চলতি অর্থবছরে (২০১৭-২০১৮) চর, হাওর এবং পশ্চাৎপদ এলাকার স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সার্বিক উন্নয়নে (এভাইে বাজেট বই-এ লেখা) মানুষের উন্নয়নে থোক বরাদ্দ হিসেবে রাখা হয়েছিল ২০০ কোটি টাকা। পুরনো নিয়মে এবারও সেই থোক বরাদ্দের সামান্যও চরের মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। বেশ কয়েক বছর ধরেই এই লোক দেখানো খেলা চলছে। জাতীয় বাজেটে চরের মানুষের উন্নয়নে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়, কিন্তু সেই বরাদ্দের একটি টাকার সেবাও চরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী পান না।
এর আগে জাতীয় বাজেটের ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশের চরাঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে ৫০ কোটি টাকা করে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বরাদ্দকৃত এই অর্থের একটি টাকাও খরচ না হওয়ার কারণে বরাদ্দকৃত পুরো অর্থই অব্যবহৃত থেকে যায়। বাজেটে বলা হয়েছিল চরের মানুষের যোগাযোগ এবং অন্যান্য খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা হবে। কিন্তু বরাদ্দকৃত অর্থ চরের মানুষের কোনো উন্নয়নেই ব্যয় করা হয়নি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চরের মানুষের উন্নয়নে ৫০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দেওয়ার সময় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘গত বছরের (২০১৪-১৫) বরাদ্দ অব্যবহৃত থাকা সত্ত্বেও এবারেও ৫০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি’। কিন্তু যা হবার তাই হয়। সে অর্থও শুধু লেখাই থাকে।
দেশের যেসব অঞ্চলে এখনও তুলনামূলক অতিদারিদ্রতা বা দরিদ্র্যের হার বেশি চরাঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। চরাঞ্চলের মানুষ প্রায় সারা বছর ধরেই নদী ভাঙন, বন্যাসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করে বেঁচে থাকে। চরাঞ্চলের মধ্যে দ্বীপচরের অবস্থা আরও বেশি করুণ। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণের দ্বীপ চরাঞ্চলের বাসিন্দারা প্রায় বিচ্ছিন্নই বলা যায়। মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে অবস্থার কারণে সরকারি সুযোগ-সুবিধা এখানে বরাবরই অপ্রতুল।
দুর্গম চরে বসবাসরত মানুষ বরাবরই বহুবিধ সমস্যায় পতিত। কর্মহীনতা, খাদ্যভাব, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবার অপর্যাপ্ততা, সুপেয় পানির অভাব-চরাঞ্চলে এসব সমস্যা বরাবরই দৃশ্যমান। খাদ্যের স্বল্পতা এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য ক্রয়ের অক্ষমতার কারণে চরের হতদরিদ্র মানুষের একটি বড় অংশকে বছর ধরেই এক ধরনের খাদ্যবঞ্চনাতেও ভুগতে হয়। ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্যচাহিদা কখনই তারা পূরণ করতে পারে না। খাদ্যঘাটতি যেনো তাদের জীবনেরই অংশবিশেষ। এদিকে খরা মৌসুমে কখনও কখনও ক্ষুধাবঞ্চনা আরো কঠিন আকার ধারণ করে। এসময় অতিদরিদ্র মানুষকে আরো বিপদাপন্ন অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়। ক্ষুধা নিবারণে ব্যর্থ হয়ে চরের অনেক মানুষ তাই শহরমুখী হয়ে পড়ে। বন্যার সময়ও বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে হয় তাদের।
গত বছর টানা বৃষ্টি এবং উজানের ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও তিস্তা অববাহিকায় পানির উচ্চতা ধারাবাহিকভবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে দেশের উত্তর এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে জুলাই-আগস্ট মাসে ভয়াবহ বন্যা শুরু হয়। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এই বন্যা ক্রমাগত আরো রুদ্ররুপ ধারণ করে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই অবশ্য বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। কিন্তু ভয়াবহ বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, রংপুর, লালমনিরহাট, বগুড়া, নীলফামারী, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর।
সরকারি হিসেবে দেশের ৩২টি জেলার ২০৮টি উপজেলা গত বছরের বন্যায় কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যায় যে সব জেলার চরের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেগুলো হলো-রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, চাঁদপুর এবং নাটোর। বিশেষ করে নদীভাঙন এবং প্রবল স্রোতের কারণে নদীবক্ষের দ্বীপচরগুলোর মানুষের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স কোঅর্ডিনেশন সেন্টার (এনডিআরসিসি) এর দেওয়া তথ্যমতে গত বছরের বন্যায় ২০৫টি উপজেলার ৯ হাজার ৭ শত ৮৭টি গ্রাম ও চর বন্যা আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যায় ১ লাখ ১১ হাজার ১৮৮টি পরিবার সম্পূর্ণরুপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৬ লাখ ২৩ হাজার ১৯৬টি পরিবার। বন্যায় সম্পূর্ণরুপে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৩ হাজার ৮৫৫টি বাড়িঘর। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৭৯২টি ঘরবাড়ি।
একইসাথে গত বছরের বন্যায় ১৪টি জেলায় মোট ১ লাখ ৪ হাজার ৯ শত ৪৯ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণরুপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে ৩২টি জেলার ২০৮টি উপজেলায় ৫ লাখ ১ শত ২৫ হেক্টর জমি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে চিল ধান, ভুট্টা, সবজি। এছাড়াও কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন জেলাতে ব্যাপকহারে বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চাষীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। জামালপুর এবং বগুড়াতে সবচেয়ে বেশি ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গতবছরের প্রবল বন্যায় প্রতি পরিবার গড়পরতায় ৫০ থেকে এক লাখ টাকার মতো আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এসব ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ছিল বসতবাড়ি নষ্ট হওয়া, বসতবাড়ি ভেঙ্গে যাওয়া বা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া, কৃষি জমি নষ্ট হওয়া, গবাদিপশুর মৃত্য ইত্যাদি ইত্যাদি। কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশিও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে অনেক পরিবার। এছাড়া অনেক পরিবারে এক বা একাধিক গবাদিপশু মারা যাওয়ার কারণে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
বিশেষ করে জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ উপজেলার মেরুর চর, কাচিহারা, কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার বাংলাবাজার চর, রাজারহাট জেলার কালুয়া চর থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি পরিবারই গড়ে পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি মেটাতে গিয়ে বেশিরভাগ চরের পরিবারকেই বাড়তি দুঃশ্চিন্তার মধ্যে পড়তে হয়।
দেশ যখন উন্নয়নের অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে তখন আমরা দেখতে পাচ্ছি চরের বঞ্চিত মানুষের উন্নয়নে সরকার খানিকটা নিরবই। চরের মানুষ আর চরাঞ্চলের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বড় দাগের কোনো পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না। দেশের দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর কোনো চরাঞ্চলে বড় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে এমনটি শোনাও যায়নি।
ফলে চরের মানুষ ভীষণরকম উন্নয়ন বঞ্চনার শিখার হচ্ছে। শুধু এই নয়, চরের মানুষের উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বরাদ্দকৃত একটাকাও খরচ হয়নি। গত দুই অর্থ বছরে চরের মানুষের উন্নয়নে বরাদ্দকৃত টাকা কেন খরচ হয়নি এ বিষয়ে সঠিক উত্তর কেউই দিতে পারেনি।
চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হলে শুধু বাজেটে বরাদ্দ নয়, একইসাথে তা বাস্তবায়নও করার দিকনির্দেশনাও থাকা আবশ্যক। একইসাথে শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, পশুপালন-এ সব ক্ষেত্রে চরে বিশেষ ধরনের বিশেষ বিশেষ উন্নয়নমূলক কর্মসূচিও চালু করা প্রয়োজন। চরের নারীদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্যও এতদিনে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত ছিল। কিন্তু কিছুই করা হয়নি।
এটি সত্য, চরাঞ্চলে অনেক ধরনের সম্পদ রয়েছে যেগুলো কাজে লাগানো গেলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব। বিশেষ চরের কৃষি জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা গেলে খাদ্যনিরাপত্তায় বড় প্রভাব রাখতে পারে। এছাড়া চরে যে জনবল রয়েছে সেই জনবলকে যদি দক্ষ, আরও কর্মক্ষম করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে চরাঞ্চলে এক ধরনের বৈপ্লাবিক পরিবর্তন আনা অসম্ভব কিছুই নয়।
আমরা দেখতে পাচ্ছি একনেকে বড় বড় প্রকল্প অনুমোদন হচ্ছে এবং কাজও শুরু হচ্ছে। কিন্তু চরের উন্নয়নে কোনো বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে খবর নেই। চরদারিদ্র্য কমাতে না পারলে আমাদের অতিদরিদ্রের হার কমিয়ে আনা এবং এসডিজিতে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা অর্জন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)