পঁচিশে বৈশাখ এসে গেল। এসে গেল বাঙালির প্রাণের কবি, আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মদিন। পৃথিবীতে কোন বাঙালিই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন বলেন না-বলেন পঁচিশে বৈশাখ। পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ, ১১ জ্যৈষ্ঠ, ৩০ শ্রাবণ-এ দিনগুলি সকল বাঙালির সুপরিচিত। দেশ-বিদেশে যতটুকু ঘুরেছি সবর্ত্র একই পরিস্থিতি দেখে মনটা আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছে।
কয়েকবার গিয়েছি অষ্ট্রেলিয়ায়। সেখানে অবস্থানরত প্রবাসী বাঙালিদেরকেও পরম শ্রদ্ধা ও মমতায় রবীন্দ্রনাথের জন্মদিবস নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উদযাপন করতে। সবগুলি অনুষ্ঠানেই আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছি-সভাপতির নির্দেশে দু’কথা বলেওছি।
বাঙলি তো রাজনীতির তরবারির আঘাতে ১৯৪৭ সাল থেকে দু’ভাগে বিভক্ত এই বিভক্তি এলো দফায় দফায় অনুষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমানের সমুদ্র সমান রক্তের বিনিময়ে-এক অসাধারণ পরিস্থিতিতে। এই বিভক্তি কিন্তু বহু বছর যাবত রবীন্দ্রনাথকে বিভক্ত করতে পারেনি। কিন্তু তা-ও পারলো অবশেষে। পারলো বিদগ্ধ জনদের হাত দিয়ে-গবেষকদের বহু গবেষণার ফলশ্রুতিতে।
এই গবেষণার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে যে দিন পঁচিশে বৈশাখ বা রবীন্দ্র জন্মদিবস পালিত হয়, পশ্চিমবাংলায় সেদিন পালিত হয় না কিন্তু সেখানেও রবীন্দ্র জন্ম তারিখ পঁচিশে বৈশাখ সে দেশের পঞ্জিকা অনুযায়ী। তবে কি আমাদের জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেছিলেন? তাঁর মা-বাবা বেঁচে থাকাকালে সম্মানিত গবেষকেরা এই উদ্যোগ নিলে তাঁরা কি তা মেনে নিতেন? মেনে নিতেন কি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং।
তেমনই হয়েছে রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকী ২২ শ্রাবণ, নজরুল জন্মবার্ষিকী ১১ জ্যৈষ্ঠ নিয়ে এবং বাংলাদেশ, ভারত ও পৃথিবীর সকল দেশে অবস্থানরত বাঙালিদের জন্মদিন নিয়েও। বিদেশে যাঁরা অবস্থান করেন তাঁরা তাঁদের সন্তানদের জন্ম তারিখ নিয়ে এই জটিলতার মুখোমুখি না হয়ে সরাসরি সন্তানদের জন্ম-রেকর্ডে ইংরেজী তারিখ লিখিয়ে থাকেন। এতে আর কোন ল্যাঠা থাকে না। ইংরেজী সাল, ইংরেজী তারিখ, হিজরী সন, হিজরী তারিখ এবং আরও আরও যে সব বর্ষ বা তারিখ ইতিহাসে পাওয়া যায়-তাদের কারও ক্ষেত্রেই কোন ল্যাঠা নেই। যত ল্যাঠা বঙ্গাব্দ নিয়ে।
বঙ্গাব্দ বাংলাদেশে যেদিন শুরু হয় পশ্চিমবাংলায় শুরু হয় তার আগের বা পরের দিন। সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, পহেলা বৈশাখ প্রভৃতি বাঙালির ঐতিহাসিক দিবস নিয়ে। কিন্তু সাধারণ বাঙালি বা শিক্ষিত বাঙালির যেহেতু জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ বার্ষিকী প্রভৃতি ইংরেজীতে রাখতে শুরু করেছে-তাই তাঁদের ক্ষেত্রেও কোন সমস্যা নেই। সমস্যা শেকসপীয়রের, জন কীটস, ম্যাক্সিম গোর্কি এবং অপরাপর শত শত বা হাজার হাজার আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিক, লেখক, রাজনীতিদদের জন্ম-মৃত্যু তারিখ নিয়ে। যত সমস্যা বাঙালির গর্বের ও অহংকারের ব্যক্তিত্ব যাঁরা-যাঁরা নিজেদের জন্ম-মৃত্যু তারিখ নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুযায়ী বাংলাতে রেখেছেন তাঁদেরকে নিয়ে। পৃথিবীতেই এ এক বিস্ময় বটে।
এ নিয়ে এক ধরণের সাম্প্রদায়িকতারও সৃষ্টি হয়েছে। এরশাদ যখন ক্ষমতায় তখন তাঁর নির্দেশে গঠিত একটি কমিটির সিদ্ধান্তে এই পরিবর্তন আনা হয় বাংলা তারিখ প্রভৃতি সংক্রান্ত ব্যাপারে। যেন বাঙালির জীবনে আর কোন সমস্যা নেই বা ছিল না। তিনি যেমন “বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হইবে ইসলাম” এই মর্মে অস্ত্রাঘাতে সংবিধান সংশোধন করলেন-ঐ ব্যাপারটাও এই চেতনাজাত।
বলছিলাম সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির কথা। যে বছর থেকে (আশির দশকে) এই পরিবর্তন কার্যকর করা হয়, তার পরের চৈত্র সংক্রান্তির দিনে পাবনা জেলার চাটমোহর থেকে টেলিফোনে ন্যাপের একজন নেতা বলে উঠলেন, “দাদা, শীগরি চাটমোহর চলে আসুন-নইলে এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে। এখানকার বিএনপি জামায়াত সে প্রস্তুতি প্রায় শেষ করে এনেছে। চাটমোহর থানা শহরে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। তখন ওখানকার এম.পি. ছিলেন একজন বি.এন.পি নেতা। বললাম, ওই এম.পি. এবং চাটমোহর থানার ও.সি’র ফোন নং দাও এবং কি নিয়ে এই উত্তেজনা সংক্ষেপে তা জানাও। ন্যাপ নেতাটি বললেন, হিন্দু ব্যবসায়ীরা আজ চৈত্র সংক্রান্তি পালন উপলক্ষ্যে পূজা-পাবর্ন করছেন কিন্তু ওরা বলছে চৈত্রসংক্রান্তি গতকাল চলে গেছে। ইন্ডিয়ার পঞ্জিকায় চৈত্রসংক্রান্তি আজ। তাই বাংলাদেশে আজ ওটা পালন করলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে।”
ফোন কেটে দিয়ে তৎক্ষণাৎ থানার ও.সি কে বললাম, বিষয়টি জরুরী ভিত্তিতে দেখুন নইলে পুলিশ নামান একটি ঘটনাও যেন না ঘটে তা দেখুন। উনি “দেখছি বলে ফোনটি রেখে দিলেন”। সঙ্গে সঙ্গে এম.পি. পাবনাকে ফোন করে জানালে তিনি বলেন, আমি তো এমন কোন খবর পাইনি। তবু দেখছি বলে ফোন রেখে দিলেন তবে চাটমোহরের ওসিকে খুবমত ধমকালেন এবং বললেন, সামান্যতম দুর্ঘটনায় যেন না ঘটে। মুহুর্তে গোটা চাটমোহর পুলিশে ছেয়ে গেল। ভয়ে পালালো ষড়যন্ত্রকারীরা।
ন্যাপ নেতাকে ফোন করে পরিস্থিতি জানতে চাইলে তিনি বললেন দাদা, অসাধারণ কাজ হয়েছে। সারা শহর পুলিশে ছেয়ে গেছে। ওসি ও অন্যান্য পুলিশ অফিসাররা হিন্দু ব্যবসায়ীদেরকে নিজেদের মত করে নির্ভয়ে পূজা-পার্বন করুন। কোন সম্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে থানায় জানাবেন।
বললাম, তোমরাও কর্মীদের নিয়ে সম্ভব হলে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী শান্তি মিছিল বের করো।
এভাবে সেদিনকার চাটমোহরের সম্ভাব্য রক্তারক্তি প্রতিরোধ করা গেল। কিন্তু ভাবতে হবে এমন পরিস্থিতি কেন হলো? পঞ্জিকার পরিবর্তন না হলে তো এই অশান্ত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতো না।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির জীবনে বিশেষ একটি দিন। জমিদারী মহাজনী আমলে দেখেছি ঐ দিন তাঁরা নিজ নিজ গদীতে নতুন খাতা খুলে বসতেন, প্রজারা বা ক্রেতারা এসে দেনা-পাওনা পুরোপুরি বা আংশিক শোধ করতেন। জমিদার-মহাজনেরা প্রজা ও ক্রেতাদেরকে মিষ্টিমখু করাতেন।
দিনে দিনে পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতি তার সকল বৈচিত্র্য সহকারে বাঙালির সামনে পৃথিবীর সামনে তার সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয়। নাচে, গানে, মিছিলে, আলোচনা সভায়, চারুকলা ইনষ্টিটিউটের তৈরী নতুন নতুন শিল্পকলা, মুখোশ প্রভৃতি সহকারে নৃত্য ও বাদ্য সহকারে মিছিল ঢাকা শহর এবং বাইরেরও কোন কোন শহর সে বৈচিত্র্যে বিমোহিত হয়। বস্তুত: নববর্ষ সকল জাতির কাছেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি দিন।
অথচ এ দিনের ঐতিহ্যবাহী ঐক্যও আমরা সংস্কারের নামে বিনষ্ট করেছি। রবীন্দ্র, নজরুল এবং আরও আরও গৌরবের ঐতহ্যিবাহী কবি-সাহিত্যিকদের জন্ম-মৃত্যু দিবসের সাথে অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে-যাকে বিভক্ত করা যায় না। কিন্তু তবু সে বিভক্তি আনা গেল সামরিক কর্তার অস্ত্রাঘাতে।
সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশী বাঙালিরা একদিন, পশ্চিমবাংলাসহ অন্যান্য স্থানের প্রবাসী বাঙালিরা অন্যদিন পহেলা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, ১১ জ্যৈষ্ঠ প্রভৃতি পালন করে থাকেন আমাদেরই ক্রীত পরিবর্তনের ফলে। বিদেশীদের কাছে এ এক হাস্যকর পরিস্থিতি আর বাঙালিদের জন্য এবং জাতীয় কবি সাহিত্যিকদের জন্য অবমাননাকর।
তাই ঐক্যের স্বার্থে, হাস্যকর ও অবমাননাকর পরিস্থিতি এড়ানোর স্বার্থে, বাঙালির জাতীয় কবি সাহিত্যিকদের জন্ম-মৃত্যুদিবস পৃথিবীব্যাপী একই দিনে পালনের স্বার্থে আমাদের পুরাতন পঞ্জিকাকে-যেটি এই পরিবর্তনের আগে পর্যন্ত সকল বাঙালি বিনা বাক্য ব্যয়ে পালন করছিলেন-অবিলম্বে পুনরুজ্জীবন করা হোক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)