আরএসএস তার হাজার রকমের সহযোগী সংগঠন এবং রাজনৈতিক অঙ্গ বিজেপিকে নিয়ে ‘৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপ ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের যে কাঙ্ক্ষিত অভিশাপ ছিল, সেটি দেশের সর্বোচ্চ আদালত, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে তারা পেয়ে গেছে।গোটা বিশ্বের মতোই, আমাদের লেশ, ভারত যখন কোবিদ-১৯ জনিত অতিমারিতে জর্জরিত, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর তথাকথিত রামমন্দিরের ভিত স্থাপন করেছেন। আরএসএসের রাজনৈতিক কর্মসূচি’ সাম্প্রদায়িকতা’ র পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগের পথে এই ভাবে দেশের সরকার আত্মনিয়োগ করেছে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে সম্পূর্ণ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর এই তথাকথিত রামমন্দিরের ভিত পুজো আমাদের দেশকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের এক ভয়ঙ্কর যুগের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।
ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস বা সেই ধ্বংসস্তূপের উপরে মন্দির তৈরি এগুলির কোনোটার সঙ্গেই ধর্ম বা আধ্যাত্মিক চেতনার বিন্দু মাত্র সম্পর্ক কোনো দিন ছিল না।নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন; হিন্দুত্ব, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, মুসলিম বিদ্বেষ-এগুলির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাবরি মসজিদ কে বোড়ের দান হিসেবে নিয়েছিল আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল সহ গোটা সঙ্ঘ পরিবার এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। মসজিদ ধ্বংসের ভিতরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির কোনো ধর্মীয় দ্যোতনাই ছিল না। কারণ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ই অপর ধর্মের উপাসনালয় ধ্বংস করে , সেখানে নিজের ধর্মের স্থাপত্য নির্মাণ কে সমর্থন করে না।হিন্দুত্ববাদীদের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পিছনে একমাত্র কাজ করেছিল রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের তাগিদ।বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী ঘটনাক্রমে হিশেবে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি সাম্প্রদায়িকতাকে হিন্দুত্ববাদীরা এমন একটা স্তরে এনে ফেলতে পেরেছে, যার জেরে পর পর দুইবার, একক গরিষ্ঠতা নিয়ে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে।
হিন্দুত্ববাদীদের কাছে এখন লক্ষ্য নির্বাচনের ভিতর দিয়ে যে রাষ্ট্রক্ষমতা তারা লাভ করেছে, সেই ক্ষমতাকে এবার তারা চিরস্থায়ী করতে চায়।সেই লক্ষ্যে এখন তাদের একমাত্র টার্গেট হল, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে অবলুপ্ত করে, তথাকথিত হিন্দু রাষ্ট্রের বিষভারে জর্জরিত একটি সংবিধান কায়েম করা।বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কর্তৃক ওই ভিতপুজোর এটিই হল সবথেকে প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক বিন্যাস। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার হল আরএসএস-বিজেপির সবথেকে বড় রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। সেই পথেই স্বাধীনতার পর থেকে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি নিজেদের পরিচালিত করেছে। সেই পথ কে আটের দশকে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনকালের শেষ দিক থেকে তারা তীব্র তর করে তোলার রাস্তায় নামে। ইন্দিরার জীবিতাবস্থায় যদি পরবর্তী লোকসভা ভোট হতো, তাহলে সেই ভোটেই আরএসএস, তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির সাফল্যের তাগিদে এই বাবরি মসজিদের ইস্যুটিকে তীব্র করে তুলত। কারণ শ্রীমতী গান্ধীর জীবদ্দশার শেষ পর্যায়ে আর এস এসের শাখা সংগঠন , বিশ্ব হিন্দু পরিষদের উদ্যোগে যে ‘ ধর্ম সংসদ’ গুলি পরিচালিত হতে শুরু করেছিল, সেখান থেকেই পরবর্তী লোকসভার ভোটে হিন্দুত্ববাদীদের সাম্প্রদায়িক কৌশল বুঝতে পারা যাচ্ছিল।
শ্রীমতী গান্ধীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ সাম্প্রদায়িকতার প্রচার, প্রসার এবং প্রয়োগের ভিতর দিয়ে, তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য ‘হিন্দু রাষ্ট্র’গঠনের পথকে পরিষ্কার করতেই ভীত পুজোর এই রাজনৈতিক সমারোহ।ভিত পুজোর ভিতর দিয়ে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যের পথে লক্ষ্যে গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির নেমেছে, বস্তুত নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই তার প্রেক্ষাপট হিন্দুত্ববাদী শিবির তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিল। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর যে পরিস্থিতির দিকে গোটা দেশকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির ধীর অথচ তীক্ষ্ণ গতিতে নিয়ে এসে ফেলেছে, তারই ফলশ্রুতি হল; নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন।
আরএসএসের আদর্শগত ভিত্তি তৈরির অন্যতম ব্যক্তিত্ব এম এস গোলওয়ালকর যে ভাবে তার ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে’ তত্ত্বের ভিতর দিয়ে দেশকে কেবল মুসলমান শূন্যই নয়, বহুত্ববাদী চেতনায় বিশ্বাসী মানুষশূন্য করবার ফর্মুলা দিয়েছিলেন, এনআরপি, এমপিআর ইত্যাদির ভিতর দিয়ে সেই ফর্মুলার বাস্তবায়নের পথে ইতিমধ্যেই হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল; ভারত কেআরএস এসীয় হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। কোনো ধর্মীয় আকুলতা কখনো অপর ধর্মের উপাসনালয়ের ধ্বংসস্তূপের উপর নিজের ধর্মের উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে না। যারা ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করে দেশকে, গোটা সমাজব্যবস্থাকে মধ্যযুগীয় ক্রুসেডের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, অপর ধর্মের উপাসনালয় ধ্বংস, তাদের ই অভিপ্রায়। আরএসএস-বিজেপি এবং তাদের সঙ্গী সাথীরা, কেবল ভারতকেই নয়, গোটা উপমহাদেশে মধ্যযুগীয় বর্বরতা ‘ ক্রুসেডে’ র নোতুন করে অবতারণা করতে চায়। তাই বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে, দেশের মানুষকে বিভাজিত করতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি। ধর্মের নামে মানুষের মাথা নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলার পৈশাচিক অভিপ্রায়ে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর একটি রাজনৈতিক অভিপ্রায় সিক্ত মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করেছে, তাদের এককালের হিন্দুত্বের পোষ্টার বয়, তথা দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দিয়ে।
এই গোটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যাকে হিন্দুত্ববাদী শিবির ধর্মীয় আবেগ ইত্যাদি শব্দের ভিতর দিয়ে প্রকাশ করতে চাইছে, এসবেরই তাদের সময়োপযোগী লক্ষ্য হল; গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পাওয়া ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা।সেই লক্ষ্যের পদক্ষেপই ছিল দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেই, লোকসভার প্রথম অধিবেশনে সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫ এ ধারার অবলুপ্তি। এসবেরই ধারাবাহিক প্রবণতা হল কোবিড ১৯ জনিত অতিমারির ভিতরেও শ্রম আইন শিথিল করা, অত্যাবশ্যকীয় ফণ্য আইন শিথিল করা, কৃষি আইনের সংশোধন। আর এইসব অর্থনৈতিক ব্যভিচার সম্পর্কে যাতে মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হতে না পারে, প্রতিবাদী না হয়, প্রতিরোধী না হয়-সেই জন্যে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যকে ধর্মীয় বটিকা হিসেবে মানুষের গলাধঃকরণ করানো।
‘৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কালে হিন্দুত্ববাদী শক্তি যে জায়গায় ছিল, আজ প্রায় সাত বছর রাষ্ট্র ক্ষমতা এককভাবে দখল করে রাখার পর, তারা কিন্তু আর সেই জায়গাতে নেই। এমন কি অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে প্রায় হাড়ে ছয় বছর ধরে, এনডিএ নামক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোট সরকার চালানোর সময়েও আরএসএস, বিজেপি যে জায়গায় ছিল, এখন আর তারা সেই জায়গাতে নেই। রাষ্ট্র ক্ষমতা এককভাবে করায়ত্ত করে বিচার ব্যবস্থার উপরে তারা কতোখানি প্রভাব বিস্তার করেছে-এটাই এখন দেশবিদেশের আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠে আসছে। কারণ মোদি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার অল্প কিছুকাল পরে এন আর সির বিরুদ্ধে শাহিনবাগের ঐতিহাসিক আন্দোলন হয়েছে। সেই আন্দোলনকে কেবলমাত্র ‘মুসলমান পরিচালিত ‘ আন্দোলন বলে দেগে দিয়েও আন্দোলনের ঝাঁঝ দিল্লি গণহত্যা, অতিমারী, লকডাউনের পরেও নিভিয়ে দিতে পারে নি আরএসএস- বিজেপি। এই অবস্থাতেই বাবরি মসজিদের জমির মালিকানার রায় দিতে গিয়ে, যুক্তি, তথ্য প্রমাণ ব্যতিরেকে, কিছু লোকের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে আরএসএস নিয়ন্ত্রিত হনুমান গড়ির আখড়ার অধীন ‘রামমন্দিরে’ র ‘ রামলালা’, যেটিকে ‘৪৯ সালের ১৬ডিসেম্বর, বাবরি মসজিদের তালা ভেঙে, সঙ্ঘ কর্মীরা ঢুকিয়ে দিয়েছিল, তার বলে সাব্যস্ত করেছে।
এই পর্যায়ক্রম টি ভারতের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করবার হিন্দুত্ববাদী ষড়যন্ত্রের কোনো অঙ্গ কি না, তা নিয়ে কেবল ভারতেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরে যারা মানবাধিকার নিয়ে সরব, সংখ্যালঘুর অধিকার ঘিরে লড়াই করেন, তাদের ভিতরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এধরণের একটা সংশয়ের ভিতরেই দেশির প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বাবরি মসজিদের ধ্বংস স্তূপের উপর আরএসএস নিয়ন্ত্রিত হনুমাগড়ি আখড়ার পরিচালনাধীন মন্দিরের ভিত পুজো করেন। তার অল্প কিছুদিনের ভিতরেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস সংক্রান্ত যে ফৌজদারি মামলাটি চলছিল, সেটি রায় ঘোষিত হয়। বলা বাহুল্য, এই রায়ে লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতী সহ যেসব বিজেপি নেতা এবং আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা মসজিদ ধ্বংসে অভিযুক্ত ছিলেন, প্রত্যেকেই বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়।লিবেরাহান কমিশন থেকে শুরু করে, বিভিন্ন ধরণের মসজিদ ধ্বংস সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণকে বিশেষ আদালত ন্যুনতম স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয় না। দেশে এবং বিশ্বে এই প্রশ্নই জোরদার হয়ে ওঠে যে, মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর মন্দির তৈরির ভিত্তি স্থাপন করে যে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের যুগ হিন্দুত্ববাদীরা তৈরি করেছে, তার প্রভাব কি বিচার ব্যবস্থার উপরেও ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করে দিল?
অতিমারি জনিত সঙ্কটে গোটা দেশে অর্থনীতির অবস্থা বেহাল।অর্থনীতিবিদেরা ইতিমধ্যেই বলছেন, ভারতে মন্দা শুরু হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক স্তরে অতিমারির সঙ্কটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষুধার সঙ্কট ঘিরে সতর্ক করা হয়েছিল।বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, অতিমারীর পর ক্ষুধায় মৃতের সংখ্যা, অতিমারীর মৃতের সংখ্যাকেও ছাপিয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই সেই সঙ্কটের ভয়াবহ আভাস আমাদের দেশের সর্বক্ষেত্রে পড়তে শুরু করেছে।নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দাম প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে।বিজেপির শ্রেণিসখ্যতা প্রথম থেকেই যাদের সঙ্গে, সেই মধ্যস্বত্ত্বভোগী ফড়ে, মুনাফাখোর, মজুতদার, খাদ্যের চোরাকারবারিরা এই অতিমারির কালে প্রশাসনে নিজেদের লোক থাকার সুবাদে ফুলে ফেঁপে উঠেছে।তাই বাজারে আলু, পেঁয়াজ থেকে ভোজ্য তেল, জীবনদায়ী ওষুধ-সবকিছুর দামই প্রায় প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে। বহু ক্ষেত্রেই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ খোলা বাজারে অমিল। দুই গুণ, তিনগুণ দাম দিয়ে সেইসব জোগার করতে হচ্ছে চোরা বাজার থেকে। তেতাল্লিশের মন্বন্তর কালে যে ভয়াবহ চিত্রের ইতিহাস আমরা পড়েছি, জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদের চিত্রমালায় দেখেছি-তার যেন ধীরে ধীরে আবার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলছে। কর্মহীনতা, বেকারি, ব্যাপক ছাঁটাই। এই ছাঁটাইয়ের প্রকোপ এতকাল পড়তো কেবলমাত্র নীচতলার কর্মীদের উপর। এখন বেসরকারি, বহুজাতিক সংস্থায় উঁচু দরের কর্মী, যারা লক্ষাধিক টাকার উপর বেতন পান, তারাও শিকার হচ্ছেন ছাঁটাইয়ের।
কেন্দ্রের বিজেপি বা রাজ্যের তৃণমূল, কোনো সরকারই এসব নিয়ে একটা কথা বলছে না। আরএসএস-বিজেপি বাবরি মসজিদ ভেঙে যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করেছিল, সেই বিভাজনকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভিতরে গেঁথে দিয়ে ভোট রাজনীতিতে বিজেপির সুবিধা করতে সব রকমের চেষ্টা করে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের নরম সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতাকে শক্তি যোগাচ্ছে ভাষা-জাতিগত সাম্প্রদায়িকতার ভিতর দিয়ে।খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের পর বাঙালি-অবাঙালি বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন। এখন বিজেপির সাংগঠনিক দিক সামলাতে এই রাজ্যে আরএসএস, নিজেদের যেসব প্রচারকদের পাঠাচ্ছে, সেইসব বিজেপি নেতাদের, রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস একটি বারের জন্যেও রাজনৈতিক আক্রমণ করছে না। করছে জাতিগত আক্রমণ।ভাষাগত আক্রমণ। ফলে একদিকে বাঙালি-অবাঙালি বিষয়ের ভিতর দিয়ে বাবরি ধ্বংসের মূল যে রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতার প্রসার, সেই কাজটি আরএসএস-বিজেপি খুব ভালো ভাবেই সফল করতে সচেষ্ট। অপরপক্ষে বিজেপির বিরুদ্ধে একটিও রাজনৈতিক আক্রমণ করছে না তৃণমূল। আরএসএসকে তো তারা ফুলের ঘাও কখনো দেয়নি।বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণের বদলে, তাদের বিরুদ্ধে জাতি, ভাষাগত বৈষম্যের কথা বলে যে বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে চাইছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি, সেই নষ্ট চেতনাকেই মদত দিচ্ছে তৃণমূল বাঙালি শ্যভিনিজিমের নাম করে আঞ্চলিকতাবাদের প্রসারের ভিতর দিয়ে।নরেন্দ্র মোদি ‘ এক দেশ, এক ভোটে’র ডাক দিয়ে দেশের সাংবিধানিক পরিকাঠামো বদলে দিয়ে, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙার রাজনৈতিক অভিলাষ, হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আর বাংলায় বাঙালি ছাড়া কেউ রাজনীতি করতে পারবে না, এই ঘোরতর আঞ্চলিকতাবাদী মানসিকতার প্রসার কৌশলে ছড়িয়ে দিতে চাইছে তৃণমূল। উদ্দেশ্য, আরএসএস-বিজেপির ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং সেই ধ্বংসস্তূপের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন তথাকথিত মন্দির তৈরির আসল রাজনীতিকে সফল করা।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙার লক্ষ্যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী রা মূলত আরএসএসের নেতৃত্বে, ‘ ৪৭ সালে, স্বাধীনতার পর থেকে ই যেসব কাণ্ডকারখানা করতে শুরু করেছিল, তার একমাত্র লক্ষ্যস্থল ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। সেই লক্ষ্যে স্থির থেকেই আর এস এস তাদের সমস্ত শাখা সংগঠন এবং রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে ‘ ৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর সভ্যতার বুকে চরম বর্বরতার নিদর্শন স্থাপন করে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। এই কর্মকাণ্ড গোটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরকে ধীরে ধীরে ভারতের সামাজিক পরিকাঠামোতে ধর্মীয় মেরুকরণ করবার কাজ টিকে প্রায় বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সামাজিক পরিকাঠামো জাতপাতের বিভাজনে দীর্ণ। সেই দীর্ণতার অভিশাপে ভারত আজ সার্বিক ভাবে জর্জরিত। ব্রাহ্মণ্যবাদ আর এস এসের ও অন্যতম আচরণীয় অভিব্যক্তি। ব্রাহ্মণ্যবাদ কার্যত আরএসএসের ধর্মীয় মেরুকরণের কাজটির ক্ষেত্র অনেকখানি প্রস্তুত করে রেখেছিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংস জনিত গোটা রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, যে প্রেক্ষিত কে আশ্রয় করে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকেই ধীরে ধীরে নির্বাচনী রাজনীতিতে অনেক বেশি সাফল্য পেতে শুরু করে, বিভিন্ন রাজ্যে সরকার ও তৈরি করে-সেই প্রেক্ষিতকে ব্যবহার করেই সামাজিক প্রযুক্তিকে আরো অনেক বেশি তীব্র করে তোলে বিজেপি। সেই সামাজিক প্রযুক্তিই বিজেপিকে লোকসভাতে একটা বড় অঙ্কের আসনে পৌঁছতে সাহায্য করে।এই প্রযুক্তির মোকাবিলাতে ভারতের অবিজেপি রাজনৈতিক দলগুলি চরম ব্যর্থতার ই পরিচয় দিয়েছে। বামদলগুলি নীতিগত ভাবে আরএসএসের সামাজিক প্রযুক্তির মোকাবিলার কথা তাদের দলিল দস্তাবেজে বলেন।কিন্তু সেই কাজ করবার লক্ষ্যে আজ পর্যন্ত বামদলগুলি বাস্তবের মাটিতে কিছুই করেনি।
সংসদীয় রাজনীতির সেই সংখ্যাকে আশ্রয় করে এন ডি এ নামক একটি নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোট নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির নেতৃত্বে তৈরি করে আরএসএস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়রাম জয়ললিতা, প্রফুল্ল মহন্ত, নবীন পট্টনায়ক, রামবিলাস পাশোয়ান, এমন কি প্রথম পর্যায়ে ডাঃ ফারুক আবদুল্লাও সেই জোটে শামিল হন।
অটল বিহারির প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে আর এস এস নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’ র প্রচার, প্রসার এবং প্রয়োগের স্বার্থে সম্পূর্ণ ভাবে আত্মনিয়োগ করে। অতীতে মোরারজি দেশাই মন্ত্রীসভাতে বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আডবাণীর অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসনের অভ্যন্তরে নিজেদের তথাকথিত মতাদর্শের বিস্তারের কাজটি কিন্তু আরএসএস সাতের দশকেই শুরু করেছিল। নয়ের দশকে বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্বের সুযোগ নিয়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের যে রাজনৈতিক প্রেক্ষিত ছিল, অর্থাৎ; লেশের সর্বত্র একটা বিভাজনের সংস্কৃতির প্রসার ঘটানো, সেই কাজটিকে জোরদার ভাবে প্রয়োগ করতে শুরু করে দেয় আরএসএস। মধ্যপ্রদেশ, পরবর্তীকালে সেই রাজ্য বাজপেয়ীর আমলেই দ্বিখন্ডিত হয়। মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়, যেটি আরএসএসের অন্যতম শক্তিশালী শাখা সংগঠন ‘ বনবাসী কল্যাণ আশ্রমে’ র উৎস ভূমি, সেখানে বিভাজনের রাজনীতিকে প্রকট করে তুলতে থাকে আর এস এস।এই কাজটি অবশ্য অনেকদিন ধরেই মধ্যপ্রদেশে তারা চালিয়েছিল। বিশেষ করে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে সংযুক্ত কুমারী উমা ভারতী সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গোটা মধ্যপ্রদেশকে কার্যত নরেন্দ্র মোদির মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালের গুজরাট, যাকে হিন্দুত্ববাদীরা,’ হিন্দুত্বের গবেষণাগার’ হিসেবে দেখতো এবং বলতো, সেই পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর এই যে ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রমে’ র কথা উল্লেখ করা হল, আরএসএসের এই শাখা সংগঠন টিই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের রাজনৈতিক লক্ষ্য, রাষ্ট্রক্ষমতা নিরঙ্কুশ ভাবে দখল, হিন্দুত্ববাদীদের সেই জিঘাংসা চরিতার্থ করতে সংগঠিত গুজরাট গণহত্যায় সংখ্যালঘু মুসলমান নিধনে সবথেকে নারকীয় ভূমিকা পালন করেছিল।
বাজপেয়ীর আমলে সাম্প্রদায়িকতার প্রসারে আরএসএস তাদের সমস্ত শাখা সংগঠন এবং রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে কার্যত জোরকদমে ময়দানে নামিয়ে দিয়েছিল। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ভিতর দিয়ে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটিয়ে গুজরাট গণহত্যার যে সামাজিক সংস্কৃতি, তাকে গোটা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিল। কেবল যে মুসলমান সম্প্রদায়ের দায়ের উপর তারা আঘাত হেনেছিল তা নয়। ঊড়িষ্যার বিস্তীর্ণ আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে, আদিবাসীরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়ার জন্যে তাদের উপরে নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছিল আরএসএসের শাখা সংগঠন বজরং দল। অস্ট্রেলিয় মিশনারি ফাদার গ্রাহাম স্টুয়ার্স স্টেইনসকে দুই শিশুপুত্র সহ নারকীয় ভাবে হত্যা করেছিল আরএসএসের শাখা সংগঠন বজরং দল।বড়দিনের সময় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত গরিব মানুষদের উপর, গির্জার উপর আরএসএস এবং তার সঙ্গীসাথীদের আক্রমণ ছিল একটা নিয়মিত ব্যাপার। আজ বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর আরএসএস নিয়ন্ত্রিত ‘হনুমানগড়ি আখরা’ র পরিচালনাধীন তথাকথিত রামমন্দিরের ভিত পুজো দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে করাবার পর, গোটা দেশকে যে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের যুগের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে আরএসএস, তার জেরে ইতিমধ্যেই তাদের সঙ্গী সংগঠন গুলি আসামে বড়দিন পালন ঘিরে অসভ্যতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আসামে এর আগে সংখ্যালঘু মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থা মাদ্রাসা গুলিকে লক্ষ্যবস্তু করে নানা ধরণের অসভ্যতা তারা শুরু করে দিয়েছে। সংখ্যালঘুর অধিকারের যে রক্ষা কবচ আমাদের সংবিধানে আছে, সেই রক্ষাকবচ বলেই সংখ্যালঘু মুসলমানেরা তাদের জীবনের নানা পর্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখেন। এই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই বানচাল করে দিতে কেন্দ্রে বিজেপি এবং যে রাজ্যগুলিতে তারা ক্ষমতায় আছে, সেই রাজ্যগুলিতে তৎপরতা শুরু করেছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সবথেকে বড় যে রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে বাতিল করা, সেই লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশেই এই কাজ আরএসএস অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক করে চলেছে। আসামে যে হুঙ্কার তারা দিচ্ছে, সেই কর্মকাণ্ডই পরিবর্তিত আকারে পশ্চিমবঙ্গে করে চলেছেন আরএসএস -বিজেপির স্বাভাবিক মিত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই রাজ্যে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের চাকরি আটকে দিয়েছেন মমতা। সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও সেইসব ছেলেমেয়েদের নানা অছিলায় চাকরি না দিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই ধ্বংস করবার লক্ষ্যে আরএসএস-বিজেপির যে কর্মসূচি, সেই কর্মসূচির প্রসারে মমতা আত্মনিয়োগ করেছেন।
মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েরা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত লড়াই করে নিজেদের অধিকারের স্বীকৃতি আদায় করেছেন। তবু মমতার সরকার তাদের নিয়োগপত্র দেননি। ছাত্রছাত্রীরা অবস্থানে বসেছেন, অনশনে বসেছেন। রাতের অন্ধকারে মমতার পুলিশ তাদের উপর নারকীয় অত্যাচার করেছেন। পবিত্র মসজিদের ভিতরে ঢুকে সেখানে আশ্রয় নেওয়া হবু শিক্ষকদের টেনে বের করে বীভৎস ভাবে পুলিশ পিটিয়েছে। এভাবেই পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসাগুলিকে শিক্ষক শূন্য করে দিতে সচেষ্ট মমতা। আসামে প্রকাশ্যে বিজেপি মাদ্রাসার বিরুদ্ধে বলে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের যে অন্যতম মূল লক্ষ্য, ভারতকে মুসলমানশূন্য করা, সেই বর্বরতার প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। আর পশ্চিমবঙ্গে মমতা মাদ্রাসা গুলিকে অচল করে, শিক্ষকশূন্য করে বিজেপি আরএসএসের লক্ষ্য পূরণ করতেই মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশন উত্তীর্ণ হবু শিক্ষকদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করে চলেছেন গত দশ বছর ধরে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)