক্ষুশূল হতে কেউই রাজি নয়!
যত দেরি হচ্ছে, টেনশন বাড়ছে। হাসু যন্ত্রণায় নীল হচ্ছিল। কিছু একটা করা প্রয়োজন। কন্যাটির চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছিলেন আম্মা। তিনি ছটফট করছিলেন। অবশেষে ওয়াজেদ সাহেবের দৌঁড়াদৌঁড়িতে সুফল মিলল। সদাশয় এক সার্জনের সাহসী ভূমিকায় ঢাকা মেডিকেলের এক কেবিনে ঠাঁই মিলল। সে যাত্রা ভালোয় ভালোয় পেল রক্ষা।
হাসু না হয় জানে বাঁচল। কিন্তু মায়ের বাঁচোয়া কোথায়। তিনি যে অকুল সাগরে পড়েছেন। সেখান থেকে রেহাই মিলবে কীভাবে! ওরা আব্বাকে নামকাওয়াস্তে বিচার করে ফাঁসিতে লটকাতে চাইছে। কিন্তু মাকে বিনা বিচারেই জীবন্ত মেরে ফেলার উপক্রম। যে অর্থ দৈন্যের মুখে তিনি পড়লেন। এই বৈতরণী পারের উপায় কি! কপালে যাই থাকুক, তিনি যদি মামলাটা অন্তত চালিয়ে নিতে না পারেন তবে তার স্বস্তি কই! তার পাশে যে তখন কেউ নেই। তিনি আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলেন। আইয়ুব মোনেম চক্র প্রহসন বেশ সাবলীলভাবে এগিয়ে নিচ্ছিল।
রাজসাক্ষীরা পিন্ডির তোতাপাখি। ওরা মুখস্থ সংলাপ যাত্রাপালার সঙ-দের মত আউড়ে যাচ্ছিল। জেরায় কল্পনাকে হার মানানো গল্প ফাঁদছিল। সে সব গালগল্প খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছিল। সার্বিক হালহকিকত দেখে ওরা প্রমাদ গুনছিল – মিথ্যার এই রঙিন ধূম্রজালে শেষ পর্যন্ত সত্য না হেরে যায়।
আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে আম্মাও কোমর বেঁধে লড়াইয়ে নামছেন। দুঃসময়ে হাসুরা স্বজন চিনেছিল। জেনেছিল – সুসময়ে যারা পাশে ছিল দুঃসময়ে তারা কত দূরের! মায়ের পাশে বলতে গেলে তখন হোমরা চোমরা কেউ নেই।
সত্যি! কি কপাল নিয়েই না জন্মেছিল ফজিলাতুন্নেসা রেনু। স্বামীর দুঃসময়ে একাই করাচি পিন্ডির রক্তলাল চক্ষুর বিরুদ্ধে নীরবে কঠিনতম লড়াইটা লড়ে গেছে। তারপর স্বামীকে বের করে আনবে যখন – মৌমাছির মতো মৌ-লোভীরা সবাই এসে জুটবে।
বাবা তো দিব্যদৃষ্টির ঋষি ছিলেন; বাংলা ও বাঙালির ভবিষ্যত গণনা তার নির্ভুল ফলেছে। কিন্তু প্রিয়তমা স্ত্রী’র এই বাংলা-কপালের কথা কি তিনি জানতেন! কোনোদিন কি ফুরসত হয়েছিল সেদিকে এক নজর তাকানোর! হয়তো হয়নি! আর এভাবেই চিরন্তন বাঙালি নারীরা নীরবে সর্বস্ব দিয়ে গেছেন। নিজে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃস্ব হয়েছেন, কেউ তাদের খোঁজ আর রাখেনি।
মায়ের জন্য বড্ড কান্না পাচ্ছে হাসুর। মায়ের দুঃখ-কষ্ট মায়ের পাশে থেকে বাস্তব চোখে সে দেখেছে। তখন বলতে গেলে ৩২ নম্বর বাড়ির অন্নসংস্থানই ঠিকভাবে হতো না। ডাল-ভাত, সামান্য তরিতরকারি-কোনোভাবে দিন গুজরান হচ্ছিল। বাবা তার সকল সম্পদ বাংলার হৃদয়ে সঞ্চিত রেখেছিলেন। ব্যাঙ্ক একাউন্ট, ঘরে কানাকড়িও ছিল না। তারপরও গ্রামের বাড়ি থেকে যা সামান্য আয় তাও বাবার মামলার খরচে কর্পুরের মতো উবে যাচ্ছিল।
চরম অর্থদৈন্যে মা হিমশিম খাচ্ছেন। আগরতলা মামলা দিনকে দিন জটিল আকার নিচ্ছিল। মিথ্যা কাহিনী কেচ্ছা ফেঁদে দেশবাসীকেও বিভ্রান্ত করার চক্রান্তে লিপ্ত সরকার।
মা তার হাতের পাঁচ সব কিছু মামলার খরচপাতিতে বিলিয়ে দিয়েছেন। উকিলের খাইখরচ মেটানোর কড়িও তার কাছে নেই। মামলা আর চালিয়ে নিতে না পারলে মহাবিপদ। ওদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মামলা সাজানো সাক্ষীদের কিসসামালায় বর্ণময় হয়ে উঠেছে। দিনের শেষে কী হবে ঘোর অনিশ্চিত। কিন্তু নাটকের শেষ দৃশ্যের আগেই টাকার অভাবে উকিল সরে দাঁড়ালে এ পর্যন্ত সকল শ্রম-ঘামই যে পণ্ড। সে উপক্রম যে হয়নি তা নয়।
উকিলের কাছে দেনা পড়ে গিয়েছিল। তিনি বেঁকে বসলেন। অনুরোধ, উপরোধে কাজ হচ্ছিল না। তিনি কোর্টে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। জানালেন, বকেয়া ফি না দিলে আর এজলাসমুখো হবেন না।
মায়ের মাথায় বাজ পড়ল। তার সকল ছোটাছুটিই নিষ্ফল। হায়, তীরে না পৌঁছেই তরী যে ডুবতে বসেছে।
ওদিকে যে দলটির হাজারো কর্মী হুলিয়া মাথায় নিয়ে সারাদেশে ফেরার হয়েও সংগঠনকে চালিয়ে নিচ্ছে সংগোপনে – তারা খবর পেলে নিশ্চয় জেগে উঠবে। কিন্তু তারও বা উপায় কী! দলের কার্যনির্বাহী পরিষদের অনেকে বিচিত্র আচরণ করছেন। মামলার ব্যাপারে সহযোগিতা করতে গড়িমসি তাদের মধ্যে। আইনজীবীদের খরচ বহনেও তাদের প্রবল অনীহা। তারা জানিয়ে দিয়েছে – কোনো টাকাপয়সা দিতে পারবে না । অর্থ যোগাড়ের পুরো দায়িত্ব আম্মার।
সে এক আগুন সময় কাটিয়ে এসেছে হাসুরা। জলন্ত কয়লার উপর দিয়েই আম্মা হাঁটছিলেন।
প্রতিদিন লড়াই আর লড়াই। নিজের বিয়ের কথা বড় মনে পড়ছে হাসুর। আম্মা যথাসময়ে সেই কাজটাও সুসম্পন্ন করেছিলেন। হাসুর জন্য সত্যিই এক বিস্ময়। ফুলশয্যায় সে তাজা টকটকে লাল গোলাপ পেয়েছিল। ডালাভরা বকুল শিউলি পেয়েছিল। সেই তো ঢের। ওরা যে তখন মরে যায়নি; ওর ভাইবোনদের সুকুমার মনের কুসুম বৃত্তিগুলো অনটনের কষাঘাতে জর্জরিত হলেও চিরতরে হারিয়ে যায়নি – এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে!
৩২ নম্বর বাড়ির শিউলি বকুলতলায় তখনও ভোরের মিঠে ঝড়ো হাওয়ায় ঝরা ফুলের সুবাস অনিঃশেষ, সেটাই বিস্ময়ের।
সেই সুগন্ধ নেবার মন ও মতি কোনোটাই আম্মার আর অটুট ছিল না। কামাল তখন বড় অস্থির; বাবার এই দুঃসময়ে, মায়ের টাকাকড়ির দৈন্যে দুর্দিনে সে কিছুই করতে পারছে না; ভীষণ মনমরা হয়ে থাকত ভাইটা। কিছু একটা করতে চায় সে। তাতে কিছু টাকা যদি আসে, অন্তত উকিল চাচার একদিনের ফিসটা যদি শোধ হয় – তারা আরেকটু যদি দৌঁড়ঝাঁপ করেন – কামাল তার অক্ষমতাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। ওরা গভীর প্রত্যাশার পানে চেয়ে বসেছিল। বিশ্বাস ছিল, মামলা যখন মিথ্যে; কিসসা যখন বানোয়াট; ভণ্ড বেঈমান রাজসাক্ষীদের দিয়ে যে গল্পই ফাঁদা হোক না কেনো, সত্যের জয় শেষ পর্যন্ত হবেই। আব্বা বেরিয়ে আসবেনই।
তারপরও আশায় যেন গুড়েবালি। না হয় ওরা আধপেটা খেয়ে চলল; না হয় ফুলের অলঙ্কারেই বাবার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে জীবনরেখার ধূলিধূসরিত পথকে সঙ্গী করল; কিন্তু টাকা যোগাড় করতে না পারায় আইনজীবীরা যদি এজলাসে যাওয়া বন্ধ করেন; বাবার জন্য আইনি লড়াই জোরদার না হয়; রাষ্ট্রপক্ষ যদি খালি মাঠেই রায়টা বাগিয়ে নিয়ে যায় – সে ভয়ংকর দুশ্চিন্তা। বড় বিষণ্ন দিন কাটছিল। হতাশ হয়ে পড়ছিল ওরা।
এমনিতেই বাবার জন্য যারা লড়ছেন, তারা কম ঝুঁকি মাথায় নেননি। রাষ্ট্র তথা পিন্ডির ফৌজি শাহী যেখানে বৈরী – সেখানে তারা পাল্টা জেরায় মিথ্যাকে খণ্ডন করে সত্যকে উন্মোচন করছেন, সেও কম নয়।
তবুও মামলা লড়তে মায়ের কাছে টাকা যোগাড় চাই। গয়না, আসবাব কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বাড়িটা হতশ্রী, ছন্নছাড়া হয়ে পড়ল। কামালের বয়স তখন কম। পড়াশুনাটা চালিয়ে নিচ্ছে বহুত কষ্টে। একদিন মায়ের কাছে প্রস্তাব এলো কামালের একটা চাকরির। আদমজীতে ছাত্রলীগের সাবেক এক বড় নেতা উচ্চপদে ছিলেন। তিনি এসে মাকে বললেন, ভাবী, আপনি বললে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করা যায়। মাসে বেতনও পাবে। ও সেখানে নামকাওয়াস্তে থাকলো।
আম্মা সবকিছু পানির মতো বুঝতেন। নামকাওয়াস্তে মানে পুরোদস্তুর চাকুরি না করেও সবেতন। তার মানে শেখ মুজিবরের পুত্রকে আনুষ্ঠানিক চাকুরি দিলে সহৃদয় কর্তার জন্যও বড় মুসিবত।
তাছাড়া তিনি কখনোই কামালের এমন চাকুরির পক্ষে ছিলেন না। পরিশ্রম ছাড়া ফুটো পয়সা নেয়ার তিনি কঠোর বিপক্ষে।
আম্মা সকৃতজ্ঞচিত্তে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, দিন খুব কঠিন যাচ্ছে সত্য। আল্লাহ নিশ্চয়ই মুখ তুলে চাইবেন।
তখন অলৌকিক কিছু ঘটার অপেক্ষা ছাড়া কোনো পথই মায়ের সামনে খোলা ছিল না। এমন একটা দিনে কামালের নামকাওয়াস্তে চাকুরির বরাতে মুফতে কিছু অর্থপ্রাপ্তির অফার তিনি দৃঢ়ভাবেই ফিরিয়ে দিলেন। যখন উকিল চাচা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বকেয়া না দিলে তিনি মজিবরের পক্ষে আর ওমুখো হবেন না। মাকে তবুও রাজি করানো গেল না।
মায়ের সেই ধৈর্য, স্থৈর্য ছিল তুলনারহিত। মা অনেক ধার-কর্জ করলেন। সে সবেরও সহজ উপায় ছিল না। গোয়েন্দারা চারদিকে গিজ গিজ করছে। একঘরে করা মুজিবপত্নীকে কেউ যেন অর্থসাহায্য করতে না পারে; কেউ যেন অমন দুঃসাহস না করে – সেজন্য ছিল সব আড়ালচোখের পাহারা। তা সত্ত্বেও খোকা চাচা, আকরাম মামা অনেক কষ্টে কিছু যোগাড় করে মায়ের হাতে দিল। আম্মা উকিলের বকেয়া আংশিক শোধ করলেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা গল্পে গল্পে খোলামখুল্লা খোলামকুচির মতো এগুচ্ছে। সাক্ষীদের গাঁজায় দম দেয়া গল্পের গরু কখনো গাছে উঠে পড়লেও রাষ্ট্রপক্ষের ডাকসাইটে আইনজীবীরা সে সব ‘সত্য’ দাবি করে কোনো লাজশরম ছাড়াই।
আম্মাকে এই সময়ে ঘর সামলে, কোর্ট কাচারির খরচ সামলে মাঠের রাজনীতির দিকেও নজর দিতে হচ্ছিল। তিনি শান্তস্বভাব চিরন্তন বাঙালি নারী। তিনি ঠিকই টের পাচ্ছিলেন কী হচ্ছে! কী হতে যাচ্ছে! আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের কিছু মুরব্বি নেতা আগরতলা মামলা ইস্যুতে গড়িমসি করছিলেন। এটা তার কাছে সুখবর কিছুই ছিল না। বরং পোড়া চোখে অন্য আলামতও তিনি অনুধাবন করতে পারছিলেন। ঘর পোড় খাওয়া নারী; সিঁদুরে মেঘ দেখে তার বিপদ আশংকায় ভুল হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আম্মা মনের কথা মনেই রাখতেন। সিদ্ধান্ত নিতেন একান্তে। তার চোখে অনেক অশ্রু দেখেছে হাসু। কখনও কিছুটা অস্থিরমতি হতেও দেখেছে তাকে। এটা তার বাইরের রূপ। ভেতরটা ইস্পাত। তিনি জানতেন কখন কোন কাজটা করতে হবে।
বাবার সঙ্গে হাসুর আবেগের গভীরতা যেমন ছিল, মায়ের সঙ্গেও কম নয়। তাকে খুব ভাল বুঝতে পারত। এই বোঝাবুঝিটা ছিল অন্তরে অন্তরে। মায়ের কষ্ট, দুঃসহ লড়াই দেখে আপ্লুত হয়েছে বারবার; কিন্তু এ নিয়ে দু’জন মুখ ফুটে তেমন কিছু বলেনি। তিনি এতটাই কর্মপটু ছিলেন; কন্যা-পুত্রের মুখাপেক্ষী কখনো ছিলেন না। তিনি কাজ করতেন নীরবে। আইয়ুবের সাক্ষীদের জেরার নানা গালগল্প যতই পত্রিকার ছাপা হচ্ছিল, ওদের অজান্তেই তা বুমেরাং হচ্ছিল। মানুষ হুমড়ি খেয়ে তা পড়ত। একজন পড়ত, বিশজন তা দাঁড়িয়ে শুনত। পিন্ডির লোটা কম্বলধারীরা চাইছিল – পাবলিক এসব গল্প গ্রোগ্রাসে গিলুক। বিশ্বাস করুক। মুজিবকে ধিক্কার দিক। মুজিবের চরিত্র হনন হবে তাতে। আর সেই সুযোগে আইয়ুব ফাঁসিতে লটকাবে মুজিবকে। মুজব খতম। ৬ দফা, পূর্ব বাংলার দাবি-দাওয়া, স্বাধীকার সেখানেই খতম।
গর্দভের স্বর্গে বাস করছিল ওরা। পিন্ডিতে বসে চোখে দানব চশমা লাগিয়ে ওরা দেখতে পাচ্ছিল কল্পনার নানা ফোয়ারা; তাতে ফূর্তির মৌতাতে মদপেয়ালায় আত্মপ্রসাদের ঝড় উঠলেও বাস্তব হাওয়া বইছিল ঠিক উল্টো দিকে।
মা খবর পাচ্ছিলেন, ওরাও জানতে পাচ্ছিল – পিন্ডির পাতানো, সাজানো গল্প বাঙালি মোটেই বিশ্বাস করছে না। সংগোপন সংবাদপাঠ-শ্রুতির আসরে ধিক্কার উঠেছিল পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। দিন দিন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে সকলে।
কিন্তু এই প্রতিক্রিয়াগুলো সবই বিচ্ছিন্ন। আম্মার ভয় শঙ্কা সেখানেই। এই সব টুকরো টুকরো প্রতিক্রিয়াকে এক সূতোয় না বাঁধতে পারলে বুঝি মহাবিপদ থেকে রেহাই নেই!
দর্পনেশায় বুঁদ জালিমরা শনৈ শনৈ গতিতে তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে এগুচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মুরব্বিদের একটি অংশ ঝিমুচ্ছে। আইয়ুবকে কড়কে দেয়ার মতো উদ্যম ও যৌবন আর তাদের রক্তে নেই। হুলিয়া, গ্রেফতারি পরোয়ানা, রাতে খানাতল্লাশিতে ঘরছাড়া ত্যাগী কর্মীদের কেমন করে সংগঠিত করা যায় – সে সবের কোনো উদ্যোগই দেখা গেল না।
দেখি না কী হয় – এই অবশ বিবশ আলস্যে দিন কাটছে ঘরকুনো মুরব্বিদের। মা কখনোই সরাসরি রাজনীতিতে ছিলেন না। ঘর-চৌহদ্দির বাইরে তিনি নাক গলাতেও চাননি। কিন্তু যখন দরকার,যখন তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, পিছপা হননি তিনি।
অন্যরা তখন আপন গৃহকোণে নিরাপদ স্বস্তি খুঁজছে; সেই চরম ঝুঁকিপূর্ণ মুহূর্তে আম্মা নজর দিলেন বাইরে। বললেন, আর দেরি করলে চলবে না। ওরা যদি তোর বাবাকে একবার ফাঁসিতে ঝোলাতে পারে, আমি না হয় শাদা থান পরবো। কিন্তু তখন বৈধব্য পেয়ে বসতে পারে সারা বাংলাকেও। তোর বাবা ৬ দফা দিয়েছেন, এখন এটার চূড়ান্ত বিজয় না হলে বাংলা ও বাঙালির চরম বিপদ। হয় জয়, নয়তো ঘোর বিপর্যয়। শেখ সাহেবকে এখন পূর্ব বাংলার জন্য প্রয়োজন। তার মুক্তি বাঙালির বিজয়ের জন্য দরকার। বাঙালির পাশে শেখ সাহেব ছাড়া কেউ নেই। এটা এখন পরিষ্কার। তাই তাকে মুক্ত করতে হবে।
বাঙালি জেগে উঠতেছে। এই জাগ্রত জাতিকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেয়ার মতো মানুষ ঐ একটাই। অন্যরা যেভাবে ঝিমুচ্ছে, তাতে শেখ মুজিব যদি ক্ষুদিরামের মতো হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি গলায় দেয় – অন্যরা সেই আত্মত্যাগকে কাজে লাগিয়ে বাঙালির দাবি আদায় করতে পারবে কি না সন্দেহ। বরং মিউ মিউ করে বলবে – ওই কাজ করতে তারে কে বলছে!
বাকসংযমী মায়ের সেইসব কথা সেদিন বিস্মিত চিত্তে হাসু শুনত। আজও সে বিস্মিত হচ্ছিল, সেইসব কথা ভেবে। আশ্চর্য সেই নারী; নিজের মা বলে স্বজন সন্তোষে তাকে মহিয়সী মহান ভেবে আত্মশ্লাঘায় উদ্বেল হয়নি সে। সব সময় বলতে গেলে তার আঁচলে স্নেহবন্দি ছিল; আজ এখন সুদূর থেকে সেই সোনার অতীতের দিকে তাকাচ্ছে – এখন বুঝতে পারছে, কাছের দেখায় কত দৃষ্টিহীনতায় তখন ভুগছিল, সত্যিই কি বিস্ময়! তিনি সেই নারী; যিনি বৈধব্যের শাদা শাড়ি পরতেও ছিলেন দ্বিধাহীন; স্বামীর আত্মদানে যদি বাঙালির হয় জয় – তিনি সেই আত্মত্যাগেও ছিলেন অকুণ্ঠিত। কিন্তু তার অভিজ্ঞ দিব্যদৃষ্টি যখন অনুভব করল, সেই মহান ত্যাগ নাও বয়ে আনতে পারে মহাকাঙ্ক্ষিত বাঙালির অর্জন; বাঙালির তখন তার চেয়েও বেশি দরকার বজ্রব্যক্তিত্ব জীবন্ত মুজিবকে। ৩২ নম্বর বাড়ির চৌকাঠ না পেরিয়েই আম্মা তার কর্মপরিকল্পনা এঁটে ফেললেন। মুজিবপত্নী কি করেন, তার গতিবিধি, কর্মকাণ্ড জানতে শত গোয়েন্দার নজরদারিতে ছিল – আম্মা তা জানতেন। তাকে কিছু করতে দেয়া হবে না, তাও জানতেন। কিছু করতে হলে তাকে এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই করতে হবে।
সময় বয়ে যাচ্ছিল। পিন্ডির ষড়যন্ত্রকে কেমন করে জব্দ-পরাস্ত করা যায়! ওদেরই আজ্ঞাবহ আইন আদালতে মুজিবের সুবিচার আদৌ মিলবে কিনা – আম্মা সন্দিহান। রাজসাক্ষ্য যতই মিথ্যা ও কল্পনাপ্রসূত হোক – তা সানন্দে হচ্ছিল গৃহীত। রেনুকে কিছু একটা এখন করতেই হবে! আদালতের সাজানো রায়ের অপেক্ষায় থাকলে আর চলবে না। পিন্ডি যদি সফল হয়, চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যাবে বাঙালি মুক্তির স্বপ্ন। সেই বৈরী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে মা কিন্তু মায়ের জায়গাতেই থাকলেন। তিনি ছিলেন প্রস্তুত। যাই হোক, তাকে শেষটা দেখতে হবে। বললেন, ঘরে বসে থাকলে চলবে না। আইয়ুবের রক্তচক্ষুকে ভয় পেলে চলবে না। যা করবার এখুনি সময়।
আইয়ুব তখন মার্শাল ল’র ভয় দেখিয়েই ক্ষান্ত নন। নানা ভয়ভীতি রটিয়ে, পাঞ্জাবি খান সেনাদের নিয়ে গালগল্পর ফোয়ারা ছুটিয়ে নির্বাক, বাদ প্রতিবাদহীন একটা শাহী কায়েম করে চলছিল; খানসেনাদের সাত খুন মাফ। ওরা যদি একজন সাতটা লাশ ফেলে দেয় – পাকিস্তানে কোনো আইন নেই তার বিচার করে। খানসেনারা বিচারের ঊর্ধ্বে। ওরা চাইলে পাখির মতো মানুষ মারতে পারবে। যদি কেউ তার বাসাবাড়ির সামনে ময়লা পরিষ্কার না করে, গাছের ঝরা পাতা কুড়িয়ে পরিষ্কার না রাখে, খানসেনা এসে বিনা বিচারে গুলি করে দিতে পারবে। ওদের কথাই আইন। ওদের ইচ্ছাই আইন। স্কুলে কলেজে বাচ্চাদের মনে এইসব ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাচ্চারা ভয় পেলে বাঙালি একটা ভীতু কাপুরুষ জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে। খানসেনাদের ভয় পাবে। তাই ওরা স্কুল-মাদ্রাসার কোমলমতি শিশুদের টার্গেট করেছিল।
চারদিকে ভয় ছড়িয়ে পড়ছিল। কী এক অদ্ভুত কারণে মাদরাসাগুলোতে খানসেনাদের ঘিরে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছিল। খানসেনারা বাঙালি মারলে যেন তাদের বড় আনন্দ। এর একটা বড় কারণ হলো – মাদ্রাসায় আরবির পাশাপাশি উর্দু কেতাব পড়ানো হচ্ছিল। যে কারণে মাদরাসা ছাত্ররা নিজেদের বেশি পাকিস্তানি মনে করছিল। উর্দু টুকটাক বলতে পারাটা তারা বেশ স্টাইল করে নিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে কাজটা সহজেই সম্ভব হচ্ছিল। কিন্তু পূর্ব বাংলায় এই জ্বী হুজুরের তাসের দেশ প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়ছিল। উর্দু-চামচাদের সংখ্যা বড়ই কম। জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম উর্দু জবান চালুর জন্য বেশ কাজ করে যাচ্ছিল।
জামাতে ইসলামীর ছিল ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘ। এরা বেশ উর্দুপন্থী কাজ করছিল। বলছিল, পাকিস্তানকে হিন্দুস্থানের হাত থেকে আযাদ রাখতে হবে। শেখ মুজিব হিন্দুস্থানের চর। গোলাম আযম চুপি চুপি কাজে ব্যস্ত। সেও পাকিস্তানের জন্য জান লড়িয়ে দিচ্ছিল। সে তত্ত্ব দিয়ে বেড়াচ্ছে – মুসলিম মিল্লাতের জন্য নিজস্ব ভাষা চাই। উর্দু জবানটা বেশ মিঠা লাগে। দিল খোশ হয় মাশাল্লাহ। গোলাম আযম আইয়ুবশাহী আর মোনেমশাহীর পায়বরীতে বেশ পারদর্শিতা দেখাচ্ছিল।
চামচা গভর্নর মোনায়েম খাঁ ক্রমশই বেসামাল। সে ছিল আইয়ুবের চেয়েও এক কাঠি সরেস। কিস্তি টুপির নিচে তার মাথাটা গোবরে উর্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র আন্দোলন যাতে দানা বাঁধতে না পারে সেজন্য গুণ্ডাপাণ্ডা পোষা হচ্ছিল। যা তখন রীতিমত ঘৃণ্য ব্যাপার। রাতে মদ খেয়ে প্রকাশ্যে মাতলামি করে দম্ভ দেখাতে পিছপা হয়নি এনএসএফ-এর গুণ্ডারা। এদের সঙ্গে ফেউ জুটেছে গোলাম আযমের জামাতে ইসলাম আর ছাত্রসঙ্ঘ। ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন মানে এনএসএফ ডান্ডাবাজি করলে ছাত্রসঙ্ঘ সেখানে হুলু দেয়। তাদের মিল্লাতে পাকিস্তান দোস্তির খুশি দেখে কে!
মোনেম খাঁর দুই সুপুত্তুর। পাঁচ পাত্তুর ত্রাস ছড়িয়ে রীতিমত মশহুর। এদের আতঙ্কে সাধারণ ছাত্ররা তটস্থ। ছাত্রলীগ ওই হকিস্টিক ডান্ডাগুণ্ডাদের মোকাবেলায় শক্ত প্রতিরোধ তখনও গড়ে তুলতে সফল হয়নি। হুলিয়া, এনএসএফদের ডান্ডা-গুণ্ডামি তাদেরকে ফেরারি করে রাখছিল। ছাত্রসঙ্ঘ তখন ছায়া আততায়ীর কাজ করছিল। মোটেই বেড়ে উঠতে পারছিল না গোলাম আযমের এই পয়দা। তাই গোপন নেটওয়ার্ক তারা গড়ে তুলতে শুরু করে। কোথায় কে আওয়ামী লীগ – কোথায় কোন ছাত্রলীগ নেতা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে – ছাত্রসঙ্ঘ তার তালিকা বানানো শুরু করে। প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার শিক্ষক-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের তালিকা বানানো শুরু করে। এদের জন্ম ও বিকাশ এই অপতৎপরতার মধ্যে দিয়ে। সংখ্যায় কম। কিন্তু গোয়েন্দা নেটওয়ার্ককে গোলাম আযম ছাত্ররাজনীতির মধ্যে ভয়ংকর বিষ হিসেবে বপন করে। আধুনিক চিন্তার মানুষকে এই হিংস্র আততায়ীরা তালিকাভুক্ত করতে শুরু করে।
গোলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। পরে সে রংপুরে গিয়ে কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতাও করে কিছুদিন। নিজেকে মহাদার্শনিক হিসেবে তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রচার চালায়। ভীতিভয়ংকর সব দর্শন। পাকিস্তানের ফৌজীশাহীর পায়বরির নানা দর্শন। তারা টার্গেট করে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোর আধুনিক-প্রগতিমনস্ক মানুষকে। গোলাম আযমচক্র তার ক্ষুদ্র পরিসরে তত্ত্ব দেয় – গাছের বীজতলাকে খতম করো। বীজতলায় বীজ রোপন করতে দিও না। কারা বীজ রোপন করছে তাদের নজরদারিতে রাখো। এদের চিরতরে খতম করতে হবে। তাহলে কোনোদিন বটবৃক্ষের জন্ম হবে না। এখন তালিকা চলুক। যখন সময় সুযোগ আসবে তখন আক্রমণ। কতল আর খতম ছাড়া মুসলিম মিল্লাত রক্ষা করা যাবে না।
এই সময়টাতেই মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে সক্রিয়ভাবে মাঠে মেনে পড়ল হাসু। মা বলছিলেন, যে সব বড় নেতা ঘুমুচ্ছে, ঘুমাক। কিন্তু ছাত্রদের জাগিয়ে তুলতে পারলে সবাই দেখবি জাগবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সারাদেশেই ছড়িয়ে। ওদের মুখে মুখে দেশের মানুষের কাছে খবর পৌঁছে যাবে। এই ছাত্রদের মাধ্যমে সারাদেশে মানুষকে সংগঠিত করা দরকার।
মায়ের রাজনৈতিক লজিকের মধ্যে কোনো ঘোরপ্যাঁচ ছিল না। তিনি বললেন, তোফায়েল, রউফ, খালেকদের আমার আহ্বানটা পৌঁছে দে। আগরতলার বানোয়াট গল্প বাঙালি বিশ্বাস করছে না। পিন্ডির সব জারিজুরি মানুষের কাছে ফাঁস হয়ে গেছে। এখন এই মানুষকে এক করতে হবে। সংগঠিত করতে হবে ছাত্রদের। মিথ্যা আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার এখনই সময়। ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে সাধারণ মানুষও বসে থাকবে না। আইয়ুবের তখতে তাউস আপনাআপনি ভেঙে পড়বে। ওর মার্শাল ল’র আতঙ্ক পায়ে মাড়িয়ে মানুষ কাতারে কাতারে ঘর থেকে বেরুবে। ও তখন পাততাড়ি গুটিয়ে পালাবে।
আম্মাও কি তখন দিব্যদৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিলেন? তিনি তো ঘাঘু পলিটিশিয়ানের মতোই যখন যা করণীয় বাতলে দিচ্ছিলেন!
পুলিশ টিকটিকির চোখ এড়িয়ে এনএসএফ গুণ্ডাদের পাহারার মাঝে ছাত্রনেতাদের খুঁজে বের করা কি সহজ কথা! ওয়াজেদ সাহেব ছিলেন সঙ্গে। সাত আট দিন এ হলে ও হলে খুঁজল হাসু। সংগোপনে কাজটা সারছিল। কিন্তু তাদের নাগাল পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। একদিন খবর পাওয়া গেল, রউফ সাহেব ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির একটি হলে রয়েছেন। ওয়াজেদকে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করল। আম্মার কথা তাকে জানানো হল। ওয়াজেদ তাকে বললেন, এটা তার শাশুড়ির বিশেষ আহ্বান। সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে না পারলে শেখ সাহেবকে মুক্ত করা যাবে না।
রউফ তখন ওয়াজেদের দু’হাত জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করলেন, বেগম মুজিবের নির্দেশনা তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। জানালেন, হুলিয়া মাথায় নিয়েও ছাত্রনেতারা সারাদেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে তৎপর, ক্যাম্পাসেও ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। সমমনাদের এক প্লাটফর্মে আনার জোর চেষ্টা চলছে। অচিরেই তারা বেগম মুজিবকে সুখবর দিতে পারবেন।
বাসায় ফিরে এসব কথা মাকে সবিস্তারে জানাল। তিনি হালে একটু পানি পেলেন যেন। আবারও বললেন, ছাত্র তরুণ যুবকদের জাগিয়ে তোলা দরকার। যেভাবেই হোক – আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে। তুই আর জামাই এ নিয়ে পড়ে থাক। অন্যদেরও খুঁজে বের কর। আল্লাহ আছেন অত্যাচারিতদের পাশে। তিনি মুখ ফিরিয়ে নেবেন না। এখন ছাত্রনেতাদের সাহস ও তাগাদা দিতে হবে। তারপর দেখ – কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়! বুড়িগঙ্গায় তখন অঢেল পানি গড়িয়ে যাচ্ছিল। ধানমণ্ডির লেকের সঙ্গেও পানি প্রবাহের সংযোগ ছিল।
চারপাশের স্থবিরতা, আতঙ্ক, নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ হয়নি ওরা। আম্মা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আশাবাদ শুনিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কথা – এই ভাটা দেখে উদ্বেগের কিছু নেই। যখন জোয়ার আসবে। তখন দুকূল ছাপিয়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ওদের শেষ রক্ষা হবে না।
বাইগার নদীর জোয়ারভাটা স্রোত-ছন্দ দেখেছেন জন্মের পর থেকেই। বাইগারের পানির কাছে গিয়েছে হাসুও অনেকবার। টুঙ্গিপাড়ার সেই ছবিল নওল নদীতে কখনো জলোচ্ছ্বাসের প্রবল উত্থান ঘটেছিল কিনা, কোন কালে; মা স্মৃতি হাতড়ে হয়তো বলতে পারতেন। কিন্তু তখন দিন এমনই – এসব নস্টালজিক প্রশ্ন করার কোনো ফুরসত মেলেনি।
জল যে কেবল বাইগার-বুড়িগঙ্গাতেই গড়িয়ে যাচ্ছিল, তাই নয়। সূদুর টেমস নদীতেও তখন আলোড়ন; সে কথা যখন জানল, সত্যিই অভিভূত হয়েছিল ওরা। হঠাৎই জেনেছিল সুসংবাদ। তখন ডিসেম্বর। ঢাকায় শীত নেমেছে জাঁকিয়ে। এমন সময় মুজিব ভক্তদের মাঝে উত্তাপের সঞ্চার হলো। সবাই আশান্বিত হয়ে উঠল। শোনা গেল – বৃটিশ এমপি স্যার টমাস উইলিয়াম আসছেন। বাবার পক্ষে তিনি থাকবেন। লন্ডনের নামজাদা ল’ইয়ার। তার সামনে দুঁদে ক্রিমিনাল ল’ ইয়াররা নস্যি। ওরা আশায় আশায় রইল। মা শুকরানা নামাজ আদায় করলেন। তার মুখেও আশার ঝলক দেখা গেল। বললেন, যখন দিন আসবে, সুখবর আসবে ফের। আল্লাহ যখন দেবেন, অঢেল, অফুরন্ত দেবেন। যার নিয়ত মজবুত; তিনি তাকে কখনোই ঠকান না।
৬ দফা নিয়ে লন্ডন আমেরিকাতে জেগে উঠছিল প্রবাসী বাঙালি। সেখানে পড়াশোনা করছে যেসব ছাত্র – তারা আত্মপরিচয়ের তাগিদেই সংগঠিত হয়েছিল। ৬ দফা বাস্তবায়ন, আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সোচ্চার দাবি উঠল সেখানে। জনমত তৈরি হতে লাগল। ছাত্র-প্রবাসী-বাঙালিরা এক হয়ে চাঁদা তুলে স্যার টমাসকে পাঠাল। বাবার কৌঁসুলিদের পরামর্শ ও আইনি সহায়তা দিতে তিনি এসে পৌঁছালেন। আইয়ুবের চামচারা তাকে কোর্টশিপে বিরত রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু ঝানু বিলাতি উকিল। তাকে আটকালে লন্ডন-আমেরিকায় মার্শাল ল’ সরকারের ক্যারিকেচার নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠবে। উভয় সঙ্কটে পড়ল পিন্ডি।
উইলিয়াম কোর্টে গেলেন। রাজসাক্ষী ও সরকারি কৌঁসূলিদের বক্তব্য খণ্ডনে জোরদার যুক্তি রাখলেন।
আগরতলা মামলার পালে নতুন হাওয়া লাগল। বৃটিশ উকিল আসায় সাধারণ মানুষ উচ্ছসিত হয়ে উঠল। এবার আর মুজিবকে আটকে রাখা যাবে না। ভুয়া মামলা আর পাতানো সাক্ষ্য-সাবুদের আইয়ুবি চাল বিশ্ববাসী জেনে গেছে। শেখ সাহেবকে এখন ফাঁসিতে লটকায় কেমনে দেখি!
মায়ের মিশনে হাসুও তখন থেমে নেই। ওয়াজেদ এবং সে ক্যাম্পাসে যতটা সম্ভব ছুটে চলেছে। ওরা টের পাচ্ছিল, সময় বদলাচ্ছে। যেখানেই যায় – সাধারণ ছাত্রদের মুখে আইয়ুব মোনেমের বিরুদ্ধে ধিক্কার। ঘৃণা বাড়ছে।
মা সব খবর রাখছিলেন। তাকে টাইম টু টাইম ওয়াকিবহাল করা হচ্ছিল। তিনি তখনো মামলার যাবতীয় খরচ মেটাতে হিমশিম। টমাস উইলিয়াম যে ক’দিন ঢাকায় ছিলেন, থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করতে হলো তাকেই। আম্মার হাতে যাদু ছিল নিশ্চয়ই। তিনি সংসার ব্যবস্থাপনায় ম্যাজিক জানতেন। অতি অল্প টাকাও তার হাতের ছোঁয়ায় অঢেল হয়ে উঠত। সেই টানাপড়েনের দিনের কথা, টাকা-পয়সার সঙ্কটের কথা একবার তার কাছে জানতে চেয়েছিল অনেক দিন পরে। বাবাও ছিলেন কাছে। মা কিছুই বলেননি জবাবে। বাবা হাসলেন। বললেন, ওটা রেনুর যাদু টাদু কিস্যু নয়। তোর মা প্রতিটি পয়সার দাম জানে। একটা সিকি, আধুলিও কখনো অপচয় করেনি। অপচয় রোধ করা গেলে সিকি আধুলি জমিয়েও অনেক হয়। মা তখন সেখান থেকে সরে গেছেন। বাবার প্রশংসায় তিনি সব সময় আড়ষ্ট হয়ে পড়তেন।
খাবারের টেবিলেও আম্মার হাতের যাদু দেখেছে অনেকবার। অল্প খাবার, অল্প তরিতরকারি – অথচ সবাই খিদে মিটিয়ে খেয়ে উঠেছে। মায়ের এই যাদুর রহস্য হাসু জানত। মেয়ে হয়ে মায়ের খবর জানবে না, তা কি হয়! তিনি ওদেরকে খাইয়েছেন ঠিক, কিন্তু নিজের উদরপূর্তি আর হয়নি। কখনো আধপেটা খেয়েও সহাস্যে বলতেন, বেশ খেয়েছি।
বড় হয়ে যখন এসব টের পেল। মায়ের খাওয়া চোখে চোখে রাখত বড় কন্যাটি। তিনি মচকাবার মেয়ে নন। হাসুকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন, বেশি বেশি খেলে কত যন্ত্রণা। দিন দিন কেমন মুটিয়ে যাচ্ছি। যত ভোগ; তত রোগ।
একদিকে পার্টি , বাবার মামলা; আরেকদিকে সংসারের টানাপড়েন সামলাতে স্লিম হতে মায়ের তখন কত সাধনা! হালকা পাতলা ছিপছিপে গড়নের মাকে তখন কত দিকে নজর রাখতে হচ্ছিল।
১৯৬৯ সালটা বাংলার রাজনৈতিক আকাশে প্রবল ঝড় ঝঞ্ঝার আভাস দিয়েই শুরু হয়েছিল। মুরব্বি রাজনীতিকদের নিষ্ক্রিয়তা তারুণ্যর জোয়ারকে স্তিমিত রাখতে পারেনি। যে দুর্বল নিভু নিভু সলতের মুখে তেলের স্পর্শ দিতে পাঠিয়েছিলেন মা, তা রাতারাতি স্ফুলিঙ্গের রূপ নিতে লাগল। গঠিত হলো সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের উভয় অংশ। ডাকসু নেতারা যুক্ত হলেন তাতে। ৬ দফা বাস্তবায়ন ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিসহ ছাত্রনেতারা দিলেন ১১ দফার ইশতেহার। ৬ দফায় বাঙালির বাঁচা ও জীবনের ডাক; এবার ১১ দফায় ছাত্রদের ভয় ভাঙানোর গান।
এই গানে যদি ভয় ভেঙে যায়; তাহলে আর কারোরই ঘুমিয়ে থাকার উপায় থাকবে না। আগরতলা ও মুজিব মুক্তির প্রশ্নে যারা নিশ্চুপ; তাদের রাজনীতি যাবে রসাতলে – ক্যাম্পাসে গেলেই স্ফুলিঙ্গের ওম বেশ টের পাচ্ছিল। ছাত্র আন্দোলনের নবতর ঢেউ গ্রামেগঞ্জে জনতার হৃদয়ে নাড়া দিলে তা অভূতপূর্ব কিছু হবে – তার ইঙ্গিত মিলছিল। সবে তখন শুরু। তাতেই তারুণ্যের অপূর্ব ছন্দের দোলা। কিন্তু উটপাখি মুরুব্বিদের সেই ঝড়ের দিনেও হুঁশ নেই। আওয়ামী লীগেরই যিনি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মিজান চৌধুরী; তিনি এই মোক্ষম মুহূর্তে একরকম ভুল করে বসতে চলেছেন। ১১ দফায় সমর্থন জানাতে তিনি নিমরাজি। ছাত্রদের কাছে গররাজির খবর পৌঁছতে সময় লাগল না।
একদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে তিনি তোপের মুখে পড়লেন। ১১ দফায় তার দ্ব্যর্থহীন সমর্থন আদায় করে ছাড়বেন ছাত্রনেতারা। তিনি দোনোমনা করছিলেন। আর যায় কোথায় – ছাত্রদের হাতে তিনি লাঞ্ছিত হতেই বসেছিলেন। অল্পের জন্য রক্ষা পান। ওয়াজেদ সাহেব ছিলেন সেখানে। ছাত্রদের শান্ত করে মিজান চাচাকে অন্যত্র নিয়ে যান।
পরদিনই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতারা এ নিয়ে কথা চালাচালি শুরু করে দিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের মস্কো-পিকিং উভয় অংশই বললো, ১১ দফা প্রশ্নে পূর্ণ সমর্থনের গ্যারান্টি চাইছে তারা। কীভাবে সেটা সম্ভব! কার কথাকে তারা গ্যারান্টি বলে মানবেন!
অন্য কেউ নয়; চাই স্বয়ং শেখ সাহেবের সমর্থন।
তার সমর্থন অবশ্যই থাকবে। তার সমর্থন অবশ্যই রয়েছে। মুখের কথায় বিশ্বাস করি না। ইউনিয়ন নেতাদের সাফ কথা। আশ্চর্য, বাবা সমর্থন দেবেন না, ভাবাই যায় না। হাসু প্রদীপ্ত কণ্ঠে জানাল। সমর্থন আছে থাকবে ইত্যাদিতে তাদেরকে শান্ত করা গেল না। তারা পরিষ্কার ওয়াদা চাইছেন। সবারই জানা, ছাত্রদের নাড়ির স্পন্দন একমাত্র শেখ মুজিবই বুঝবেন। তার সম্মতি পেলে অন্য কিছুর পরোয়া তারা করেন না। তারপরও চাই, প্রত্যক্ষ সমর্থন।
কিন্তু শেখ সাহেবের সমর্থনের বিষয়টা কেমন করে তাদের কাগজে কলমে বিশ্বাস করানো যায়। সে যে কঠিন কাজ। হাসু জানে, আব্বা আছেন ১১ দফার সঙ্গে। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ন্যায্য দাবি মাত্রেই আব্বা থাকবেন – তা দিব্য সত্য এবং সেটা জানা আছে সকলের। তারপরও অনাহুত অবিশ্বাসের সঙ্কট। এই সমস্যা ভীমরতির কাপুরুষ নেতাদের জন্য। তারা ভয়ে মেনীমুখো। কিন্তু এই অবিশ্বাস; সেটা মোচনের পথ কোথায়!
আইয়ুব খানের টাল্টি বাল্টির নানা নকশা চলছে। পিন্ডিতে বসে পাকিস্তানের পিন্ডি চটকাচ্ছে আপন সুখে। তখতে তাউসের বিলাস আনন্দে দিওয়ানা। সদরে পাকিস্তান। তখতের বালাখানাকে পোক্ত করতে নিত্য নতুন পাশা খেলায় মত্ত। রাতারাতি এস্তেমাল করা লিয়াকতী সংবিধান খানাও ফৌজি ফরমানে নাপাক হয়ে পড়েছে। সেটা কাটাচেরায় ক্ষতবিক্ষত। মাতাল মত্ত বাদশাহী মেজাজে বুনিয়াদি জমহুরিয়ার যে প্রবর্তন – তাও বাতিল গনিমতের মাল হতে চলেছে। জানুয়ারির ঘন শীতে একটু একটু রাজনৈতিক উত্তাপ। ৮ দলের ঐক্য’র ডাক এলো ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি, ডাকের তরফে। তাতে আওয়ামী লীগও যুক্ত রয়েছে। কিন্তু ছাত্রদের ১১ দফা ডাকে সাড়া দিলো না ‘ডাক’। ছাত্রনেতারা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, ক্ষিপ্ত।
কমজোর শম্বুক গতির ভীরু নেতাদের আর ছায়া মাড়াতে চাইছে না তারা। কিন্তু মুজিব যে সঙ্গে আছেন, সে বিশ্বাস সকলের। তদুপরিও শক্ত ভিত্তি চাই সেই বিশ্বাসের। বিশেষ করে দুই ছাত্র ইউনিয়নকে বিশ্বাস না করানো গেলে বড়ই মুশকিল। ছাত্রলীগের তিন কাণ্ডারি – রউফ, খালেদ, তোফায়েল দুশ্চিন্তায় নাকাল। কী করা যায়?
ক্যাম্পাসের মধ্যে ইকবাল হলের পুকুর পাড়টা বেশ নির্জন। নারকেল বীথি। তার পাশেই কাঁঠাল গাছের নিবিড় ছায়া। পুকুরের জল কখনো প্রশান্ত। স্থির। আবার হালকা হাওয়ার থির থির করে কাঁপুনি। শীত কুয়াশায় কাবু জনজীবন। পশ্চিম পাড়ে ঝরাপাতার চত্বরে বসল বৈঠক। অনুচ্চ উচ্চারণ। অনেক অনেক আলাপ। শলাপরামর্শ শেষে লেখা হলো এক পত্র। ১১ দফার বৃত্তান্ত, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন, ৮ দল ও ডাকের অসম্মতি – ছাত্র জনতার প্রাণের দাবিতে বাবার অকুণ্ঠ সমর্থন কামনা – সব অল্প কথায় লেখা হলো তাতে। জনমানস-সরোবরে জাগছে নবজাগরণের উর্মিমালা।
এবার পত্রটি যাবে শেখ মুজিবের ঠিকানায়। কিন্তু কেমন করে ক্যান্টনমেন্টে সেটি নিয়ে যাওয়া সম্ভব! ফৌজি হাজারো চক্ষু। শান্ত্রী সেপাই, বশংবদরা আইয়ুবি বেয়োনেট উঁচিয়ে। নানা রকম খানা তল্লাশি। বাঘকে খাঁচায় আটকে ফৌজি জমহুরিয়ার অবাধ তাণ্ডব। ওরা মাতৃহত্যার ভোজসভায় রঙিন পেয়ালায় তাসের দেশের স্বপ্নে বিভোর। মাংস মজ্জা ভোজন শেষ। এখন পাকতন্ত্রের নরম হাড্ডি চিবুচ্ছে। চুষছে।
উন্মত্ত সবাই। অন্তেষ্টিক্রিয়ার বিউগল বাজার অপেক্ষায়। আজ কিংবা কাল। কাল কিংবা পরশু। ইসরাফিলের শিঙ্গা বাজবেই। জনোচ্ছ্বাস হবে জনতার। সময় আসছে।
আগরতলা একাংকিকা নিয়ে ওরা অন্তিম আনন্দ বিনোদনে লিপ্ত। ভাবছে এই প্রহসন পাকিস্তানিদেরকে গেলানো গেলেই কেল্লা ফতে। পাকি মিল্লাত ও কওমকে গনিমতের জেনানা বানিয়ে ওরা তখন লুটবে।
বাঙালিরা বড় বেয়াদব। এই বেয়াদবদের চুপ না করালেই নয়। বাঙালিদের চিরতরে স্তব্ধ করিয়ে দেয়া দরকার। দরকারে হলে ওদের কথিত ‘পূর্ব পাকিস্তান’ হোক কবরস্থান। শেখ মুজিব যেমন গলার কাঁটা। এই কাঁটা বের করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করলেই খেল খতম। কিন্তু মুজিব শিখায় বাঙালিও যে অনির্বাণ বহ্নি হয়ে উঠছে – হুকুম জালিমশাহী তা বেখবর। লেফট রাইট লেফট। চাঁন তারা পতাকা উড়িয়ে দণ্ডমুণ্ডের উদোম বেকুব-বুরবক আইয়ুবের ঈষদুষ্ণ সরোবরে ডুব – ফৌজী জমহুরিয়ার এ এক আশ্চর্য জমানা। এর মাঝেই কয়েকশ’ তরুণ নির্ভীক। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুক্তবাংলার চেতনা বহ্নিমান। জ্বলে উঠছে একটার পর একটা শিখা। মহত্তম আকাঙ্ক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ছে তরুণ তরুণীর প্রাণে প্রাণে।
সবিস্তারে চিঠি না হয় লেখা হলো শেখ সাহেবকে। এখন তা কেমন করে পৌঁছানো যায় সেনা লালচক্ষুর অন্তরীণ ঠিকানায়? কে হবে এ কাজের সাহসী ডাক হরকরা? এ চিঠি এমন তো নয় যে সেটিকে পোস্ট করে দিলেই পৌঁছবে গন্তব্যে। ফৌজি সতর্ক চোখ এড়িয়ে তা অসম্ভব! কিন্তু এই অসম্ভবকে সম্ভব করতেই হবে! শেখ সাহেবকে সব কিছু খুলে না জানালেই নয়।
তারুণ্য প্রস্তুত। আগুনবাজ আইয়ুবকে ভয় পায় না ছাত্ররা। তারা অগ্নিবলাকা মুক্ত প্রাণের মশাল জ্বালাতে জীবন ঝুঁকিতেও রাজি। তারপরও কাজে চাই নেতার নির্দেশ।
বুনিয়াদি ষড়যন্ত্রকারীরা কেবল ফৌজি শিরস্ত্রাণ মাথায় পরে শান্ত নয়; ভয় আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করতে তারা বদ্ধপরিকর। মুজিবকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি রেখে সারা পূর্ব বাংলাকে ক্রমশ বন্দিশালা বানিয়ে ফেলছে তারা। মুক্ত নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। বায়ু হয়ে পড়ছে বিষময়। লাখো প্রাণের চেতনায় যে আলোর শিখা জ্বলে উঠছে দিনে দিনে; ওরা বিষাক্ত ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিতে চায় আলোর দেউটি।
বুনিয়াদি দেশ-শত্রুদের এই ষড়যন্ত্র সফল হতে দেয়া যায় না। যে কোনো মূল্যে রুখতে হবে – প্রতিরোধ করতে হবে তারুণ্যের উচ্ছাসে।
উচ্ছসিত নদীতে যখন বান ডাকবে – বুনিয়াদি লাল্লু-পানজুদের তখন ঠাঁই-ঠিক ঠিকানাও থাকবে না।
এ জন্য চাই নেতার অকুণ্ঠ সমর্থন। আর সেই সমর্থনের প্রামাণ্য দলিল সই। তার সমর্থনকে কবুল করিয়ে আনতে হবে খোদ ক্যান্টনমেন্টের নিশ্ছিদ্র বেষ্টনির মধ্য থেকে। যে করেই হোক, যেভাবেই হোক – এ কাজে এখন আর পিছিয়ে পড়লে কোনোভাবেই চলবে না।
এটা সময়ের দাবি। এ দাবি কঠিন কোনো ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাস্তবায়ন করা চাই।
হাসিনা ও ওয়াজেদের কাঁধে ন্যস্ত হলো কঠিন কাজটি। হাসিনাকে তা পারতেই হবে। দ্বিধা একটু হচ্ছিল বটে। ফৌজি চোখ এড়িয়ে ছাত্রদের অগ্নিগর্ভ চিঠিটি পৌঁছে দেয়া। পদে পদে ধরা পড়ার ভয়। ধরা পড়লে মহা কেলেঙ্কারি। আইয়ুব আবার কোন ষড়যন্ত্র ফেঁদে বসে!
যাই হোক, ঝুঁঁকি না নিয়ে উপায় নেই।
পারিবারিক দেখা সাক্ষাৎ – মামলার প্রয়োজনে শেখ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল না। তবে সব কিছু কড়া টহল ও নজরদারির মধ্যে। এর ফাঁক গলিয়েই কাজটি সারা চাই। পেছনে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই।
রউফ-তোফায়েলের যৌথ স্বাক্ষর ছিল সেই পত্রে।
এক দণ্ড দেরি করতে চান না হাসিনা। সময়ের কাজ যথা সময়েই করা চাই। ছুটতে হবে সময়ের আগে। বিপদের শত কাঁটা পদে পদে। সেই মতো ইকবাল হলের ছায়াতরু নারকেল বীথি থেকে কোনো কালক্ষেপণ না করেই সোজা ক্যান্টনমেন্টে ছুটল।
দুর্ভেদ্য ফৌজি পল্লীর নানা প্রশ্ন সামলে সামরিক মেসে গিয়ে তারা পৌঁছল। এই মেস হাউজটিই আগরতলা মামলার আসামীদের সামরিক বন্দিশালা। অন্যদের সঙ্গে শেখ সাহেবও এখানে অন্তরীণ।
তার জন্য বরাদ্দ একটি কক্ষ। সামনে এক চিলতে বারান্দা। একটু দূরেই এক আর্মি অফিসার সার্বক্ষণিক পাহারায়। শান্ত্রী এদিক ওদিক দেখছে। ভীষণ হুঁশিয়ার। পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনলেও যেন গুলি ছুঁড়বে পিস্তলের। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে বারান্দায় চুপচাপ বসেছিলেন শেখ সাহেব। চারপাশে গাছে গাছে সবুজ হাওয়ার দুলুনি। পাখিও ডাকছে কাছে পিঠে। হাসিনা কাছাকাছি রাস্তায় পৌঁছাতেই তার তন্ময় ভাঙল। তিনি দেখতে পেলেন দু’জনকে।
কী ব্যাপার! মেয়ে ও জামাই কী বার্তা নিয়ে এলো! কেনোই বা এলো? নতুন কোনো খবর! নিশ্চয়ই কিছু একটা খবর! শেখ সাহেব একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন। কাছে পিঠেই দায়িত্বরত একটা সামরিক অফিসার। চোখের চাউনিতে যেন হিংস্র কামানের গোলা। শেখ সাহেব বেশ খানিকটা উচ্চকণ্ঠেই বললেন, আমার বড় মেয়ে ও জামাই এসেছে আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য। আমি গেটের দিকে যাচ্ছি। তাদের সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য।
পাহারাদারটি কিছু বুঝে উঠবার আগেই তিনি দ্রুত মেসের গেটে পৌঁছে গেলেন। মা হাসুু, আয় মা আয়! আবেগে উচ্ছাসে কন্যাকে জড়িয়ে ধরলেন বাবা। তুই তো বেশ শুকিয়ে গেছিস মাগো। খুব খাটাখাটনি করছিস বুঝি! বাবার কণ্ঠে উদ্বেগ।
এই সময়েই এলো আরাধ্য সুযোগ। ছাত্র নেতাদের দেয়া চিঠি এর মধ্যেই বাবার গেঞ্জির নিচে গুঁজে দিলেন হাসিনা। ফাঁকেই অল্প কথায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পরিস্থিতি সংক্ষেপেই জানালেন কন্যা। ছাত্রনেতাদের কার কী কথা, নেতাদেরও কার কী অবস্থান – তাও ব্যাখ্যা করলেন ওয়াজেদ। সব শুনে কিছু সময় শেখ সাহেব মৌন ধ্যানি। বললেন, রউফ খালেক তোফায়েলকে কালকে এই গেটের কাছে যেভাবেই হোক নিয়ে আসিস হাসু। ওদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলাটাই ভালো। ওদের মুখেই সব শুনবো। (চলবে…)
অলংকরণ: শিল্পী শাহাবুদ্দিন ও উত্তম সেন