আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী
দীর্ঘ বরষ মাস
রবীন্দ্রনাথের ‘আমার পরাণ যাহা চায়’ গানটি সবচেয়ে বেশি শোনেন বাঁধন। বলছিলাম লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার আজমেরী হক বাঁধনের কথা। এই গানের কথার সাথেই বাঁধন হৃদয় বেঁধেছেন সুরে সুরে। তিনি গুনগুন করে গেয়ে শোনান,
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও, সুখের সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে
আর কিছু নাহি চাই গো
জানতে চাই, কে বেশি প্রিয়, ব্যক্তি বাঁধন না অভিনেত্রী বাঁধন? গুনগুন থামিয়ে ঠোঁটে চিমটি কাটেন। একটু কি আনমনা! না, আসলে প্রশ্ন নিয়েই ভাবছিলেন। স্মিত হেসে দৃঢ় প্রত্যয়ে জবাব দিলেন, ‘ব্যক্তি বাঁধন, আমার কাছে ব্যক্তি বাঁধনই প্রিয়।’ সাথে সাথেই প্রশ্ন ছুঁড়ি, কেন? কী দোষ করলো অভিনেত্রী বাঁধন? এবার চোখ দুটি তার একটু স্থির হয়। যেন গুছিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে। বলেন, অভিনেত্রী বাঁধনে কখনো বাঁধন থাকে না। যখন যে চরিত্রে অভিনয় করে তখন সেই চরিত্রে ঢুকে যায়। সেখানে নিজস্বতা থাকে না। যেটা থাকে সেটা ছায়া। ছায়া আলোর উপর নির্ভর করে। আর ব্যক্তি বাঁধন মানে সম্পূর্ণ আমি। আর আমি আমাকে ভালোবাসি। কারণ আমার নিজস্ব সত্তার সঙ্গে মিশে আছে আমার আত্মজা।
মানুষকে কবিতার কাছে যেতে হয়। বিশেষ করে সৃজনশীল মানুষ কবিতা পোষে বুকের ভেতর। বাঁধনও ব্যতিক্রম নন। জীবনানন্দের কবিতা তাকে ঘোর দেয়। হেলাল হাফিজ কিংবা রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহতে রয়েছে মুগ্ধতা। সুনীলের ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ কবিতাটি নিজের জীবনে বারবার উচ্চারণ করতে ভালো লাগে।
ধরো যুদ্ধের দামামা বাজছে ঘরে ঘরে,
প্রচণ্ড যুদ্ধে তুমিও অংশীদার,
শত্রু বাহিনী ঘিরে ফেলেছে ঘর
এমন সময়
পাশে বসে পাগলিনী আমি তোমায়
জিজ্ঞেস করলাম—
ভালোবাস?
ক্রুদ্ধ স্বরে তুমি কি বলবে- যাও?
নাকি চিন্তিত আমায় আশ্বাস দেবে
বলবে
ভালোবাসি, ভালোবাসি…….
বাঁধন অক্টোবরের ২৮ তারিখে পা দেবেন পঁয়ত্রিশে। তার কাছে জানতে চাই, এই যে জীবন দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে বহন করে চলেছেন। এই জীবন আদতে কেমন? তখন বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে শরতের রোদ। আকাশে সাদা মেঘ ভেসে ভেসে দূরদেশে চলে যাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়েই বাঁধন মুচকি হাসেন। যেন তার চোখে ভেসে ওঠে জীবনের আদ্যপান্ত, খুনসুটি, ভেতরের সুর, সোনার অতীত। হেসে বলেন, জীবন কিন্তু অনেক সুন্দর, জানেন। উত্তর শেষ না হতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, জীবন নিয়ে আসলে কোথায় পৌঁছাতে চান, বাঁধন? স্থির চোখে তাকালেন। নীল চোখে গভীর কোন স্বপ্নের রেশ লেগে আছে। বললেন, আমি সারাজীবন একজন নারী হয়ে উঠতে চেয়েছি। শৈশবে চেয়েছি বাবা-মার ভালো মেয়ে হতে। বড় হয়ে চেয়েছি ভালো প্রেমিকা হতে, চেয়েছি ভালো জীবনসঙ্গী হতে। এই চাওয়াটা বোধহয় আমার ভুল ছিলো। আমি এখন মেয়েটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। তাকে মেয়ে নয়, নারী নয়, একজন মানুষ হিসেবে গড়তে চাই। মেয়ের সাথে সাথে যতটুকু জীবন আছে, সেসময়টুকুতে আমিও একজন ভালো মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই।
শেষ প্রশ্ন বাঁধনের কাছে, আর একটা জীবন পেলে আপনি কী হতে চাইবেন? এবার তিনি শব্দ করে হাসলেন। আলতো স্পর্শে সরিয়ে দিলেন দু-একটা অবাধ্য চুল। বললেন, আর জীবনেও আমি বাঁধন হতে চাই। আমি অসংখ্যবার এই বাঁধনের জীবন নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।
দুপুর ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিকেলের দিকে হেলে পড়েছে সূর্য। জানতে চাইলাম, আচ্ছা বাঁধন, জীবন তো বাঁধনে বাঁধনে পূর্ণ হয়। তারপর একদিন সব বাঁধন ছিঁড়ে মানুষ অন্য কোথাও চলে যায়। এই নিয়ে ভেবেছেন কিছু?
এবার প্রশ্ন শুনে উঠে দাঁড়ালেন। ছাদের একপাশে নয়নতারা ফুলের টবের পাশে দাঁড়িয়ে ফুলগুলোকে ছুঁয়ে দিয়ে বললেন, আমরা সবাই আছি বাঁধন ছেঁড়ার সাধনাতে। তারপর গুনগুন করে গাইলেন:
বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে,
ছেড়ে যাব তীর মাভৈ-রবে ॥
যাঁহার হাতের বিজয়মালা
রুদ্রদাহের বহ্নিজ্বালা
নমি নমি নমি সে ভৈরবে ॥