সঞ্চালক ঘোষণা করলেন, এবার বাংলাদেশের পরিবেশনা। মঞ্চে আসছেন মীর লোকমান। সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের তুমুল হর্ষধ্বনি। সবার মুখে ‘বাংলাদেশ’ নাম। শব্দের ছন্দে ছন্দে মীর লোকমানের মূকাভিনয় শুরু হলো। জনপ্রিয় ’রোবট মানব’ দিয়ে শুরু। এরপর একে একে ‘ভালোবাসার গল্প’, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনের গল্পনির্ভর ‘জীবন যেখানে যেমন’, বাংলার পল্লী গ্রামের চিরচেনা ‘দঁড়িটান’ খেলা এবং সবশেষে ‘ওভারকাম’।
সকল বাঁধা তুচ্ছ করে, সকল প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে কীভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা–ই দেখানো হয় এসব গল্পে। যেমন আনন্দ, মজা, মাস্তি, ভালোবাসার গল্প থাকে, তেমনি থাকে শত বাঁধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। বিশেষত ‘ওভারকাম’ গল্পটি। এটি বাংলাদেশের গল্প, প্রতিটি বাঙালির গল্প, জাতির গল্প। এই গল্পে ঠিক বাংলাদেশের অগ্রগতিই ফুটে উঠেছে। ফুটে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতির নানা দিক। আর্মেনিয়ানদের কাছে এই সংস্কৃতি একদম নতুন। দেশটি বেশ এগিয়ে। এখানে কোন পথশিশু নেই, কোন ভিক্ষুকও দেখতে পাইনি। ফলে বাংলাদেশের পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত গল্পগুলো তাদের কাছে অপরিচিত। ইত:পূর্বে দেশটিতে বাঙালি সংস্কৃতি পরিচয় করানোর মতো কোন কিছু হয়েছে কিনা তার কোন তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবু তারা উপভোগ করছেন। হর্ষধ্বনি দিচ্ছেন। মূকাভিনয় বলেই তা সম্ভব হয়েছে।
আর্মেনিয়ার অপূর্ব প্রাকৃতিক শহর সাখকাদজরে গতকাল ২৪ জুলাই সোমবার দিনটি ছিল অদ্ভূত সুন্দর। একজন বাংলাদেশি হিসেবে আনন্দের, গর্বের। এদিন আমরা লাল-সবুজ পতাকা তুলে ধরেছি সুদূর পূর্ব ইউরোপের এই দেশটিতে। এখানে আসার পর এমনিতেই আমাদের প্রতি আর্মেনিয়ানদের আগ্রহের কমতি ছিল না। সবাই বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের সাথে মিশছেন, ঘুরছেন। আমাদের ভাষা আলাদা। কিন্তু পরস্পরকে বুঝতে খুব বেগ পেতে হয়নি। আমরা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে মোটামুটি সবকিছু চালিয়ে নিতে পারলেও হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া এখানকার সবাই আর্মেনীয় আর রুশ ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় অভ্যস্ত নন। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ইংরেজি তারা ব্যবহার করেন না। আন্তর্জাতিক এই উৎসবের ব্যানারে, অনুষ্ঠানসূচি সব ক্ষেত্রে তারা লিখেছেন আর্মেনীয় ভাষা। তারপর ইংরেজিতে। দুটি ভাষাতেই লেখা। শুধু কি তাই, এত বড় উৎসবের মঞ্চে উপস্থাপনা চলছে আর্মেনিয়ান ভাষাতেই। উপস্থাপককে অনেক সময় দু’ভাষাী নিয়ে কথা বলতে হয়!
তারপরও আমাদের চলাফেরা, কথাবার্তায় সমস্যা হচ্ছে না। অনেক সময় বুঝে নিয়েছি নিজ নিজ ভাষাতেই। এখানে আসার পর আয়োজক এবং স্থানীয় দর্শকদের কাছে আমাদের চেহারা এবং আমাদের দেশের নামটি এরই মধ্যে ভালোভাবে চেনা জানা হয়ে গেছে। আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানের একটি জেলার নাম ‘বাংলাদেশ’ থাকায় সেটিকে আরও সহজ করে দিয়েছে।
মীর লোকমানের মূকাভিনয়ের সময় দর্শকদের হর্ষধ্বনি আর বাংলাদেশ স্লোগান শুনে বারবার হচ্ছিল বাংলাদেশের কোনো মঞ্চে প্রদর্শনী হচ্ছে, যেন সেই চিরচেনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মঞ্চ। আর উপস্থাপকের মুখে বারবার বাংলাদেশ প্রশংসা বাণী বলে দেয় আর্মেনিয়ায় বাংলাদেশের নামটি ভালোভাবে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি আমরা।
গত ২২ জুলাই শনিবার আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভানের নিকটবর্তী সাখকাদজরে দেশটির সংস্কৃতিমন্ত্রী আর্মেন আমিরিয়ানের উদ্বোধনী বক্তৃতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ‘লিওনিড ইয়েঙিভারিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল ২০১৭। বিশ্বের ৮টি দেশ এই উৎসবে অংশ নিয়েছে। জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, বাংলাদেশ, চেকপ্রজাতন্ত্র, নাগার্নো কারাবাখ আর স্বাগতিক আর্মেনিয়ার অনেকগুলো মূকাভিনয় দল। রাশিয়া থেকে এসেছে তিনটি দল। একেকদিন একেক দলের মূকাভিনয় হচ্ছে। বাংলাদেশ দলের পরিবেশনা ছিল গতকাল ২৪ জুলাই সোমবার। স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে ৪টায় বাংলাদেশ টিমের প্রদর্শনী শুরু হয়। মীর লোকমান মঞ্চে আর আমি শব্দ নিয়ন্ত্রণে। এই হলো দু’জনের টিম আমাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করছি আমরা, বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি পূর্ব ইউরোপের দেশ আর্মেনিয়ায়।