বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হচ্ছে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী তাহমিনা জামান শ্রাবণী জনমতের দিক থেকে এগিয়ে। তাকে হারানো বেশ কঠিনই হবে এমন কথাও বলা হচ্ছে৷ কথাটা যে অযৌক্তিক নয় তা ২০০৮ সালে বাবরের বিএনপি হতে বহিষ্কৃত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে আনারস মার্কা নিয়ে ভোটযুদ্ধে বিএনপির ধানের শীষকে পিছনে ফেলে নৌকার সাথে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতাই বলে দেয়৷
এই নির্বাচনী এলাকায় তখন বিএনপি প্রার্থী নির্বাচনী গণসংযোগ করার মতো কোন নেতাকর্মীই পায়নি৷ বিএনপি প্রার্থী লেঃ কর্নেল (অব.) আতিকুর রহমান তখন অসহায়ের মত জনগণের কাছে ভোট চাইতে যেতেন৷ ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের এই কথাটি কি সেদিন মেনেছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা? কেন সেদিন দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল সবাই? এমন কী পেয়েছিল তারা বাবরের মাঝে? যার পরিপ্রেক্ষিতে দলের চেয়েও ব্যক্তি বাবরকে তারা উর্ধ্বে ঠাঁই দিয়েছিল? দল কি পেরেছে বিদ্রোহী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে? উল্টো বাবরের কাছে তার দলই হেরে গেল৷ ফেলে দেয়া থুথু উঠিয়ে আবার গিলে খাওয়ার মতো বাবরকে দলে ফিরিয়ে নিল তারা৷ নেতাকর্মীদের চাপে ও এই আসনটি পুনরুদ্ধারের লক্ষে বিএনপি বাবরের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়৷
২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় বাবর অথবা বাবর পরিবার নির্বাচন করতে পারেনি৷ তখন যদি বাবর অথবা বাবর পত্নী তাহমিনা জামান শ্রাবণী ভোটে দাঁড়াতো নৌকা প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় তো নয়ই প্রতিদ্বন্দ্বীতায়ই জেতা হতো কিনা এ প্রশ্ন অনেকের৷ জনমতের দিক হতে বাবর এমন একজন মহাক্ষমতাধর ব্যক্তি যার কাছে খোদ বিএনপিই হেরে যায়৷ বিএনপির কাছে বাবর নত হয়নি, বাবরের কাছে বিএনপি নত হয়েছে৷ নত হয়েছে ৪ দলীয় জোট৷ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বাবর হারিয়েছে বিএনপিকে, হারিয়েছে ৪ দলকে৷ ৪ দলীয় জোটের প্রার্থী লেঃ কর্নেল (অব.) আতিকুর রহমানকে সেদিন জনসমক্ষে চরমভাবে হাস্যকর করে তুলেছিলেন তিনি৷
সেই লজ্জায়ই হয়তো বেচারা এবার মনোনয়ন চাইলেন না৷ বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের আশীর্বাদ ও সমর্থনে বাবর ব্যবসায়ী হতে এমপি ও এমপি হতে মন্ত্রীত্বের চেয়ারের অধিকারী হতে সমর্থ হন৷ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহী অপকর্মের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম দিয়ে অবৈধ অস্ত্র আনা, জঙ্গী মদদ,বিরোধীদলকে নিশ্চিহ্ন করতে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, হামলাকারীদের বাঁচাতে জজ মিয়া নাটক সাজানো, বোমা হামলায় নিহত নিরীহ হিন্দু মটর মেকানিককে হিন্দু জঙ্গি বলে তাকে নতুন ধারার জঙ্গি বানানোর পাঁয়তারা প্রভৃতির সাথে জড়িত বাবর কি জানতেন এক সময় যে বিএনপির হয়ে তিনি যে এতসব করলেন সেই বিএনপিই তাকে একদিন বহিস্কার করবে? তিনি কি জানতেন একদিন বিএনপি আওয়ামী লীগ দুটোর বিরুদ্ধেই তাকে নির্বাচনে লড়তে হবে? যে বাবরের পরিচিতজনরা তার নামের দোহাই দিয়েই যেকোন অসাধ্যকে সাধ্যতায় পৌঁছে দিতে পারতো তার প্রবল ক্ষমতার ছোঁয়ায়৷ যে পুলিশ তার পরিচিতজনদের কথায়ই উঠবস করতো সেই পুলিশ খোদ বাবরকেই একদিন হ্যান্ডকাপ লাগাবে এটা কি তখন অবিশ্বাস্য ছিল না?
এখন পর্যন্ত বিএনপির মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রার্থীদের মধ্যে জনমতের দিক থেকে যারা ভাল অবস্থানে আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন দশ ট্রাক অস্ত্র ও গ্রেনেড হামলা সহ একাধিক হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী তাহমিনা জামান শ্রাবণী৷ দলীয় মনোনয়ন ও বিতর্কিতদের আইনগত জটিলতায় না দিতে পারলে বেছে নিচ্ছে তাদের স্ত্রী সন্তানদের৷ যেমন বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর স্ত্রী, আবদুস সালাম পিন্টুর স্ত্রী, সালাহ্উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী৷ বিতর্কিত ও দণ্ডিত নেতৃবর্গের স্ত্রী ও স্বজনদের মনোনয়ন প্রদানের পেছনে কাজ করছে স্রেফ আমজনতা সহানুভুতি দিয়ে জয়ের আকাঙ্ক্ষা,দলবাজী, ও হুজুগ নয় কি? একাত্তরের ঘাতক ও ফাঁসির দণ্ড পেয়ে মৃত্যুবরণ করা সাকা-মুজাহিদ, নিজামী-সাঈদি ও আবদুল আলিমদের পুত্ররাও নির্বাচনী মাঠে৷ যে যত বেশি অপরাধী, আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত তাদের স্ত্রী পুত্রদের জনপ্রিয়তা যেন ততো বেশি৷
বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা বিদেশে ফেরারি হিসেবে আছেন৷ তার পুত্র নির্বাচন করছেন৷ তার জনমত ও দলমত দুটোই ভাল৷ আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ আব্দুর রহমান বদির বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ ওঠায় তিনি মনোনয়ন পেলেন না৷ এবার মনোনয়ন পেলেন তার স্ত্রী৷ মুক্তিযোদ্ধা হত্যার অভিযোগে আমানুর রহমান রানার বদলে মনোনয়ন পেলেন রানার বাবা৷ এসব পরিবর্তনে রাজনৈতিক গুণগত কি কোনো পরিবর্তন হবে? ক্ষমতাকেন্দ্রিক অপরাধ কি কমবে? আব্দুর রহমান বদি তার স্ত্রীকে ভোট না দিলে ভোটারদের এখন হুমকি দিচ্ছে৷ এতে কি বুঝা যায় না যে স্ত্রী এমপি হলে বদির কর্তৃত্বই বহাল থাকবে? রাজনীতিকে কেন আদর্শিক মূল্যায়নের দিকে না নিয়ে পারিবারিক করে তোলা হচ্ছে? আদর্শিক চেতনা আরও মার খায় কৌশলের কাছে ৷হুজুগের কাছে৷ আরও রয়েছে পক্ষপাতদুষ্ট সমর্থনবাজী ও বৃহৎ চিন্তার বাইরে অপরিপক্ষ আবেগ সর্বস্বতা৷ নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) আসনে নৌকার প্রার্থী না থাকায় ঘুনুরাম রায় (৫০) নামের এক ব্যক্তি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে খবর বেরিয়েছে৷
তিনি পেশায় একজন দিনমজুর হলেও আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রমে তার সরব উপস্থিতি ছিল। ঘুনুরাম আসন্ন নির্বাচনে নীলফামারী-৩ আসনে কোনো আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নেই শুনেই বুঝি অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন৷ আওয়ামী লীগ নেতাদের পেলেই তিনি বলতেন, এত উন্নয়নের পরও কেন আপনারা এখানে নৌকা-টা আনতে পারলেন না? ঘুনুরামের এই প্রশ্নের কি উত্তর হতে পারে? নৌকা নিয়ে ঘুনুরামের আবেগটা হলো আওয়ামী লীগ থাকতে এখানে জাতীয় পার্টিকে ছাড় কেন? জোট মহাজোট হলে যে ছাড় দেয়াটা যৌক্তিক ঘুনুরামের অযৌক্তিক আবেগ তা মানতে পারেনি৷ সহানুভূতি, হুজুগ দলীয় পক্ষপাত ও বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার আজকালকার বহুমুখী ও বহুরূপী চরিত্রের ভিড়ে বোধ ও আদর্শিক চেতনা তলিয়ে গেছে৷ কর্তৃত্ববাদীরা রাজনীতিকে নিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক কর্তৃত্বে৷ উপদলীয় কর্তৃত্বে ও ক্ষমতাবাজির অবিবেকী ঔদ্ধত্যে? পিতার বদলে পুত্র, পুত্রের বদলে পিতা, স্বামীর বদলে স্ত্রী কত কি মনোনয়নী চিত্র দৃশ্যমান হল দেশে৷ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বাম সব মহলেই এমন চিত্রের জয় জয়কার৷ আরও রয়েছে কৌশলের জাল৷ এ জালে জড়িয়েও অনেকের লেজেগোবরে অবস্থা হয়ে যাচ্ছে অনেকের৷
আওয়ামী লীগের সাথে সখ্যতা করে একসময় বি টিম হয়ে উঠেছিল সিপিবি৷ সিপিবি নেতা নৌকা নিয়ে পাশ করে পরবর্তীতে কৌশলের জালে চলে গেছে বিএনপিতে এমন ঘটনাও ঘটেছে৷ তখন সিপিবি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগকে মন্দের ভাল হিসাবে বলত৷ এখন তারা কৌশল পাল্টে আওয়ামী লীগ বিএনপি দুটোকেই মন্দ বলে বর্জন করে চলছে৷ তারা এবার নির্বাচনে যাচ্ছে বামগণতান্ত্রিক জোট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে, নেত্রকোনা- ৪ এ বাম গণতান্ত্রিক জোট অন্তর্ভুক্ত সিপিবির একজন আবার বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির একজন দুজনের নির্বাচনী পোস্টার শোভা পাচ্ছে৷ এটাকে আবার কী কৌশল বলে আখ্যায়িত করবে তারা? কেন তারা জোটগতভাবে একক প্রার্থিতা ঘোষণা করতে পারল না? বাবর অনুসারীদের অনেকেই তাদের এই আলাদা জোটে ভোট যুদ্ধে আসায় খুব উল্লসিত৷ কারণ এতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি দাবিদারদের অনৈক্য দৃশ্যমান হয়৷ তাদের ভোট টানার লাভ যাবে বিএনপি জামাতের ঘরে৷ আর তারা ভোট যে কী পাবে তা ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়ই বুঝা যাবে? মনে হয় না দু’জনের ভোট একসাথে করলেও জামানত রক্ষার মত হবে? তবে কেন এই হাস্যকর অংশগ্রহণ ও নিজেদের অনৈক্যকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া?
আসলে গণতন্ত্রে আদর্শ, নৈতিকতা ও বাস্তবতা পড়েছে শাঁখের করাতে৷ জনমত ও তাদের ভোটদানও সুস্থধারার আদর্শিক গণতন্ত্রী নয়৷ নইলে বিতর্কিতরা, দণ্ডিতরা জনসমর্থনের দিক হতে এগিয়ে থাকতে পারতনা৷ দণ্ডিত বাবরের স্ত্রীকেই কেন মনোনয়ন দিতে হল? নিশ্চয় জনমত বিবেচনা করে, তাই নয় কি? জনগণ ও দেশীয় বৃহৎ স্বার্থের চেয়ে নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থকেই গুরুত্ব দিয়ে চলছে সবাই৷ তাই তারা বাবরের রাষ্ট্রীয় অপকর্মকে পাত্তা না দিয়ে তার কাছ থেকে নিজেদের সুবিধাপ্রাপ্তি ও তাকে ঘিরে নিজেদের ক্ষমতার আধিপত্যকেও গুরুত্ব দিচ্ছে কেউ কেউ৷ রাজনীতির রঙ্গলীলায় বাবর হারিয়েছিলেন বিএনপিকে আর এবার বাবর পত্নী হারাতে চাইছেন আওয়ামী লীগকে৷ জনগণের একটা বৃহৎ অংশও হুজুগে, অপরিপক্ব আবেগে ও সহানুভূতিতে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নে জড়িত দণ্ডিত অপরাধী লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রীর দিকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে৷ দলমত নির্বিশেষে সকলেরই বক্তব্য এই আসনে যেহেতু বিএনপির প্রার্থী বাবর পত্নী তাই তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে৷ এখানে অন্য কেউ প্রার্থী হলে প্রতিদ্বন্দ্বীতা হত না৷ বিতর্কের বাইরে ও ক্লিনইমেজ নিয়ে ২০০৮ সালে বিএনপির প্রার্থী আতিকুর রহমান ধানের শীষ নিয়ে কোন পাত্তাই পেলো না৷ তাকে হারিয়ে দিয়েছিল বাবরের আনারস প্রতীক৷ তাই অনেকের প্রশ্ন এবার কি বাবর পত্নী হারিয়ে দেবে আওয়ামী লীগকে? অবশ্য এই প্রশ্নের জবাব পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক দিন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)