এক
এ কথা কোনোভাবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাষ্ট্র গঠনের একটি অন্যতম প্রধান উপাদান হলো জনসংখ্যা। একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হতে পারে সে দেশের দক্ষ জনসংখ্যা। উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা তাদের গবেষণা ও বক্তব্যে একথা সব সময় বলে আসছেন। তারা বলছেন, একটি দেশের সুষম উন্নয়ন আর সুদৃঢ় অগ্রযাত্রা অনেকাংশে নির্ভর করে জনসংখ্যার সঠিক কর্মকাণ্ডের ওপর। এক্ষেত্রে সেদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও নীতি নির্ধারকদের গৃহীত পদক্ষেপও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আশার কথা, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘনবসতি পূর্ণ অধিক জনসংখ্যার দেশ বলে বিশ্বে স্বীকৃত বাংলাদেশকে একটি কাঠামোর মধ্যে রেখে উন্নয়নের সড়কে দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অধিক জনসংখ্যাকে কীভাবে জনসম্পদে পরিণত করা যায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে তিনি তার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। গণতন্ত্রের সাহসী নেতৃত্ব গুণ এবং তার সময়োচিত ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে আজ বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত জনসম্পদ সুনামের সঙ্গে কাজ করছে এবং তাদের পাঠানো বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স দেশের অগ্রযাত্রায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বিশ্বাস করে দেশে এবং বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত এবং দক্ষ জনসম্পদ দেশের জন্য দুশ্চিন্তা তো নয়ই বরং তাদের কল্যাণে বিশ্বের বুকে আজ বাংলাদেশ মাথা তুলে নিজ পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সে পরিচয় হচ্ছে লাল সবুজের পতাকা সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও বাংলাদেশে ১১ জুলাই পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। বিশ্ব জনসংখ্যার এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘জনসংখ্যা ও উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ২৫ বছর: প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়ন’। ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই পৃথিবীর জনসংখ্যা ৫০০ কোটি স্পর্শ করে। পরবর্তী সময়ে ইউএনডিপির গভরনেন্স কাউন্সিল প্রতি বছর এই দিনটিকে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করে। তারই প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্ব জুড়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন করে আসছে।
সে সময় জাতিসংঘ কেন এ দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালন করবে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছে, পৃথিবীর বাড়তি জনসংখ্যাকে রাষ্ট্র তথা বিশ্ব যেন মানবসম্পদে পরিণত করার সব রকম উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রতি বছর জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল জনসংখ্যা দিবস পালনে বিশ্বের ১৯৮টি সদস্য দেশকে আহ্বান জানায়, আসুন জাতীয় ও আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়ন করে দেশের সব বয়সের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দেশ ও দশের উন্নয়নে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক সঙ্গে কাজ করি। বাংলাদেশও সেই ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই প্রতি বছর যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে দেশে এ দিবসটি পালন করা হয়।
দুই
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা নানা কারণে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে যা নিয়ে অনেকেই শংকিত। তবে উন্নত বিশ্বে সেভাবে এই সংখ্যা বেড়ে না গেলেও অনুন্নত, উন্নয়ন শীল দেশসমূহে জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি তাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে পাশাপাশি অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলছে। আশার কথা বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি পৃথিবীতে আজ স্বীকৃত। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স অর্জনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অবস্থান করছে পৃথিবীতে নবম স্থানে। বিশ্বব্যাংকের ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড রেমিটেন্স: রিসেন্ট ডেভেলপমেন্ট এন্ড আউটলুক’ ২০১৮ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের রেমিটেন্স প্রবাহের চিত্র উঠে এসেছে।
এ প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশীরা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ৮৯ লাখ বাংলাদেশী বাস করেন। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি যে অন্যতম প্রধান নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। রেমিটেন্সের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বিশ্ব ব্যাংকের একই প্রতিবেদন থেকে যে আশার বাণী দেয়া হচ্ছে তা হলো, ২০১৭ সালের রেমিটেন্সের তুলনায় ২০১৮ সালে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। বলা হচ্ছে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য রেমিটেন্সের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতিবেদনটিতে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ পঞ্চম বৃহত্তম দেশ যে দেশের এত বিপুল সংখ্যক জনশক্তি প্রবাসী রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে লেনদেন ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
তিন
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১৮০৪ সালে বিশ্বে জনসংখ্যা ছিল ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি। ১২৩ বছর পরে এই জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ২০০ কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির এই হার ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে দেশে দেশে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৭৮০ কোটিতে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টমে।
একটা সময় ছিল যখন অপরিকল্পিত ও বিপুল জনসংখ্যার কারণে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, অগ্রগতি, সমৃদ্ধি, উন্নয়ন – সব কিছুই অনিশ্চয়তার অন্ধকূপে নিমজ্জিত ছিল। সময়ের ধারাবাহিকতা এবং সরকার প্রধানদের বাস্তব ভিত্তিক কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ এবং তার বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে বদলে দিতে থাকে। নব্বই পরবর্তী সময় থেকে এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ একুশ বছর পর রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে থাকেন। তিনি তার পিতার দেখানো পথে বাংলাদেশকে পরিচালিত করতে থাকেন। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শুভ পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি সকলের পরামর্শ গ্রহণ করে দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার এক দুঃসাহসিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। ইতোমধ্যে নানামুখী ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্যকে সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে গড়েছেন এক নতুন ইতিহাস।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপলব্ধি করতে পেরেছেন দেশের এই বিশাল সংখ্যক জনসংখ্যাকে যদি শিক্ষা দিয়ে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করা যায় তাহলে তারাও দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে। বিশেষ করে ভাগ্যের অন্বেষণে যেসব শ্রমিক দেশের বাইরে যায় তাদের যদি যুগোপযোগী শিক্ষা, প্রশিক্ষণ দিতে পারা যায় তাহলে তাদের উপার্জন যেরকম বেড়ে যাবে ঠিক একইভাবে রেমিটেন্সের পরিমাণও বেড়ে যাবে। বাস্তবে হয়েছেও তাই।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স অর্জনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যে পৃথিবীতে নবম স্থানে অবস্থান করছে তা শেখ হাসিনার একক কৃতিত্ব বলে মনে করছেন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা। সামনের দিনে এই অবস্থানকে কিভাবে আরও ওপরের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় সেব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের সব রকম নির্দেশনা দিয়েছেন। এখানেই তাঁর নেতৃত্বের দূরদর্শিতা।
চার
একসময় উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা একটি দেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে বাড়তি বোঝা হিসেবে চিহ্নিত করে বলত সে দেশের উন্নয়ন আর অগ্রযাত্রা কোনোদিনই সম্ভব নয়। তারা এসব দেশকে অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া দেশ হিসেবে উল্লেখ করত। বিশেষ করে সেসব দেশ যদি তৃতীয় বিশ্বের দেশ হতো তাহলে তো কথাই নেই। সে হিসেবে বাংলাদেশকেও একসময় অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এধরনের অপবাদ শুনতে হতো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে গত দশ বছরের রাষ্ট্র পরিচালনার সফল ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ কৃষি, খাদ্য, নির্মাণ শিল্প, তথ্য প্রযুক্তি খাত, তৈরি পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, জাহাজ শিল্প সহ সব সেক্টরে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধন করেছে।
রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি প্রথমেই যে কাজটি করেছিলেন তা হলো দেশের মানুষের মধ্যে এই দায়িত্ব আর কর্তব্যের বিষয়টি প্রোথিত করে দেয়া। প্রধানমন্ত্রী সব সময় মনে করেন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ মনে প্রাণে চায় দেশটা যেন প্রকৃত অর্থে পরিণত হয় সোনার বাংলায়। তিনি সেই বিশ্বাস নিয়ে দেশের সতেরো কোটি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পরিচালনার কাজটি করছেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন দেশের বাড়তি জনসংখ্যাকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারলে, তাকে তার দায়িত্ব আর কর্তব্যের কথা বুঝিয়ে দিতে পারলে সে কখনোই সেখান থেকে বিচ্যুত হতে পারে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)