রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষানীতি, যুব নীতি সবকিছুর পেছনেই অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন ও প্রচেষ্টা। সম্মান, পুরস্কার প্রাপ্তি, খ্যাতি, ক্ষমতা ও ভাল কাজের স্বীকৃতির মূলেও তাই। রাজনীতি করতে করতে যদি কেউ আর্থিক ভাবে দূর্দশাগ্রস্থ হয় তখন আর তার অনুসারী হতে কেউ আসবেনা। সামাজিক ভাবেও তাকে আত্মসম্মান হারা হয়ে সর্বত্র করুণার পাত্র হতে হবে। স্ত্রী সন্তান তথা নিজ পরিবারেও হতে হবে অপাঙতেয় অনাহূত কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত। সর্বত্র মর্যাদার আসন চ্যুত হয়ে ওঠা রাজনীতি করা মানুষটি দেশের দশের জন্য কী করবে যে নিজের জন্যই কিছু করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নটি জনমনে ঘুরপাক খেয়ে নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করবে তার অবস্থান।কতিপয় গণবিচ্ছিন্ন বাম তাত্ত্বিক নেতা স্বঘোষিত গণমানুষের নেতা হয়ে অলীক কল্পবিলাসে ভাববাদের চূড়ায় আরোহন করে তত্ত্বকথার চর্বিত চর্বন করে যাচ্ছেন।নিজেদের ছাড়া অন্য সবাইকে অকমিউনিষ্ট বলে গাল দিচ্ছেন। নিজেদের নিজেরা জননেতা মনে করছেন কিন্তু জনগণ মনে করছেনা।
তাদের গোটা কয়েক কর্মী ছাড়া আমজনতার মাঝে তাদের কোন পরিচিতিও নেই। এই রাজনৈতিক কর্মীরা অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হতে পারছেনা এবং সমৃদ্ধতর হতে কোন সুযোগও পাচ্ছেনা। নেতাদের মগজে এই ভাবনাটাও নেই।রাষ্ট্রীয় ভাবে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলতে গেলে আগে নিজ দলের নেতাকর্মিদের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টাতে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশবাসীর সামনে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে হবে তবেই দেশের মানুষ তাদের দলে ভিড়বে।
একজন সংস্কৃতি কর্মীর বেলাতেও তাই। একজন লেখক পুরস্কার পেলো। যার অর্থমূল্য পাঁচ লাখ টাকা। অর্থমূল্যটা বেশি হওয়াতে তার মর্যাদাও বেশী হবে। লেখককে অনুপ্রেরণাও দেবে বেশি।পুরস্কারটিতে অর্থ না থাকলে এর কোন গুরুত্বই থাকত না সংস্কৃতি কর্মি, সাহিত্যিক , বুদ্ধিজীবী ও জনগণের কাছে। সংস্কৃতি করে আর্থিক উন্নয়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না পারলে আজকের বাবা মায়েরা তার সন্তানদের সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহ প্রদান করবে না। শিক্ষকরা বেতন কম পেলে বেতন বৃদ্ধির দাবীতে রাজপথে আন্দোলনে নামে। তারা এরকমটি ভাবে না যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়াই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। কোন শিক্ষক শিক্ষকতা করে অভাব গ্রস্থ হয়ে পড়লে তার গ্রহণ যোগ্যতা হ্রাস পায়। সুতরাং সেবাব্রত নিয়ে এগিয়ে আসার সুযোগ তাদের নেই। সম্মান ও অর্থ একে অপরের পরিপূরক। মন্দ কাজ করে অর্থ রুজী করতে পারবে , ভাল কাজ করে অর্থ রুজী করতে পারবে না এটা কোন সুস্থ ধারার রীতি হতে পারে না।বাংলাদেশে শিল্প, সংস্কৃতি ও জনবান্ধব কর্ম প্রচেষ্টার প্রকাশ ও বিকাশ আর্থিক সক্ষমতা ছাড়া সম্ভব নয়। প্রিন্ট মিডিয়াতে যে লিখে টাকা পায় সে বড়লেখক। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় যে সাক্ষাৎকার দিয়ে টাকা পায় সে সম্মানী লোক। অর্থটাই সর্বকাজের মর্যাদার নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুব কর্মসংস্থান সৃষ্টি, যুবদের জীবন মানের উন্নয়ন তথা দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ আদর্শবান যুব সমাজ গড়ে তুলতে দেশে বিভিন্ন যুব সংগঠন, যুব মন্ত্রণালয়, যুব উন্নয়ন অফিস ও তাদের নানা কার্যক্রম ক্রিয়াশীল রয়েছে।শুধু যুব সংগঠনের সাথে জড়িতদের আর্থিক নিরাপত্তা নেই। যুব মন্ত্রণালয়, যুব উন্নয়ন অফিসে কর্মরত সকলের আর্থিক নিরাপত্তা রয়েছে।আর্থিক নিরাপত্তা না পেলে কেউ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী,সচিব,কর্মকর্তা ও কর্মচারির চেয়ারে বসতোনা। সরকারি অফিসের পিয়নের সামাজিক মূল্য কম কারণ তার বেতন কম। কর্মকর্তার চেয়ে যদি পিয়নের বেতন বাড়িয়ে দেয়া হয় তবে কর্মকর্তারা অসম্মান বোধ করবেন। পদমর্যাদা ও পদবীর নাম পিয়ন হলেও তখন অনেক কর্মকর্তা আর কর্মকর্তা হতে না চেয়ে তখন পিয়নই হতে চাইবেন।
কারন অর্থই মানুষের জীবন মানকে মাপার একমাত্র মানদন্ড। অন্ন,বস্ত্র,বাসস্থান,শিক্ষা, চিকিৎসা,এই পাঁচটি মৌলিক চাহিদা রাজনীতি, সংস্কৃতি তথা জীবন জীবিকার সকল পর্যায়ে পূরণের অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নই পারে দেশকে প্রগতির দিকে ধাবিত করতে।কমিউনিষ্ট নেতা হলে, কবি হলে ছেঁড়া পাঞ্জাবী আর ছেঁড়া পায়জামা পরে অনাহারে অর্ধাহারে জীবন পাড় করতে হবে, এই কথা ভুল।স্বপ্ন দেখবে স্বচ্ছল সমৃদ্ধ জীবন ব্যবস্থার আর নিজেরা থাকবে অস্বচ্ছল এমনটি কাম্য নয়।
এরকম স্বপ্ন দেখলে আগে নিজের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। ভালবাসতে হবে নিজেকে, ভালবাসতে হবে অন্যকে।নিজকে ভাল না বেসে কেবল অন্যকে ভালবাসলে সে ভালবাসা পোক্ত হবে না।যে কোন সময় উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ অনেক বাঘা বাঘা বাম নেতা বুর্জোয়া দলে নাম লিখিয়ে এমপি, মন্ত্রী হচ্ছেন। কতিপয় বাম দলের পোড় খাওয়া নেতা দাবীদার ব্যক্তিবর্গ নিজেদের ছাড়া সকলকে অকমিউনিষ্ট , বুর্জোয়া লেজুড়,সংশোধন বাদী ইত্যাদি উপাধিতে আখ্যায়িত করে থাকেন।
দেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের বাধাপ্রাপ্ততার দিকে, বিএনপি জামাত জোটের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঠেকানোর নানা ষড়যন্ত্র চলমান এমনই এক জটিল দুঃসময়ে এইসব স্বঘোষিত জনমানুষের নেতা দাবীদার ব্যক্তিবর্গ নানা তত্ত্বকথায় দেশের প্রকৃত বাস্তবতা হতে জনমানুষকে ভিন্নপথে নিতে প্রয়াসী হয়েছে। তারা ১৪ দল,১১ দল,বুদ্ধিজীবীদের ডাকা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় সম্মেলন কোনটাতেই নেই।
সকলকে অসাধু, বুর্জোয়া বলে গাল দেয়া এই স্বঘোষিত জনমানুষের নেতারা যে ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে উঠছেন এই বাস্তব জ্ঞানটুকুও তাদের বোধে নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সাম্যবাদী দল কিশোরগঞ্জ জেলার কয়েকটি উপজেলায় প্রবল প্রতাপে খুনোখুনি আর রক্তারক্তির কান্ড ঘটিয়ে যাচ্ছিল। ওখানকার মানুষের মনে সেই সময়কার শ্রেনী শত্রু খতমের নামে হঠকারিতার ভয়াবহ স্মৃতি আজও মানুষকে বামরাজনীতির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করে রেখেছে।ছাতিরচর নামক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো জলবেষ্টিত গ্রামে তৎকালীন সাম্যবাদী দলের নেতা ইয়াকুব আলীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠেছিল সশস্ত্র কর্মী বাহিনী। এই রাজনীতির পথ পরিক্রমায় কত মায়ের কোল খালি হয়েছে। কত স্ত্রী তার স্বামীকে হারিয়েছে। বাবা হারিয়েছে সন্তান। মুজিব বাহিনী ও রক্ষী বাহিনীর সাথে সংঘাতে গোটা এলাকা এক আতঙ্ক পুরীতে পরিণত হয়েছিল।
তৎকালীন নেতৃত্ব তার বাহিনীকে বুঝাচ্ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই তাদের এ সংগ্রাম। অনেক দেশপ্রেমিক টগবগে তরুণ যুক্তির চেয়ে বিপ্লবের তুমুল উন্মাদনায় সাম্যবাদী দলের পতাকা তলে সমবেত হয়েছিল। সাম্যবাদী দলের সেই সময়কার নেতারা বর্তমানে কেউ বিএনপিতে, কেউ আওয়ামী লীগে চলে গিয়ে তাদের রাজনীতির অসাড়তা প্রমাণ করল। এই রাজনীতির মধ্য থেকে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তি সাধন সম্ভব নয় বলেই তারা দলত্যাগ করল। তাদের এই আত্মত্যাগ ও রক্তদান বাম রাজনীতির অপকার বিনে বিন্দু পরিমাণ উপকার সাধিত করেনি। কথা হচ্ছিল এই ধারার এক বাম রাজনীতিকের সঙ্গে। তিনি সত্যিকারের কমিউনিষ্ট বিপ্লবী দাবীদার একটি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। কথা প্রসঙ্গে বললেন , ওয়ার্কার্স পার্টিকে তারা সার্কার্স পার্টি বলেন। কারণ এই পার্টি ১৪ দলীয় জোটে রয়েছে।কথা হচ্ছিল এই নেতার পরিচিত জনের সঙ্গে।
তিনি বললেন, ওই নেতা কয়েকজন খেয়া মাঝিকে দলভূক্ত করেছেন। পার্টির প্রোগ্রাম থাকলে তিনি তাদের বলেন, দেশের জন্য আজকের দিনটা উৎসর্গ করতে হবে। মিটিংয়ে যেতে হবে।খেয়া মাঝিরা জিজ্ঞেস করবে, যাব কিভাবে। যাওয়ার খরচ কে দেবে? নেতা বলেন, তোমার নৌকাটা একদিনের জন্য শ্রমজীবীদের কল্যাণে দিয়ে দাও। সবাই মিলে কিছু টাকা দিয়ে দাও। দশের লাঠি একের বোঝা। খেয়া মাঝি দেশ উদ্ধারে মিটিংয়ে গেল। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষটির একটি দিন চলে গেল।কিছু অর্থও গেল।নেতার মিটিং মানে ১০/১২ জন লোকের একত্রে বসা। এই লোক গুলোকে দেখিয়ে নেতা কেন্দ্রীয় কমিটিতে তার পদ ধরে রাখার সুযোগ পেল। তিনি কেন্দ্রীয় নেতা। বিপ্লবী আদর্শ লালন করেন আবার নির্বাচনেও অংশ নেন। ভোট পান ষাট সত্তুরটি। এই ভোট প্রাপ্তিও দলীয় ভিত্তিতে নয় আত্মীয় স্বজন ও গোষ্ঠী জ্ঞাতির ভিত্তিতে।এই নেতা ওই খেয়া মাঝিকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে পারবেন কিনা। এলাকায় তার গণভিত্তি দেখেই তা অনুমান করা সম্ভব। কতিপয় বামপন্থী দল। আসলে সেগুলোকে দল না বলে ক্লাব বলাই সঙ্গত। সারাদেশ হতে লোক জড়ো করে কোনমতে একটা কেন্দ্রীয় কমিটি দাঁড় করানো হয়। তাদের দলীয় অবস্থান অনেকাংশেই ছক্কা ছয়ফুর কিংবা কৃষক মোহাম্মদ সাদেক টাইপ।
বস্তুবাদের দোহাই দিয়ে ভাববাদের আদর্শে পরিচালিত হওয়া এই বামপন্থী আঁতেলরা অবাস্তব ভাবনা বিলাসে আর কতকাল রাজনীতি করবে। তাদের গণবিচ্ছিন্ন আঁতলামোতে আজও দিশে হারাচ্ছে মানুষ। গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়লের মত অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন নতুন উপাধি দেবে। যেখানে প্রয়োজন বামপন্থীদের ঐক্য সংহতি,বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষনে নিজে বাঁচা ও অন্যকে বাঁচানোর। বাস্তববাদী কর্মপ্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়া আজকের সময়ের দাবী। তা না করে আর কত তত্ত্বকথার গণবিচ্ছিন্ন বুলি আওড়ানো? বস্তুবাদী পন্ডিত সেজে ভাববাদের গণবিচ্ছিন্ন ভাবনা বিলাস হতে তারা ফিরে আসবেন কি? যত দ্রুত ফিরবেন দেশের জন্য ততই মঙ্গল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)