চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘নিষিদ্ধ’ সাংবাদিক এবং কয়েকটি প্রশ্ন

বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন! এ নিয়ে সাংবাদিকরা স্বভাবতই ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। সক্রিয় রিপোর্টিং এ থাকাকালীন পুজিঁ বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) এই ধরনের একটি সিদ্ধান্তে আমি নিজেও ক্ষুব্দ হয়েছিলাম। এসইসির এই ধরনের ‘নিষেধাজ্ঞা’য় আমার নিজের এসইসিতে যাওয়া আসা, কারো সঙ্গে কথা বলায় সমস্যা সৃষ্টি করেনি।

কার্যত, সেই ‘নিষেধাজ্ঞা’টা আমার ক্ষেত্রে প্রয়োগও হয়নি। তবু ডাকসাইটে আমলা প্রয়াত এম এ সাঈদের সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম এবং এসইসি সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছিলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে ঢাকার সাংবাদিক বন্ধুদের ক্ষোভের সঙ্গে একমত পোষন করি। সাংবাদিক বন্ধুদের একটি প্রশ্ন করি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অবাধে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া না দেওয়াতে পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কি এমন হেরফের হয়। রিজার্ভের টাকা হ্যাক হওয়ার পরবর্তী এক মাসে যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ম্যানিলা- কলম্বো দৌঁড়াচ্ছিলেন তখনো কিন্তু সাংবাদিকদের প্রবেশে কোনো বিধি নিষেধ ছিলো না। সে সময়ও তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে গেছেন, বড় বড় কর্মকর্তাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে চা খেয়েছেন, গল্প করেছেন। অথচ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থ লোপাটের ঘটনাটিই তারা টের পাননি!

সে সময় যদি তাদের বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশে বিধিনিষেধ থাকতো- তা হলে এটিকে আমরা সাংবাদিকতার ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা করার আগে দুবার তর্ক করতাম। একন কি করবো? রিজার্ভ চুরির ঘটনার পরও কি সাংবাদিকরা সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য উপস্থাপন করতে পেরেছেন? পারেননি।বরং ফিসসফাস যা শুনে এসেছেন- কোনো ধরনের বাছ বিচার ছাড়াই অনেকে সেগুলো লিখে দিয়েছেন।

অথচ তাঁদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশাধিকার ছিলো- এই সময়ে। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক এর বিরুদ্ধে মামলা করার আইনগত দিক খতিয়ে দেখছে- বাংলাদেশ ব্যাংক- এই তথ্য দিয়ে একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে দেশি বিদেশি পত্রিকায়। কেউ কেউ লিখেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক মামলা করছে, কেউ কেউ লিখেছেন মামলা করার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।

প্রত্যেকেই লিখেছেন- নিউইয়র্কের একজন আইনজীবীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ আইনজীবীর নাম লিখেননি। দেশি সংবাদ মাধ্যম বাদ দেই, বিবিসি, রয়টার্সএও আইনজীবীর নামটি নেই। কেন? এটি কি রিপোর্টের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য নয়?

কোনো রিপোর্টার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কথা বলতে রাজি হয়নি, এমন তথ্যও কিন্তু রিপোর্টগুলোতে নেই। রিপোর্টের এই যে ত্রুটি, তথ্যের এই যে ঘাটতি তার সঙ্গে কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেতে পারা না পারার কোনো সম্পর্ক আছে?বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করছে- এটা অনেক বড় ঘটনা। কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর বা কোনো কর্মকর্তা এমন কি বাংলাদেশ ব্যাংক একাই এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এর সঙ্গে কূটনীতির ব্যাপার আছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ব্যাপার আছে।

ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা হতে হলে সরকারের নীতি নির্ধারনী পর্যায় পর্যন্ত আলোচনার ব্যাপার থাকে। ঢাকার রিপোর্টাররা সংবাদটি পরিবেশনের আগে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েছিলেন কি?

এখন জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক নিউইয়র্কের কোনো আইনজীবীর সাথে কথা বলেনি। তারা নিজেদের প্যানেল আইনজীবী যিনি/যারা আছেন- তাদের এই ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখতে বলেছেন। সেই প্যানেলে দেশের প্রবীন এবং খ্যাতিমান একজন আইনজীবী আছেন, তিনি ব্যাপারটা বিশ্লেষন করছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীন আইন উপদেষ্টার তথ্য যাচাই মিডিয়ার খবরে ‘নিউইয়র্কের আইনজীবী নিয়োগ’ হয়ে গেলো কিভাবে? সাংবাদিক বন্ধুরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, রিজার্ভ লুটের স্পর্শকাতর সময়ে যে কোনো ‘বিভ্রান্তিকর’ খবর আরো বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে পরষ্পর সম্পর্কযুক্ত দুটি প্রতিষ্ঠানকে জড়িয়ে কোনো ধরনের ‘বিভ্রান্তিকর’ খবর দেশের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। সাংবাদিকদের অবাধে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে দিলেই কি এইসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? যাবে না। কেননা, এগুলো হচ্ছে ‘কোয়ালিটির’ সমস্যা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভবনে ঢুকতে দেওয়া না দেওয়ার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নাই।

পশ্চিমা দেশগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা কালে ভদ্রে মিডিয়ার সামনে আসেন। যখন আসেন- তখন তারা শিরোনাম হন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো দুরের কথা- কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই বিনা এপয়েন্টমেন্টে কেউ যেতে পারেন না। সাংবাদিকদের যোগাযোগের নিজস্ব একটি কেন্দ্র আছে, সেই কেন্দ্রেই তারা যোগাযোগ করেন।

বলাই বাহুল্য, সেই যোগাযোগটি তারা করেন ইমেইলে। টেলিফোনে তারা যতো কথাই বলুক না কেন- আমি কি জানতে চাই- তার বিবরন সহ ইমেইল পাঠাতে হবে। তারাও জবাব দেবেন ইমেইলে। আর বাইরে আর কোনো যোগাযোগের ব্যাপার নাই। সাংবাদিকতার সোর্স তৈরি এবং তা চর্চার দায় দায়িত্ব তারা নেয়  না।

নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। রিজার্ভ এর টাকা চুরি হওয়ার ঘটনা নিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের সঙ্গে অসংখ্যবার যোগাযোগ হয়েছে। ফেড এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এন্ড্রিয়া প্রিস্ট এই মুহুর্তে ব্যাংকের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। তার সাথে যতোবারই যোগাযোগ করেছি স্বল্পতম সময়ে তিনি ফিরতি ইমেইল পাঠিয়েছেন। এখন পর্যন্ত ইমেইলের জবাব দিতে সর্বোচ্চ সময় নিয়েছেন ১৭ মিনিট। সবচেয়ে কম সময়ে যে জবাবটি তিনি পাঠিয়েছেন- সেটি হচ্ছে ৩ মিনিট। মার্কিন কংগ্রেসউওম্যান ক্যারোলিন ম্যালোনিকে পাঠানো প্রশ্নগুলোর উত্তরও পাওয়া গেছে দেড় ঘন্টার ব্যবধানে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে আসলে এমন একটি ব্যবস্থা থাকা দরকার, যেখানে রিপোর্টাররা তাদের সমুদয় প্রশ্নের উত্তর পাবেন, যেটা হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কোনো ঘটনা ঘটলে সেটি দেশবাসী জানার অধিকার রাখে। জনগনের সেই জানার আকাঙ্ক্ষা পূরনেই কাজ করেন সাংবাদিকরা। ফলে তাদের সব ধরনের জিজ্ঞাসারই উত্তর দেওয়ার মতো ব্যবস্থা থাকা দরকার ।

ঢাকার সাংবাদিকদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশাধিকারের আন্দোলনের পাশাপাশি তাদের ‘নিউজ জাজমেন্টের সক্ষমতা’র বিষয়টি পূণরায় বিশ্লেষণ করার, পর্যালোচনা করার অনুরোধ করি। ঢাকার আইনজীবী আজমালুল হক কিউসি’ কিভাবে নিউইয়র্কের আইনজীবী হয়ে যান- এই প্রশ্নের উত্তর না খুজেঁ, কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশাধিকারের আন্দোলন করলেই সাংবাদিকতার অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)