চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বসুবাজার লেন থেকে মিলান শহরের গল্প

পুরান ঢাকার মানুষ, মানুষের দুর্দান্ত রঙ্গ রসিকতা, দিলদরিয়া স্বভাব আর তাদের বিচিত্র গৌরব মাখা জীবনযাপন এখনো অনেকের কাছেই একটি অনালোকিত অধ্যায়। শত শত বছর ধরে ঢাকার আদি বাসিন্দা হিসেবে ঢাকাইয়াদের আলাদা একটা মানমর্যাদা রয়েছে। তার ওপর রয়েছে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও ইতিহাস।

গবেষকরা বলছেন, সাতচল্লিশের দেশভাগেরও বহু পূর্বে থেকে ঢাকার জনজীবনে পরিবর্তনের ঝড়ো বাতাস বইতে থাকে। এই ঝড়ো বাতাসের ধকলে অনেক কিছুরই পরিবর্তন সাধিত হলেও ঢাকার আদি বাসিন্দাদের ভেতর এখনো তা বেশ শক্ত-পোক্তভাবে অটুট রয়েছে তা। অবশ্য দেশভাগের আগে ও পরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকায় আগত কিংবা স্থায়ী নতুন বাসিন্দাদের মনোজগতে ঢাকার আদি ও বনেদি বাসিন্দাদের নিয়ে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের তৈরি করে।
ঢাকার বাইরে থেকে যারা জীবন জীবিকার তাড়নায় ঢাকায় এসে বসতি করেছে কিংবা জায়গা কিনে বাড়ির মালিক হয়েছে তাদের মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য দেয়াল ও দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। ঢাকায় বসতি গড়া মানুষজন নিজেদের অস্তিত্ব সংকট সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে। এই অস্তিত্ব সংকট থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তারা খুব সচেতনভাবে ঢাকার আদি বাসিন্দাদের সম্পর্কে একধরনের নেতিবাচক ধ্যান ধারণা তৈরি করতে থাকে। এই নেতিবাচক ধ্যান ধারণা মূলত তারা নিজেদের সুবিধার্থে তৈরি করে নেয়।

জীবন মৃত্যু পায়ে পায়ে ঘোরে পুরনো শহরে
জীবন মৃত্যু পায়ে পায়ে ঘোরে পুরনো শহরে

জৌলুসময় জীবন আর রঙ্গ-রসিকতায় অনন্য সাধারণ হওয়ার কারণে ঢাকার আদি বাসিন্দারা ঢাকায় বসত গড়া এই নব্য ঢাকাবাসীদের রসিকতার ছলে নাম দিয়েছে ‘ঢাকুইল্লা’ । তবে পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দাদের সম্পর্কে ঢাকুইল্লাদের এসব মনগড়া নেতিবাচক ধ্যান ধারণা খুব বেশিদিন ধোপে টেকেনি। উল্টো কালের প্রবাহে এটা দেশভাগের পর বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং এরপর দেশের নানা ক্রান্তিকালে এই ঢাকুইল্লারা ঢাকার আদি, বনেদি কিংবা ঢাকাইয়া কুট্টিদের সঙ্গে নিজেদেরকে একাট্টা করতে পেরেছে নানাভাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই একাট্টা হতে পারার ব্যাপারে খানিকটা হেরফের হয়ত হয়েছে কিন্তু সেটা যে খুব বড় দাগে চিহ্নিত করা যাবে তা কিন্তু নয়।

মিলানের পুরনো শহরগুলোর সঙ্গে কোথায় যেন পুরান ঢাকার একটা অলিখিত সম্পর্ক আছে.
মিলানের পুরনো শহরগুলোর সঙ্গে কোথায় যেন পুরান ঢাকার একটা অলিখিত সম্পর্ক আছে

তবে তিরিশ-চল্লিশের দশক থেকে ঢাকার মানুষের জীবনযাত্রায় এক ব্যাপক পালাবদল ঘটে। এসময় এখানে পরিবর্তনের একটা ছোঁয়াও পরিলক্ষিত হয়। দেশভাগের পর সেই ধাক্কার প্রবলতায় ঢাকার মানুষ যেন একটু চিন্তিত কিংবা বিচলিত হয়ে পড়ল। তারা এই ধাক্কার পুরোটা সামলে উঠতে না উঠতে তাদের সামনে এসে উপস্থিত হলো আরেক নতুন বাস্তবতা। হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ বেধে যেত। এই সংঘর্ষ যতটা না দর্শনগত তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। হিন্দু মুসলিমের ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়াদি নিয়ে ধান্ধাবাজ রাজনীতিকরা নিজেদের স্বার্থে মাঝেমধ্যেই ঢাকাইয়াদের বর্ণিল, আনন্দময় জীবনকে বিষিয়ে তুলতে বিষফোঁড়ার মতো আমদানি করত এই দাঙ্গার। সে সময় এই দাঙ্গা ছিল রীতিমতো বিভীষিকার মতো কি হিন্দুদের কাছে কি মুসলিমদের কাছে। দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে সেই সময়ের রাজনীতিকে কোন কোন রাজনীতিবিদ এক ধরনের কূটবুদ্ধির খেলার প্রয়াস পেতেন। কট্টর মুসলিম লিগারদের ভেতর এই প্রবণতা মারাত্মক আকারে কাজ করত। মূলত ঢাকা শহরে ত্রিশ ও চল্লিশের দশকটা ছিল হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গায় বিভক্ত ও জর্জরিত। সেই উন্মাতাল সময়ে ঢাকার একেবারে সাধারণ মানুষও রাজনীতিকদের এই ঘৃণ্য কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন প্রচন্ডভাবে। তখন ঢাকা শহরের বিস্তৃতিও আজকের দিনের মতো হয় নি।
বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা শহরের বিস্তৃতি ছিল মূলত সদরঘাট থেকে লোহারপুল, কাঠেরপুল, গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর, নারিন্দা, বসুবাজার লেন, দয়াগঞ্জ, ওয়ারি হয়ে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন পর্যন্ত। এরপর বিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনকে কেন্দ্র করে জরুরি হয়ে পড়ে এই শহরের বিস্তৃতি। তখন কর্মসূত্রে ঢাকায় পোস্টিং পাওয়া ইংরেজ সাহেব সুবোধের থাকার জন্য নতুন প্যাটার্নের দৃষ্টিনন্দন বাড়িঘর তৈরি অনিবার্য হয়ে ওঠে। তারই পরে ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনের ওপারে গড়ে ওঠে হাল আমলের স্থাপনা।

মিলানের এসব শহরে হাঁটতে হাঁটতে পা থেমে যায় এই ভেবে আমি বুঝি নিজের অজান্তেই পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে হাঁটছি
মিলানের এসব শহরে হাঁটতে হাঁটতে পা থেমে যায় এই ভেবে আমি বুঝি নিজের অজান্তেই পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে হাঁটছি

এসব এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণ করলে শহরের আয়তনও বাড়তে থাকে। আয়তন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার মানুষের মধ্যে এক ধরনের আকাক্ষা তৈরি হতে থাকে। একইসঙ্গে তাদের কারো কারো মধ্যে রাজনীতির প্রতিও সূক্ষ্ম প্রীতি তৈরি হতে থাকে। তারা ভাবতে থাকে টাকা-পয়সা, অর্থকড়ি তাদের যে সম্মান এনে দিতে পারে না, রাজনীতি করলে তা অনায়াসে হাতের মুঠোয় চলে আসে। এই ক্ষমতার শক্তি কে না চায় ! কিন্তু তারপরও সে সময় ঢাকার ধনি-গরিব, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ভেতর সব কিছুকে ছাপিয়ে মানবিকতাবোধের তীব্র উন্মেষও লক্ষ্য করা যায় । শহরের প্রান্তিক মানুষ থেকে শুরু করে উঁচুতলার মানুষের মধ্যেও এই বিষয়টি কাজ করেছে মারাত্মকভাবে। তাদের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ ভুলে গিয়ে উদার মানবিকতার ব্যাপারটি বড় হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় অনুভূতিকে তারা ধর্মের মধ্যে রাখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। ধর্মান্ধতা তখনো আজকের দিনের মতো এতটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি তখনকার নেতৃত্বের সকল ধর্মের প্রতি তাদের উদারতার কারণে। এই মানবিকতার মধ্যে কোনো লোক দেখানো ব্যাপার ছিল না। ঢাকাইয়াদের মনের গহিনের যে মুক্তচিন্তা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, দৃঢ় বিশ্বাস ও উপলব্ধি ছিল তাই-ই তাদের চলনবলনে, কাজকর্মে ওঠে এসেছে। এ বিষয়ে সর্দার ফজলুল করিমের সঙ্গে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আলাপচারিতাভিত্তিক গ্রন্থ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ’ থেকে একটা উদাহরণ দিলে তখনকার দিনের চিত্রটি আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠবে। সেই বইয়ের এক জায়গায় সরদার সাহেব রাজ্জাক স্যারের কাছে ঢাকায় কবে থেকে দাঙ্গার শুরু ও ত্রিশ-চল্লিশ দশকের ঢাকার দাঙ্গার পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে রাজ্জাক স্যার তখনকার দিনের একটি ঘটনার কথা সবিস্তারে জানান, ‘অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে।’ ১৯২৬ সালে হয়েছে। তবে ১৯৩১ সালের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ঢাকায় তখন অ্যাকিউট রায়ট। আমি গেছি ঢাকা স্টেশনে, ফুলবাড়িয়া স্টেশনে। আমার ভাইয়েরা আসবে হুগলী থেকে। তাদের আনতে গেছি। তখন ঢাকা মেইল আসত বিকেলে, দুই-আড়াইটার দিকে, মানে কলকাতার মেইল। কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ । গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ। তারপর নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে ঢাকা । সেদিন আমি স্টেশনে গেলাম। অলমোস্ট ডেজারটেড স্টেশন। ট্রেন যখন এলো তখন আমার ভাইদের সঙ্গে একটি মেয়ে নামল । হিন্দু। বয়স উনিশ-কুড়ি বছর। আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম, কে এই মেয়েটি। আমার ভাইয়েরা বলল, নারায়ণগঞ্জের এক লোক আসার কথা ছিল। কিন্তু কেউ আসেনি। তাই আমাদের সঙ্গে ঢাকায় এসেছে। মেয়েটি আমাকে বলল যে তাকে ওয়ারি পৌঁছে দিতে হবে। এমন অনুরোধে আমি মুশকিলে পড়লাম । আমি জাস্ট আই,এ পড়ি । ‘আমারে কইবার লাগছে। আমি না-ও করবার পারি না, হ্যাঁ করলেও বিপদ । আমি আমতা আমতা করছি।’ তখন দেখলাম গাড়োয়ানদের একজন সর্দার আমাদের দিকে আসলো। ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান। তখন ঘোড়ার গাড়িই তো একমাত্র বাহন। আট-দশটা গাড়ির সর্দার।  নিজে গাড়ি চালায় না, কিন্তু গাড়ির সর্দারি করে। সে ঐ মেয়েটিকে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনি কই যাইবেন?
মেয়েটি বলল, ওয়ারি।
গাড়োয়ানের এই সর্দার এবার আমাকে জিগাইল, আপনার কিছু অয় নাকি ?
আমি বললাম, না।
উনি হিন্দু না?
হ্যাঁ, উনি হিন্দু ।
তা, আপনি নিয়া যাইবেন নাকি ওয়ারি ?
আমি বললাম, হ্যাঁ, ওনারে দিয়া আসন লাগবো ।
আমার কথা শুনে বয়সে বুড়ো মতো সেই সর্দার মেয়েটিকে বলল, না, উনি যাইব না। আমি পৌঁছাইয়া দিমু।
কিন্তু মেয়েটি তার সাথে যেতে রাজি নয়। মেয়েটির আপত্তি দেখে গাড়োয়ানদের সর্দার বলল, দেখেন, আমার গাড়ি আছে। আমি গাড়ি চালাই না। কিন্তু চালাইবার পারি । আমি আপনারে গাড়িতে নিয়া যামু । ওয়ারিতে কোনো মুসলমান পোলারে যাইবার দিমু না।
তার কথাতেই বোঝা গেল, কথাবার্তা বেশ গুছিয়ে বলতে পারে। আমাকে জিগ্যেস করল, কলেজে পড়েন না?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
আমার জবাব শুনে আবার বলল, আপনারে যাইবার দিমু না। মেয়েটিকে বলল, আমার লগে চলেন। আমি আপনেরে মা কইবার লাগছি। আমি পৌঁছাইয়া দিমু। কিন্তু কোনো মুসলমান পোলারে যাইতে দিমু না। আমাকে আবার বলল, আপনি ওয়ারি যাইবেন যে, ফিরবেন ক্যামনে? ওয়ারি গেলে হিন্দুরা আপনারে আইবার দিব? মেয়েটার যে সাহায্য করবার চাইছেন, তা হেরা মনে রাখবো? আবার মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, এ পোলা আপনাগো পাড়ায় জা কউক, হের দাম থাকবো না।
পনের মিনিট ধরে এই রকম কথাবার্তা চলছে। মেয়েটি রাজি না। গাড়োয়ান বলছে, দেহেন আর কোনো গাড়িই আপনারে নিয়া যাইবার সাহস করবো না। আমি নিয়া যামু । জিআরপি আছে (অর্থাৎ রেলের পুলিশ স্টেশন)। তাদের কাছে আমার নাম দিয়া যাইতাছি। আমি আপনারে পৌঁছাইয়া দিমু। আমারে যদি রাখবার পারে তবে যেন রাইখ্যা দেয়।’
এরপর সর্দার ফজলুল করিম লিখছেন, ‘কাহিনীটি শুনতে আমাদের ভালো লাগছিল।…হিন্দু পাড়ায় কোনো মুসলমান গেলে তার মৃত্যু অবধারিত ছিল। মুসলমান পাড়ায় হিন্দুরও তাই। আবার তার মধ্যে সাধারণ মানুষের মানবিক বোধের দৃষ্টান্ত ছিল। রাজ্জাক সাহেবের এ কাহিনীতে সেরূপ বোধেরই দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল। তাছাড়া ঢাকার স্থানীয় ‘অশিক্ষিত’ গাড়োয়ানদের শিক্ষার ও মুসলমান ছাত্রদের জন্য যে অকৃত্রিম সমর্থন ও সহানুভূতি ছিল তার পরিচয়ও ঘটনাটিতে প্রকাশ পেয়েছে।’
দুই.
নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে আমি সরমিন্দা হই। এছাড়াও আমি পারতপক্ষে খুব একটা ‘আমি-সূচক’ শব্দে কথা বলা তীব্র অপছন্দ করি। তারপর কখনো সখনো অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি দিয়ে কথা বলতে একপ্রকার বাধ্য হই।
আমি জন্মগতভাবে পুরান ঢাকার নাগরিক। নারিন্দার বসুবাজার লেনের সরু গলিতে আমার শৈশবের অসহ্য সুন্দর দিনগুলো কেটেছে। ২৪ নম্বর বসুবাজার লেন। বাড়িটা পুরনো আমলের। দোতলা বাড়ি। বাড়ির মালিকের নাম আবদুল আজিজ কিন্তু মহল্লার মানুষ চব্বিশ নম্বর বসু বাজার লেনের বাড়িটাকে চিনত উকিল সাহেবের বাড়ি হিসেবে। এই নিয়ে আজিজ সাহেবের মনে বড় দুঃখ ছিল। আজিজ সাহেব ঢাকাইয়া মানুষ, রসিকও বটে । বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি দোতলায় থাকেন। দোতলার ছাদে আমরা বিকেলে ঘুড়ি উড়াই। আমাদের পাশের বাড়ির নামও বেশ অদ্ভুত। বসুবাজার লেনের সবাই ২৩ নম্বর বাড়িকে বলত, সুন্দরবনের তোহা খানের বাড়ি। এই বাড়িতে তোহা খান নামের এক ভদ্রলোক থাকেন । তাল গাছের মতো লম্বা মানুষ । প্রায় বিকেলবেলা তোহা খান ধবধবে সাদা লুঙ্গি আর ঢিলেঢালা মুরব্বি গেঞ্জি গায়ে দিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে মানে রাস্তার দিকে যে ছোট্ট মতো এক চিলতে বারান্দা আছে সেখানে চেয়ার পেতে বাবার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা মারতেন।
কেন তোহা খানকে সুন্দরবনের বাঘ বলা হয়?
কারন এই নামে তিনি একটি বই লিখেছিলেন ছোটদের জন্য। তোহা খানের ছোট আরও দুই ভাই আছে। তাদের মধ্যে একজনকে আমরা বসুবাজারের ছেলেপেলেরা যমের মতো ভয় পাই। ইয়া বড় গোঁফ। শরীরের রং উজ্জ্বল। অনেকটা লালচে টাইপের। মন্টু খান আমাদের ভয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ।

অসম্ভব সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্বের সময় তার ওপর পাকিস্তানি আর্মি অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার সেই ঘটনা নিয়ে একটি অসাধারণ বই লিখেছিলেন। বইয়ের নাম ‘হায়েনার খাঁচায় অদম্য জীবন।’ তার ছোট ভাই আবেদ খান। একেবারে সাধাসিধে ধরনের মানুষ। চিকন চাকন গড়নের। চোখে কড়া পাওয়ারের চশমা পরেন। আর হাঁটেন! একেবারে কাকতাড়ুয়ার মতো হেলেদুলে। তোহা খানদের বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে মল্লিক বাড়ি । ক্ষয়াটে ইটের তৈরি তিনতলা মল্লিক বাড়ির ছাদে বিকেলে কম করে হলেও শ’খানেক পোলাপান উঠত শুধু ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য। মল্লিক বাড়ির পাশেই বিশাল জায়গাজুড়ে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সাহেবের বাড়ি । সেই বাড়িতে ছিল রাজ্যের গাছ গাছড়ার আখড়া। আর বিকেল হলেই সেই বাড়ি থেকে ড্রাম-ঢোলের শব্দ ভেসে আসত । কচিকাঁচার আসরের ছেলেমেয়েদের সমাবেশ ঘটত সেখানে।
ছোটবেলায় বাবা-মার কড়া নির্দেশ, খবরদার একা একা কখনো বসুবাজার লেন, মনির হোসেন লেন ছেড়ে কোথাও যাবি না। একেবারে হুকুমজারি আর কি ! তারপরও সেই বয়সে কখনো কখনো চলতি রিকশার পেছনে খুব সন্তর্পণে, আলগোছে শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়তাম যে রিকশাওয়ালা টেরই পেত না। অনেক পরে যখন রিকশাওয়ালা অনুভব করত তার রিকশা চালাতে বেগ পেতে হচ্ছে তখন সে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেত বাঁদুরের মতো আমি কিংবা আমার বন্ধুদের কেউ ঝুলছে। কি বিশ্রী গালি যে দিত রিকশাওয়ালা! আমরা রিকশার পেছনে চড়ে চড়ে চলে যেতাম শরতগুপ্ত রোড, নারিন্দা, দক্ষিণ মৈশু আবার কখনো কখনো ওয়ারি, টিপু সুলতান রোড।

ও রকম রিকশার পেছনে চড়তে গিয়ে ধরা পড়ে অনেকটা পথ হেঁটে বসুবাজার লেনে ফিরে আসতে হতো। তখন কখনো কখনো আমরা নাসির উদ্দিন সাহেবের কালো রঙের ভক্স ওয়াগন গাড়ি দেখতাম। কি ঝকমক করত গাড়িটা ! আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা ঝকমকে রঙের গাড়িও দেখতাম আবার গাড়ির ভেতর থাকা সুন্দর সুন্দর মানুষও দেখতাম।

আমার মতো কিশোরের চোখের সামনে দিয়ে নাসির উদ্দিন সাহেবের কালো রঙের ভক্স ওয়াগন গাড়িটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে ।
আমি শুধু দেখতাম। শুধু দেখতাম।

তিন.
বাড়ির মালিক হলে কি হবে আমার বাবার সঙ্গে প্রায় সময়ই আজিজ সাহেব আড্ডায় মেতে থাকতেন। বাবার বৈঠকখানা, যেখানে সেলফের পর সেলফ জুড়ে আইন বিদ্যার ভারী ভারী বই সাজানো থাকত। বৈঠকখানায় আজিজ সাহেব এসে কাঠের চেয়ারে বসতেন। তারপর তিনি চড়া গলায় প্রায় হুকুমের সুরে বাবাকে বলতেন, উকিল সাব , ভাবি সাবের হাতে এক কাপ চা খাওন যাইবো নি ?
কি যে বলেন!
যখন আজিজ সাহেবের মন মেজাজ ভালো থাকত তখন বাবাকে দেখলে হেসে হেসে বলতেন, উকিল সাব, টেকা পয়ছা খরচা কইরা, মিস্ত্রি-উস্ত্রি লিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফালায়া বাড়ি বানাইলাম আমি আর আপনের মক্কেলরা বসুবাজারে আয়া আমারে জিগায়, ভাই, উকিল সাহেবের বাড়িটা কোনটা? তহন ভাই মনের ভিত্তে রাগের আগুন হুড় হুড় কইরা বাইরা যায়। কন, আপনেই কন উকিল সাব বাড়িওয়ালা হইয়া এই কথা আমি কেমতে মাইনা লই?
আমার বাবা তখন আজিজ সাহেবকে বলেন, ভাই সাব, আমার কি দোষ।
আজিজ সাহেব তখন হাসতে হাসতে বাবাকে বলতেন, দোষ আপনের না, দোষ আপনের কপালের।
বাবা অবাক বনে উত্তর করেন, মানে কি !
মানে আর কি আপনে উকিল না হইয়া যদি কোর্ট কাচারির কেরানি-মেরানি হইতেন তাইলে মহল্লার মাইনসের কাছে আমারে আর এই কথা হুনতে হইতো না।
আজিজ সাহেবের কথায় আমার উকিল বাবা হাসতেন আর বলতেন, আমার মতো দুই পয়সার উকিল আপনে কোর্ট কাচারিতে হাজারে বিজারে পাইবেন।
উকিল ছাব, আপনে কি হিন্দু বিহারি গো থিকা কম দামে বাড়ি খরিদ করবেন?
আজিজ সাহেবের কথার প্রতি উত্তরে বাবা বেশ শক্ত করে জবাব দিতেন, এইরকম বাড়িঘর ইচ্ছে করলে তো আমি কয়েক ডজন কিনতে পারতাম।
তাইলে কিনেন নাই কেন?
মানুষ বিপদে পইড়া পঞ্চাশ হাজার বাড়ি পাঁচ হাজারে বিক্রি কইরা দেশ ছাইড়া ভাগবো-আমি সেই বাড়ি কিনুম?
কেন, সমস্যা কি উকিল ছাব ?
ওসব আপনে বুঝবেন না।
আপনেরে কোন হালায় উকিলের লাইনে আইবার কইছে? আপনে দরবার শরীফের হুজুর হয়া যান বলে আজিজ সাহেব দাঁত বের করে হাসতে থাকেন।
বাবা আর কিছু বললেন না। এরপর থেকে বাবা আজিজ সাহেবের সঙ্গে যতটা সম্ভব কম কথা বলেন । তাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলেন।
খুব কম বয়সে বাবা-মা মারা গেলে আমাদের ছয় ভাইবোনকে নিয়ে ধূসর রঙের এক বিকেলে আমার মায়ের সাজানো সংসারের সব মালামাল ট্রাকে উঠিয়ে বসুবাজার লেনের বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। ছয় মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে গেলে আজিজ সাহেব আমতা আমতা করে আমার নানীকে বললেন, এমতে কইরা আর কয়দিন চলবেন? উকিল ছাবেরে কতো কইরা কইলাম, বুঝাইলাম বি, মাগার কে হুনে কার কথা! আইজ বসুবাজারে এক খান নিজের বাড়ি থাকলে এই মাসুম বাচ্চাগো লিয়া আপনেরে এতো চিন্তা করতে হইত না। আমার ছয় মাসের বাড়ি ভাড়া আমারে দেওনের দরকার নাইক্কা। আপনে খালি বাড়িটা ছাইড়া দেন।

একদিন আমি এরকম এক গলির মুখে পুরান ঢাকার কথা মনে করে থমকে দাঁড়ালাম
একদিন আমি এরকম এক গলির মুখে পুরান ঢাকার কথা মনে করে থমকে দাঁড়ালাম

চার.
বসুবাজার লেন ছেড়ে আসার পর আমি আর দীর্ঘদিন ঐ এলাকায় যাইনি। একটা অলিখিত লজ্জা, অপমান, উপেক্ষা আর সীমাহীন অভিমান নিয়ে আমি বসুবাজার লেন থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা যায় সেই নীতিই অবলম্বন করেছি। বসুবাজার লেনের বাড়ি থেকে শেষ বিকেলে ট্রাকে করে যখন দয়াগঞ্জের লাল মাটির রাস্তার ধুলো উড়িয়ে আমাদের ট্রাক মেথর পট্টির মাঝখান দিয়ে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন আমার বন্ধুরা ট্রাকের পেছনে দাঁড়ানো আমাকে, আমার অন্য ভাইদের দিকে কেমন করে যে তাকাচ্ছিল! ওদের তাকানোর মধ্যে কি ছিল !
আজ এতদিন পর মনে হয় সেদিন আমার বন্ধুরা আমাদের অমন করে, ধূসর রঙা বিকেলে খেলা ফেলে আমাদের চলে যেতে দেখে ভাবছিল, উকিল ছাবের পোলাপানগুলা হইছে বাপের মতো বেক্কল।
এই বিকালবেলা খেলাধুলা ফালায়া রাইখা কি কেউ মহল্লা ছাইড়া ভাইগা যায়!
এরপর জীবনযাপনে কত না বাঁক বদল হলো। এক পর্যায়ে জীবনের না মিলানো হিসাব মিলানোর জন্য আমাকে দীর্ঘ ৯ বছর ইতালির মিলানো শহরে থাকতে হয়েছে। মিলানোতে যেদিন আমি প্রথম দিন পা রাখলাম সেদিন আমার মন ঝকমক করে উঠল। খলবল করে উঠল আমার ফেলে আসা শৈশব ।
মিলানোর ফুর্তিবাজ, রসিক, আড্ডাবাজ বন্ধুবৎসল মানুষজন, পুরনো স্যাঁতস্যাঁতে বাড়িঘর, পাথরের ছোট ছোট ব্লক দিয়ে তৈরি রাস্তা, পুরনো মডেলের গাড়ি, হোটেল, কাফে আর হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো পুরনো স্মৃতির গন্ধেরা আমাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল অনেক দিন আগের ফেলে আসা পুরান ঢাকায়। বসুবাজার লেনে।

মিলানোতে থাকার সময় প্রতিটি মুহূর্তে আমার মনে হয়েছে আমি বুঝি কোন দৈববলে ফিরে গেছি আমার পুরান ঢাকায় । পুরান ঢাকার বাতাসে মন-প্রাণ ভালো করে দেওয়ার মতো একটা ব্যাপার আছে যেটা আমি মিলানো শহরেও পেয়েছি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)