বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, ডাকসুর সাবেক ভিপি, সাবেক সংসদ সদস্য, বর্তমান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা সুলতান মনসুর নির্বাচন করছেন সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার-২ আসনে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা হিসেবে তার প্রতীক ‘ধানের শীষ’। এরআগে একাধিকবার নির্বাচন করলেও কখনই তিনি ধানের শীষের প্রার্থী হননি; এবার ছাড়া আগের তিনবারই তার প্রতীক ছিল নৌকা।
১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ সহ সকল নির্বাচনেই তার প্রতীক ছিল ‘নৌকা’। এবং সেটাই ছিল অনুমিত, কারণ ছাত্ররাজনীতি থেকে শুরু করে গণসংগঠনের সবটাই ছিল তার আওয়ামী লীগকেন্দ্রীক। তবে এবার এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রতীকের প্রার্থী তিনি, এবং অন্য অনেকের মত তার প্রতীকও তাই ‘ধানের শীষ’।
মজার বিষয় হচ্ছে ‘ধানের শীষ’ তার নির্বাচনী প্রতীক হলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এই প্রতীকের নাম বলছেন ‘ধানের ছড়া’। প্রতীকের এই নাম বিকৃতি ঠিক কী কারণে এনিয়ে এখনও অন্ধকারে বলে কোন মন্তব্য করতে চাইছি না, তবে তবে এটা অজ্ঞতাপ্রসূত কোন উক্তি যে নয় তা ভাবতে চাই। কারণ তার মত নামডাক থাকা এমন রাজনীতিবিদ বিএনপির প্রতীকের নাম জানেন না, প্রতীক বরাদ্দের প্রত্যয়ন পত্র, পোস্টারে প্রকাশিত ছবি ও অক্ষর দেখেও প্রতীকের নাম ঠিকমত বলছে পারছেন না এমনটা ভাবার কারণ নাই। তাহলে কী কারণে এই বিকৃতি? রহস্যজনক বটে!
রাজনীতির ন্যূনতম খবরাখবর যারা রাখেন তাদের এটা জানা যে বিএনপির নির্বাচনী প্রতীকের নাম ‘ধানের শীষ’; এটা ‘ধানের ছড়া’ নয়। এর বাইরে হাল আমলের রাজনীতির খবর রাখেন যারা তারা এও জানেন বিএনপির প্রতীকের নাম ও ছবি নিয়ে সম্প্রতি হাই কোর্টে একটি রিটও হয়েছে। রিটকারীর দাবি বিএনপির প্রতীকের নাম ‘ধানের শীষ’ নয়, এটা ‘ধানের ছড়া’। এনিয়ে গত ১৯ নভেম্বর হাই কোর্টে নড়াইলের একজন বাসিন্দার পক্ষে রিট করেছেন আইনজীবী হারুন অর রশীদ। রিটে বলা হয়, ‘বিএনপি যে প্রতীকে নির্বাচন করছে তা ভুল। কেননা, তারা বলছে ‘ধানের শীষ’ কিন্তু ছবিতে দেখা যাচ্ছে ‘ধানের ছড়া’। অর্থাৎ ছবির সঙ্গে প্রতীকের নামের কোনো মিল নেই। কেননা,ধানের শীষ আর ধানের ছড়া একই ধরনের না। বিএনপির প্রতীক হচ্ছে ধানের ছড়া। তাই তাদের প্রতীক ঠিক থাকবে কিন্তু ধানের শীষের পরিবর্তে লিখতে হবে ধানের ছড়া’। ওই আইনজীবীর আরও দাবি, ‘বিএনপি এর আগেও কয়েকবার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু সে সময় তারা প্রতীক বা প্রতীকের নাম সংশোধন করেনি। এটা তাদের ভুল ছিল। ১৯৯১ সালে আমি এই ভুলটি তাদের দৃষ্টিগোচর করলেও ভুলটি তারা সংশোধন করেনি’।
ধানের শীষ নাকি ধানের ছড়া- এই রিট নিষ্পত্তিহীন অবস্থায় থাকলেও প্রতীক নিয়ে আলোচনা ও নির্বাচনী মৌসুমের এই সময়ে সুলতান মনসুরের ‘ধানের শীষ’ নামের বদলে বারবার ‘ধানের ছড়া’ উল্লেখ রহস্যময় বৈকি! তিনি কেবল এক-দুইবারই ধানের শীষকে ধানের ছড়া বলেন নি, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বেশিরভাগ বক্তব্যেও ধানের শীষকে ধানের ছড়া বলেছেন। এই রহস্য-উন্মোচনে অনেকেই বলতে পারেন হয়ত এই কথাগুলো আঞ্চলিকতার টানে, কিন্তু এই আঞ্চলিকতার টানকে মেনে নেওয়া যায় না যখন আর সকল প্রার্থীদের কেউই এমন উচ্চারণ করছেন না।
সুলতান মনসুর আওয়ামী লীগে একটা সময়ে প্রভাবশালী নেতা হলেও সেনাসমর্থিত এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামল তার রাজনীতিকে পালটে দিয়েছে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে ‘মাইনাস’ করার যে মিশনে নেমেছিল তৎকালীন অনির্বাচিত সরকার সেখানে আওয়ামী লীগের আরও কিছু নেতার মধ্যে তিনিও ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিএনপির মত আওয়ামী লীগে ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ দৃশ্যমান না হলেও যে ক’জন আড়ালে ছিলেন প্রাথমিক অবস্থায় শেখ হাসিনা তাদেরকে দূরে রাখলেও একটা সময়ে কাছে টেনে নেন। কিন্তু ওই দলে জায়গা হয়নি সুলতান মনসুরের। ফলে দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকেই নির্বাসিত ছিলেন প্রায়। আওয়ামী লীগ কখনই তাকে ফেরাবে না এমনও আলোচনা চলছিল, এবং ফেরায়ওনি।
আওয়ামী লীগ সুলতান মনসুরকে দলীয় রাজনীতিতে না ফেরালেও তিনি ফিরেছেন আওয়ামী লীগের বিরোধী শিবিরের হয়ে। সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলে এই ফ্রন্টের অন্যতম নেতা হন তিনি। নির্বাচনে মনোনয়নও পান। নির্বাচনের প্রচারণার শুরু থেকেই তিনি তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সেই সব ‘অবিচারের’ কথা বলেন সবিস্তার। আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীক পেয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতার ভাষা এতখানি তীক্ষ্ম আর প্রবল ছিল যে খোদ বিএনপি নেতারাই এতখানি খালেদা ভক্তির প্রমাণ রাখেন না। এটা যতখানি তার রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত তারচেয়ে বেশি সরকারবিরোধী ব্যক্তিগত অবস্থান প্রমাণ করে বিএনপির ভোট টানার প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল বলাও যায়।
নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই সুলতান মনসুর আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। ‘এই আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ না’; ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে তিনি ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছেন’ বলে নানা কথা বলেছেন। তিনি নির্বাচনী জনসভাসহ সকল বক্তৃতায় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান বলছেন। তার পরনের ‘মুজিব কোট’ কেউ খুলতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেছেন। এসব বক্তৃতা-বিবৃতি-আচরণ কিংবা প্রত্যয় নানামুখী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে এসবের সঙ্গে সঙ্গে তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ‘দুঃশাসনের অবসানের’ জন্যে ধানের শীষে (তার ভাষায় ধানের ছড়া) ভোট দেওয়ারও আহবান জানিয়ে গেছেন।
সুলতান মনসুর সারাদেশের পরিচিত রাজনীতিবিদ। কেবল দুই-দুইবারের সংসদ সদস্য পরিচয়ের বাইরেও সব জায়গায় তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। সম্পূর্ণ বিপরিত আদর্শের রাজনৈতিক দলের প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে তার নির্বাচনে অংশগ্রহণকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি ঠিক কিন্তু তার প্রতি সকলের দৃষ্টি ছিল। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা (তার ভাষায় ঐক্যফ্রন্টের কর্মকর্তা) হিসেবে নির্বাচনে মৌলভীবাজার-২ আসনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করলেও তিনি সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। আওয়ামী লীগের বিরোধী শিবিরে জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে সহাবস্থান করে ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্যে রাজনীতি করছেন বলেও দাবি করছেন। এসব তার বহুরূপী রাজনৈতিক চরিত্রের স্মারক।
এই বহুরূপের রাজনীতির সর্বশেষ প্রমাণ রেখেছেন তিনি ২৭ ডিসেম্বর নিজ নির্বাচনী এলাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে, যেখানে তিনি নিজেকে ‘আওয়ামী লীগের কর্মী’ হিসেবে দাবি করেছেন। বলছেন, ‘আমি কোনো দলে যোগ দিইনি। আমি আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছি। শুধু একটি নিবন্ধিত দলের পেপার জমা দিতে হয় বলে আমি গণফোরামের হয়ে মনোনয়ন জমা দিয়েছি নিয়মরক্ষার জন্যে’।
সুলতান মনসুর মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে যখন এ কথাগুলো বলছিলেন তখন তার পেছনে শোভা পাচ্ছিল খালেদা জিয়ার ছবি সম্বলিত তার নির্বাচনী ব্যানার, সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় বিএনপির নেতারাও। তার এই বক্তব্য যে পরস্পরবিরোধী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ সরকারের পতনের জন্যে সরকারবিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষের একজন প্রার্থী হিসেবে তিনি এতদিন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার শপথসূচক বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বিএনপিকে ক্ষমতাসীন করে আওয়ামী লীগের ‘দুঃশাসনের অবসান’ করবেন বলে বারবার বলে আসছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে দুইদিন আগে হঠাৎ করে তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের কর্মী দাবি করে বসলেন। জানান, তিনি কোনো দলে যোগ দেন নি। আরও দাবি করেন, আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছেন। একই সঙ্গে নিয়মরক্ষার জন্যে গণফোরামর মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন বলে জানান। তার ‘নিয়মরক্ষার’ শব্দ উল্লেখে তিনি তাকে মনোনয়ন দেওয়া দলকে কি ছোট করে দেখেন নি? মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করতে পারছেন যে দলের জন্যে সেই দলকে এভাবে ছোট করে দেখা শোভন নয়, নিশ্চিতভাবেই।
সুলতান মনসুর বলছেন ‘আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ’ দিয়েছেন; এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক কোনো বক্তব্য নয়। কারণ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এতখানি নেতৃত্বহীন কিংবা বিশৃঙ্খল নয় যে কোনো নেতা কিংবা কর্মী ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে এভাবে ‘কেবলা বদল’ করতে পারে। এটা হতে হবে সেই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে, কিন্তু আওয়ামী লীগ কেন কোনো দলই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল কিংবা জোটে এভাবে কাউকে যোগদানের অনুমতি দেবে না। আর যেখানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান এজেন্ডা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সেখানে ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতাকর্মীকে সেখানে প্রতিপক্ষ শিবিরে যোগদানের অনুমতি দেবেই না। তাই সুলতান মনসুরের এই দাবি অসত্য বলাই যায়।
তাহলে নির্বাচনের কাছাকাছি এসে সুলতান মনসুর কেন এমন বলছেন? হতে পারে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তার এমন দাবি। কারণ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর সরকারবিরোধী এই জোট যেভাবে গণজোয়ারের স্বপ্ন দেখেছিল সেটা পূরণ হয়নি। নির্বাচনের ক্ষণগণনা ঘণ্টার কাটায় রূপান্তরের ঠিক আগ মুহূর্তেও সরকারবিরোধী কোন গণজোয়ার উঠেনি। সরকার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে নানাভাবে কোণঠাসা করে রেখেছে ঠিক তবে আওয়ামী লীগের ভোটার কিংবা আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটার নির্বিশেষে সকলের একই ধারনা সরকারে হয়ত থেকে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ, যদিও এখানে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়ে একটা বড় প্রশ্ন করছেন দুপক্ষই।
৩০ ডিসেম্বরের ভোটে কে নির্বাচিত হবে বা সুলতান মনসুর নির্বাচিত হতে পারবেন কিনা এর উত্তর আগামির গর্ভে হলেও এই নির্বাচন সুলতান মনসুরকে নতুনভাবে চিনিয়েছে। গত কয়েক মাসের রাজনীতি পর্যবেক্ষণে এখন তাই বলতেই হচ্ছে সেই সুলতান মনসুর এখন বহুরূপের সুলতান!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)