বিশেষ করে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আয়ের পথ সংকুচিত হচ্ছে, কিন্তু ব্যয়ের মাত্রা বাড়ছেই। তাই উচ্চাভিলাষী কোনো বাজেট দেয়ার উপায় নেই। তারপরও প্রয়োজনের সাথে আপোষ করেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিশেষ পরিস্থিতিতে গতানুগতিক ধারার কতোটা বাইরে গেছেন অর্থমন্ত্রী? অন্য বছরগুলোর চেয়ে নতুন কী কী এসেছে এবারের বাজেটে?
ইতিহাসের বড় দুঃসময়ে মানবজাতি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত। পাল্টে গেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির সব হিসাব নিকাশ। সরকারের অতীতের অর্জন ও বর্তমান উদ্ভুত পরিস্থিতিকে সমন্বয়ের মাধ্যমে বাজেট তৈরি করেছেন অর্থমন্ত্রী।
কর কাঠামো বিশ্লেষণ
করোনাকালে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে ব্যক্তিশ্রেণী আয়করে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। বার্ষিক করমুক্ত আয়ের সীমা পুরুষের জন্য আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ, আর মহিলা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
সর্বনিম্ন করহার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ ও সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব এসেছে বাজেটে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩২.৫ শতাংশ করা হচ্ছে। কর অবকাশ বা ট্যাক্স হলিডে সুবিধার আওতায় যুক্ত হয়েছে আরও ৬টি খাত।
বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা সাদা করার বড় সুযোগ থাকছে।
২০২০ সালের ১লা জুলাই থেকে ৩০শে জুন ২০২১ এর মধ্যে আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও এপার্টমেন্ট এর উপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে রাখা অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দিলে কোন প্রশ্ন করা হবে না।
এই সময়ে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ওপর ১০% কর দিলে এই টাকা নিয়েও কোন প্রশ্ন করবে না আয়কর বিভাগ। অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করলে কর রেয়াত দেওয়া হবে ২ হাজার টাকা।
নতুন কর আরোপ না করে আওতা বাড়িয়ে আইনকানুন সহজ ও সংস্কারের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাজেটে।
তবে, কার ও জিপ এর রেজিস্ট্রেশনসহ বিআরটিএ’র অন্যান্য ফি’র ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। চার্টার্ড বিমান ও হেলিকপ্টার ভাড়ার ওপর শুল্ক ২৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০ শতাংশ।
ভ্যাট বিশ্লেষণ
আওতা তেমন একটা বাড়ছে না। তবে উৎসে কর রেয়াতসহ যেসব অসঙ্গতি আছে সেগুলো দূর করে সংস্কারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
মুসক বা ভ্যাটে আগাম কর শিল্পের কাঁচামলের জন্য ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হচ্ছে। তবে বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের জন্য তা থাকছে আগের মতোই ৫ শতাংশ।
বিশেষ করে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে সার্জিক্যাল মাস্ক ও পিপিই তৈরি করলে ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে পুরোপুরি।
তবে, ব্যাংকে ৫ কোটি টাকার বেশি আমানত থাকলে আবগারি শুল্ক বাড়ছে। বর্তমানের ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তা করা হচ্ছে ৪০ হাজার টাকা।
আমদানি শুল্ক
মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করলে এবং কর ফাঁকি দিলে বড় অঙ্কের জরিমানার বিধান থাকছে নতুন বাজেটে। যে পরিমাণ প্রদর্শিত বিনিয়োগ ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হবে তার উপর ৫০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। দেশ থেকে অর্থপাচার রোধে এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
সামাজিক সুরক্ষা
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চলমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীগুলো অব্যাহত রাখা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে সর্বমোট ৮১ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৫ হাজার ৫শ ৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব আছে যা জিডিপি’র ৩ শতাংশের বেশি।
একই কারণে কর্মহীন জনগণের সামাজিক সুরক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ১০ টাকা দামে চাল বিতরণসহ বিনামূল্যে চাল সরবরাহ ভিজিডি, ভিজিএফ ও ওএমএস কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে বাড়ানো হচ্ছে বরাদ্দ।
বয়স্ক, বিধবা ও মাতৃত্বকালীনসহ অন্যান্য ভাতাভোগীর সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। এসব ভাতার আওতায় আনা হচ্ছে দারিদ্রপীড়িত একশ’ উপজেলায় শতভাগ যোগ্য সুবিধাভোগীদের। যোগ হবে ৫ লাখ নতুন উপকারভোগী। এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ ৩শ কোটি টাকা।
বাজেট উপস্থাপন করে অর্থমন্ত্রী যে দিকনির্দেশা দিয়েছেন তার মূল কথা: অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে আগের উন্নয়নের ধারাবহিকতায় ভবিষ্যতের কাঙ্খিত ভিত রচনা করতে চান তিনি।