চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বাংলাদেশ কি ভোটারবিহীন একক প্রার্থীর নির্বাচনের দিকে?

মানুষ ক্রমশ ভোট দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে৷ যার প্রমাণ ঢাকা উত্তর সিটির উপনির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন৷ ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা, নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকার এবং নির্বিঘ্নে ভোট দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টির দাবিতে ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’ একক পদযাত্রা শুরু করেছেন হানিফ বাংলাদেশি নামের এক যুবক।

উপজেলা নির্বাচনের পর পর ১৪ মার্চ, বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায় কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলা হতে পদযাত্রা শুরু করেন তিনি। ৪০ কিলোমিটার হেঁটে তিনি উখিয়া উপজেলায় অবস্থান করবেন। পরদিন সকালে উখিয়া থেকে আবার পদযাত্রা শুরু করবেন হানিফ বাংলাদেশি। পথে পথে তিনি মানুষের সাথে কথা বলছেন এবং ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি সংবলিত লিফলেট বিতরণ করে যাচ্ছেন৷ সংবাদ পত্র সূত্রে এমন কথাই জানা গেল৷

উপজেলা পরিষদ নির্বাচন-প্রথম ধাপউপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রথম চার ধাপ মিলে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হচ্ছেন নৌকা প্রতীকের অন্তত ১১০ জন প্রার্থী। বুধবার (১৩ মার্চ) চতুর্থ ধাপের ১২২টি উপজেলায় মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে সরে যান বেশ কয়েকটি উপজেলার নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এতে অন্তত ৪০টি উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ভোট করতে হচ্ছে না।

প্রথম ধাপে বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন ১৫ জন। দ্বিতীয় ধাপে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিনা ভোটে জিতেছেন ২৫ জন ও তৃতীয় ধাপে ৩০ জন। চার ধাপেই বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে অন্তত ১১০ জনে।এবার পাঁচটি ধাপে নির্বাচন হচ্ছে দেশের ৪৯০টি উপজেলায়। এই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করছেনা৷ এসব নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হলেও দলীয় কোন প্রতিযোগিতা নেই এতে৷ মানুষ রাজনৈতিক দলের ডাকে এখন আর সাড়া দিতে চাচ্ছেনা৷ সেজন্যই ২০১৩ সালে দল নিরপেক্ষ ভাবে শাহবাগে জেগে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চ৷ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের আহবান৷গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রও কোন সংগঠনের নেতাকে বানানো হয়নি৷

মুখপাত্র হয়ে ওঠেন এক অচেনা অজানা অজ্ঞাত যুবক ইমরান এইচ সরকার৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার ও চাকরীর বয়স সীমা বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলনেও কোন সংগঠনের নেতাকে নেতা হতে দেখা যায়নি৷ এর নেতা হয়ে ওঠেন নুরুল হক নূর৷ । দুইজনই এসেছেন রাজনীতির প্রথাগত ব্যবস্থার বাইরে ও সাধারণ পরিবার থেকে।অনেকটা দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা জেএনইউএসইউ’য়ের কানহাইয়া কুমারের উত্থানের মত। তবে এদেশে এদের বেশি বাড়তে দেওয়া হয় নি থামিয়ে দেয়া হয়েছে৷ এযুগের এসব চরিত্রের মধ্য দিয়ে রাজনীতির ব্যর্থতার দিক ফুটে উঠেছে৷ মানুষ যে চলমান রাজনীতির প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে এগুলো তারই প্রমাণ। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান ইস্যু মুক্তিযুদ্ধ, ইসলাম, চাকরির নিশ্চয়তা ও যানজটমুক্ত নিরাপদ সড়ক। এগুলোর জন্য মানুষ প্রচলিত দলগুলোর প্রতি আর কোন ভরসা রাখতে পারছেনা৷

গণজাগরণ মঞ্চের অভ্যন্তরীণ জটিলতায় ইমরান এইচ সরকারের উত্থান থেমে গেল। তিনি সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জিততে পারলেন না৷ কিন্তু সঙ্ঘবদ্ধ প্রোপাগান্ডা প্রতিহত করে ডাকসুর ভিপি হয়ে গেলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নূরুল হক নূর। এই স্বীকৃতি মূলত ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ,ছাত্রদল ও বামধারার রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে নতুনধারার রাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষার জয়। মানুষ কেন প্রচলিত রাজনীতি বিমুখ হয়ে উঠছে? উপজেলা নির্বাচনেও মানুষের নির্বাচনী আস্থা হ্রাস পেল৷এ নির্বাচনেও নিয়মনীতি উপেক্ষা করে দেখা গেল ক্ষমতার আধিপত্য৷ নির্বাচনে দেখা গেছে নৌকার এমপি চলে গেছে নৌকার বিপক্ষে৷ নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগের মধ্যেই৷ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ নাসিম এমপি সম্প্রতি বললেন, বিএনপি-জামায়াত হলো ভয়ঙ্কর। আরো ভয়ঙ্কর অতিভক্ত আওয়ামী লীগার। ৭ মার্চ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু একাডেমি আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি৷ তিনি আরো বলেন, এখন সবাই আওয়ামী লীগার হয়ে গেছেন। যেদিকে তাকাই শুধু আওয়ামী লীগ। তবে অতিভক্তি ও অতি উৎসাহী আওয়ামী লীগার নিয়ে বেশি ভয় হয়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের আগেও মনে হচ্ছিল সবাই আওয়ামী লীগার। বাকশাল ও আওয়ামী লীগ ছাড়া যেন আর কিছুই নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর অনেককেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই এখন বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে অতিভক্ত আওয়ামী লীগারদের নিয়ে বেশি ভয়।এই কথাটাই আজকের সময়ের চরম সত্য নয় কি?মানুষের এমন ভোটবিমুখ হয়ে ওঠা কি ভয়ের নয়?

উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তারাও বলছেন,সুষ্ঠুভাবে ভোট হলেও ভোটারের উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। প্রথমধাপের উপজেলা নির্বাচনে রাজশাহীর বাগমারায় সর্বনিম্ন ভোট পড়েছে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। ৬টি উপজেলায় ৩০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে। ৭৮টি উপজেলায় গড়ে ভোট পড়েছে ৪৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। ভোটারদের এই ক্রমহ্রাসমান উপস্থিতি কিসের ইঙ্গিত?৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনেও ভোট কম পড়েছিল। ওই নির্বাচনে ৩১ দশমিক ০৫ শতাংশ ভোট পড়ে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে পাঁচ বছর আগে ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দফায় ৯৭টি উপজেলায় গড়ে ৬২ দশমিক ৩৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। আর ১০ বছর আগে ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি একদিনে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ৪৭৫টি উপজেলায় ভোট প্রদানের হার ছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ৷ ভোটার কি দিন দিন বাড়ে না কমে?প্রতি বৎসরই ভোটার বাড়ছে তবুও ভোটার উপস্থিতি কেন কমছে?

ভোটার বাড়ছে আর ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি কমছে এটা কি উল্টোযাত্রা নয়?১০ মার্চের নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে অনেকেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন৷ সমর্থক নেতাকর্মীরা এই জয়ের জন্য অভিনন্দনও দিচ্ছে তাদেরকে৷ তাদের এই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা যে ভোটারদের ভোটদানের অধিকার হরণ করল এই বোধ কি আছে কারও মধ্যে?ভোটারদের মধ্যে কতজন তাদেরকে সমর্থন করেছে?নাকি সমর্থনের কোন প্রয়োজন বোধ করছেনা তারা?

উত্তর কোরিয়ায় রোববার (১০মার্চ) অনুষ্ঠিত হয়েছে সাধারণ নির্বাচন। দেশটিতে একক প্রার্থীর জাতীয় নির্বাচনে এবারে ভোট পড়েছে ৯৯.৯৯ শতাংশ। এমনটি জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম কেসিএনএ। কেসিএনএ-এর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এবারের নির্বাচনে ৯৯.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে. যা ২০১৪ সালের নির্বাচনে ছিল ৯৯.৯৭ শতাংশ।

এবারে জাতীয় নির্বাচনে ১০০ শতাংশ ভোট না পরার কারণ হিসেবে কেসিএনএ জানায়, কিছু লোক বিদেশে থাকার কারণে ও সমুদ্রে কাজ করার জন্য ১০০ শতাংশ ভোট পড়েনি। বাংলাদেশে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা প্রার্থীদের ভোটারদের এমন সমর্থনেরও কোন প্রয়োজন হয়নি৷

উত্তর কোরিয়ার সংসদ ‘সুপ্রিম পিপলস অ্যাসেম্বলি’র (এসপিএ) নির্বাচনে প্রতিটি আসনেই প্রার্থী ছিল মাত্র ১জন। কোনও আসনেই বিকল্প প্রার্থী ছিল না।সরকারি তালিকার বাইরে দেশটিতে অন্য কারও প্রার্থী হওয়ারও সুযোগ নেই দেশটিতে৷ বাংলাদেশও কি এমন একক প্রার্থীর নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে?কিন্তু সেখানেওতো ভোটারদের সমর্থনের প্রয়োজন হয়৷

বাংলাদেশের নির্বাচনেতো তাও অনুপস্থিত৷ কেন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা একক প্রার্থীদের ব্যালট রেখে তাদের সমর্থন যাচাই করলে এমন কি সমস্যা হতো নির্বাচন কমিশনের?সেটা যাচাই না করেই তাদের বিজয়ী ঘোষণা করা কি ভোটারদের অবমূল্যায়ন নয়?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)