টস জিতে অধিনায়ক মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা আগে বোলিং নেয়ার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক জেসন হোল্ডার বললেন, টস জিতলে আমরাও হয়তো বলই করতাম। তবে আগে ব্যাটিংও খুব খারাপ নয়। স্কোরবোর্ডে তো বড় রান জমার একটা সুযোগ থাকে। সেক্ষেত্রে প্রথম ১০ ওভার হয়তো আমাদের লড়াই করতে হবে। পরে তো আমাদের ফায়ার পাওয়ার আছেই।
প্রথম ইনিংস শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়কের কথা অনেকটাই খেটে গেল। শুরুতে বাংলাদেশের বোলারদের সামনে লড়াই করতে হল তাদের ব্যাটসম্যানদের। মিডল-অর্ডারের হিসেবি ব্যাটিংয়ের পর শেষদিকে হোল্ডারের সেই ফায়ার পাওয়ারই দেখা গেল। গেইলের কষ্ট ভুলে একে একে জ্বললেন লুইস, হোপ, হেটমায়ার ও হোল্ডার নিজে। তাতেই বাংলাদেশের সামনে ৩২২ রানের টার্গেট দাঁড় করাল ক্যারিবীয়রা।
এই রান তাড়ায় বাংলাদেশের প্রেরণা হতে পারে ২০১৫ বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের আসরে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১৮ রান তাড়া করে জিতেছিল টাইগাররা। ওই ম্যাচে ৩২২ রান করে তারা। যেটা বিশ্বকাপ ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানতাড়া করে জেতার রেকর্ড।
আগে বোলিং নেয়ার যুক্তি শুরুতে ভালোই প্রমাণ করেন বাংলাদেশের বোলাররা। অধিনায়কের নিজের করা প্রথম ওভার থেকে কোনো রানই নিতে পারেননি ক্রিস গেইল। মাশরাফীর টানা বোলিংয়ের সঙ্গে সাইফউদ্দিন ভালো তাল মেলালে প্রথম দশ ওভার একরকম জালের মধ্যেই আটকে ছিল উইন্ডিজ। ওল্ড ট্রাফোর্ডের বাড়তি বাতাস কাজে লাগিয়ে একের পর এক সুইংয়ে দিশেহারা করেন ‘ইউনিভার্স বস’ গেইল ও তার সঙ্গী এভিন লুইসকে। শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের সেই বোলিং জাল ছিঁড়ে আকাশেই উড়ল ক্যারিবীদের রানের ঘুড়ি।
ইনিংসের চতুর্থ আর সাইফউদ্দিনের করা দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলটি ঠিকমতো খেলতে পারেননি গেইল। দ্বিতীয় বলে আর রক্ষা হয়নি। অফস্টাম্পের বাইরে কিছুটা আউটসুইং করা বল খেলতে গেলে ব্যাটের কানায় লাগে। নিজের বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্দান্ত ক্যাচ নেন এ বিশ্বকাপেই উইকেটের পেছনের কারণে সমালোচনার শিকার মুশফিকুর রহিম।
বাংলাদেশের বিপক্ষে বিশ্বকাপে আগের তিন ম্যাচে ক্রিস গেইলের স্কোর ০, ১ ও অপরাজিত ৩৭ রান। এবারও সেই স্কোর ছাড়িয়ে যেতে পারলেন না। খালি হাতে ফেরার আগে খেলে যান ১৩টি বল।
৩০০ বা তার বেশি ওয়ানডে খেলেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শূন্যরানে আউট হওয়ার তালিকায় গেইল চার নম্বরে। তার চেয়ে বেশিবার খাতা খোলার আগে আউট হয়েছেন কেবল সনাথ জয়সুরিয়া (৩৩), শহিদ আফ্রিদি (২৭) ও মাহেলা জয়বর্ধনে (২৬)। বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ২৫তম বার শূন্যতে ফিরলেন গেইল। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে এই সংখ্যা ৪৩। এই তালিকায় তার চেয়ে এগিয়ে শুধু জয়সুরিয়া ও জয়বর্ধনে।
প্রথম ১০ ওভার বেশ দেখে খেলেও গেইলের উইকেট হারাতে হয় উইন্ডিজকে। কিন্তু শাই হোপ ক্রিজে আসতে ছবিটা পাল্টে যায়। হোপকে পাশে পেয়ে যেন নিজেকে ফিরে পান টানা বাজে ফর্মের মধ্যদিয়ে যাওয়া লুইস। বিশ্বকাপের প্রথম হাফসেঞ্চুরি তুলে নেন তিনি। ছয় ম্যাচ পর ফিফটির দেখা পেলেন। এটি তার ক্যারিয়ারের চতুর্থ হাফসেঞ্চুরি। সবশেষটি করেছিলেন গত বছরের মার্চে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।
চাপ কাটিয়ে উল্টো বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ান লুইস ও হোপ। তখন সাব্বির রহমানের হাতে ক্যাচ বানিয়ে লুইস কাঁটা উপড়ে ফেলেন সাকিব আল হাসান। যাওয়ার আগের হোপের সঙ্গে ১১৬ রানের অতি দরকারী জুটি গড়ে যান তিনি। ৬৭ বলে ছয়টি চার ও দুই ছক্কায় করেন ৭০ রান।
লুইসের পথ ধরে ফিফটি তুলে নন হোপও। ৭৬ বলে ক্যারিয়ারের ১২তম হাফসেঞ্চুরি করেছেন। বিশ্বকাপে এটি তার দ্বিতীয় ফিফটি। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেন ৬৮ রান। তার এই ফিফটি ছিল বেশ ধীরগতির। চলতি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ১০০ রান করেছেন এমন ৩১ জন ব্যাটসম্যানের মধ্যে হোপের ফিফটি সবচেয়ে ধীরগতির। তবে ধীরগতির হলেও অবস্থার বিচারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য এমন একজন ব্যাটিং অ্যাঙ্করই দরকার ছিল।
লুইস ফেরার পর হোপের সঙ্গে আবার জুটি জমিয়ে তোলেন নিকোলাস পুরান। হোপ একটু দেখেশুনে খেললেও বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই রান করতে থাকেন তিনি। কিন্তু শুরু করেও ব্যাটের গতি ধরে রাখতে পারেননি। উড়িয়ে মারতে গিয়ে লংঅনে সৌম্য সরকারের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাকিবের দ্বিতীয় শিকার হন পুরান (২৫)। এই ছোট ইনিংসেও অবশ্য একটা ছাদ ফুটো করা ছক্কার মার আছে তার।
ক্রিজে এসেই বিধ্বংসী চেহারায় শিমরন হেটমায়ার। উইকেট গেলেও তার শরীরী ভাষা বলছিল, আক্রমণের জন্যেই এসেছেন। তার মেজাজের সামনে কচুকাটা হয়েছেন, আক্রমণে এসেছেন যিনিই। অস্ট্রেলিয়ার অ্যালেক্স ক্যারির সঙ্গে যৌথভাবে দ্রুততম হাফসেঞ্চুরি করেন হেটমায়ার। ২৫ বলে চারটি চার ও তিন ছক্কায় ফিফটি পূরণ করার পর মোস্তাফিজুর রহমানের বলে আউট হন। তার আকাশে তোলা বল অনেকখানি দৌড়ে গিয়ে উড়ন্ত অবস্থায় লুফে নেন তামিম ইকবাল। টর্নেডো ইনিংস খেলার এক ফাঁকে সাইফউদ্দিনের বুলেট থ্রো থেকে নিশ্চিত রানআউট থেকে রক্ষা পান তিনি।
ফেরার আগে অবশ্য আরও একটি মাইলফলক স্পর্শ করেন হেটমায়ার। চতুর্থ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে এক হাজার রান পূর্ণ করেছেন। ভিভ রিচার্ডস এক হাজার রান করেছিলেন ২১ ইনিংসে, বাংলাদেশের সাবেক কোচ গর্ডন গ্রিনিজ ২৩ ও রামনরেশ সারওয়ান ২৭ ইনিংসে এক হাজার রান করেন। আর হেটমায়ার করলেন ২৮ ইনিংসে।
হেটমায়ার ফেরার পর বেশ দম নিয়েই ক্রিজে আসেন আন্দ্রে রাসেল। মাঠে প্রবেশের পর ক্রিজের কাছাকাছি এসে তার ব্যাট ঘোরানো দেখে যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তবে রাসেলের আসা-যাওয়ার মধ্যে ব্যবধান কেবল দুই বল। মোস্তাফিজের একই ওভারে দ্বিতীয় শিকার হন রাসেল (০)।
এর আগে ওয়ানডে ম্যাচে আটবার বাঁহাতি স্পিনারের বলে আউট হয়েছেন আন্দ্রে রাসেল। বাঁহাতি স্পিনারের বিপক্ষে ওয়ানডেতে তার ব্যাটিং গড় ৮.৩৭। পুরো স্পিনের বিপক্ষে দুর্বলতা আছে রাসেলের। বাংলাদেশের স্পিনারদের বিপক্ষে ছয় ইনিংসে তার গড় ৬.২। তবে এবার স্পিনে নয়, আউট হলেন বাঁহাতি পেসে।
আউট হয়ে নিজের কাজ যেন হোল্ডারের কাঁধে দিয়ে যান রাসেল। আর সেটা ধরে নিয়েই ঝড় তুললেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক। দুইশ’র উপর স্ট্রাইকরেটে মাত্র ১৫ বলে ৩৩ রান করেন হোল্ডার। তার স্বল্পদৈর্ঘ্যর ইনিংসে চারটি চারের সঙ্গে দুটি বিশাল আকারের ছয়ের মার থাকল।
তবে অন্যদের নানা রকম গল্পের ফাঁকে নিজের কাজটা নীরবে করে যান হোপ। ধীরগতির ফিফটাই শেষ পর্যন্ত তিন অঙ্কে রূপ দিতে পারেননি। ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বার নার্ভাস নাইনটির শিকার হয়ে আউট হন ৯৬ রানে। ১২১ বলের ইনিংসে মাত্র চারটি চার ও এক ছক্কার মার।
৫৯ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে বাংলাদেশকে যেন প্রিয় প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছেন তিনি। ক্যারিয়ারে যেখানে মোট সেঞ্চুরি ছয়টি, সেখানে বাংলাদেশের বিপক্ষেই তিনটি। ১১টি হাফসেঞ্চুরির মধ্যে চারটি আছে বাংলাদেশের বিপক্ষে।
হোপ ফিরে গেলে ড্যারেন ব্রাভোর ব্যাটে চড়ে ৩০০ অতিক্রম করে উইন্ডিজ। ইনজুরি আক্রান্ত কার্লোস ব্র্যাথওয়েটের জায়গায় এই ম্যাচে সুযোগ পেয়ে ১৯ রান করেন ব্রাভো। আর শেষ পর্যন্ত ক্যারিবীয়দের স্কোর দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ৩২২ রান।
বাংলাদেশের হয়ে সাইফউদ্দিন, মোস্তাফিজ তিনটি করে উইকেট নিয়েছেন। সাকিব পেয়েছেন দুটি।
বাংলাদেশ এই ম্যাচে তিনজন স্পিনার নিয়ে খেলছে। বিপরীতে স্কোয়াডে কোনো স্পিনার রাখেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দুদল যে পুরো ভিন্ন কৌশল নিয়ে নেমেছে সেটা স্পষ্ট। কৌশলটা শেষ পর্যন্ত কারা কাজে লাগাতে পারে সেটা অবশ্য ম্যাচ শেষেই বোঝা যাবে।