চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘বলে দিও তাঁদের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান’

গল্পটা বরিশালের হোসেনপুর গ্রামের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক সৈনিক আব্দুল জব্বারের (জবেদ) কন্যা মনোয়ারা বেগমের।

মাধবপাশার ‘বাদলা’ গ্রামে মনোয়ারার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছিল গহর খলিফা নামে এক স্থানীয় ব্যবসায়ীর সাথে। সেই সূত্রে সে বড় হয়েছে বাদলা গ্রামে। সময়টা মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ের। তখন প্রকৃতির সাথে মানুষের এক নিবিড় বসবাস আর মনোয়ারা সেই প্রকৃতিরই এক গ্রাম্য কিশোরী হিসেবে সেখানে বড় হচ্ছিল।

মায়ের আবার বিয়ে হওয়ায় সেই কিশোরীর জীবনের গল্পটা একটু অন্যরকম ছিল। সেই টানাপোড়েন জীবনে হঠাৎ ক’রেই একটা সময় শুরু হল বাঙ্গালীর ‘মুক্তিযুদ্ধ’। বয়স তখন তার ষোলো বা সতেরো হবে। তখনও সে ‘মাধবপাশা’ গ্রামে মায়ের সাথেই।

১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে বাবার খবর সে তেমন কিছু জানতো না। একটা সময় দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং তা গ্রামেগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। একদিন তার গ্রামের চারিদিকে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ—গোলাগুলি হচ্ছে কে কোথায় পালাবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। পরিবারে আগের দুই বোনসহ মোট ছয় ভাই-বোন। তার উপর মনোয়ারার নানীও তখন জামাই বাড়িতে। সে সময়টাতে ভয়ে গ্রাম থেকে মানুষজন সব পালিয়ে যাচ্ছে। পুরো গ্রাম বলতে গেলে প্রায় জনশূন্য হবার অবস্থা। পালাচ্ছে কারণ ভাবছে মিলিটারীরা নদী পার হয়ে ওপারে ‘চরকাউয়া’য় যেতে পারবে না। নানিও ওপারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কারণ ওপারেই মনোয়ারার নানাবাড়ি। তাই মনোয়ারাকে নিয়েই তাঁর নানি রওনা হন।

পায়ে হেঁটে চলতি পথের ক্লান্তি মৃত্যু ভয়ের চেয়ে তাদের বেশি মনে হল না। নতুল্লাবাদ আসতেই তাদের সন্ধ্যা হয়ে যায়। একটা বাড়ির গোয়াল ঘরে ওরা নানি-নাতনি আশ্রয় নিল। খাবার হিসেবে ছিল মায়ের তৈরি করে দেওয়া চাল ও ডালের ক্ষুদ দিয়ে বানানো চাপড়ি। জায়গাটা স্যাঁতসেতে জঙ্গলাকীর্ণ। মশার কামড়, শিয়ালের ডাক, সাপ ও জোঁকের ভয়। ওঁরা একে অপরকে জাপ্টে ধরে রাতটা কোনোমতে কাটায়। পরেরদিন ভোরবেলা আবার নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বরিশাল শহরে এখন যেখানে জেলাখানা—পিছনে ছিলো ঝোঁপ-জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ওরা খেয়া ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছায়। সেই ঘাটের মাঝি হৈজন যখন ওঁদের পার করে দিচ্ছে সে সময় তোজুম্বর নামে এক লোক জাল বুনছিল আর তার কাছেই জানা গেল ওই গ্রামেও নাকি মিলিটারি হানা দিয়েছে। কাওয়ারচর গ্রামের ঘাট থেকে দেড় দুই কিলোমিটার ভেতরে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর ওঁরা জানলেন, মিলিটারিরা যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করছে। ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মানুষদের বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। মনোয়ারার নানা বাড়িতেও নাকি আগুন দিয়েছে ইতিমধ্যে। নানা বাড়ির সাথেই মোটা একটা কড়ই গাছ ছিল এবং তার পাশে অনেক জঙ্গল। সেই কড়ই গাছের নিচে মনোয়ারারা চুপ করে বসে থাকে। দেখতে পায়—নানা বাড়িতেও দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। দেখতে পায়—অনেক লোককে একসাথে এক দড়িতে বেঁধে গুলি ক’রে খালের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।

সেখানে একটা গণহত্যাযজ্ঞ চললো পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা—যার চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে রইলো মনোয়ারা। এরপর পাকিস্তানি হায়নার দল মনোয়ারাকেও ধরে ফেলে। হঠাৎই এক বড় মোটা হাতের থাবা তার ওপর এসে পড়ে! হায়নার দলের একজন মনোয়ারাকে চুল ধরে দাঁড় করায়। একদিকে মৃত্যু ভয় অন্যদিকে চোখের সামনে মৃতের স্তুপ-ভাইদের লাশও আছে। নির্মম সে হত্যাকাণ্ড—মাথার ঘিলু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব দৃশ্য দেখে মনোয়ারার নানি পাগলের মতো হয়ে গেলেন এবং তখনই তাঁর আকস্মিক মৃত্যু হলো। এরপর শুরু হয় মনোয়ারার গগনবিদারী কান্না। সেই কান্নায় ছিল বাঁচবার আকুলতা- ‘আমারে ছাইড়া দেন। নানি, ও নানি, আমারে ধইরা নিয়া যাইতেছে।’

টানতে টানতে ওরা মনোয়ারাসহ আরও চার পাঁচ জন মেয়েকে ওদের গান বোটে নিয়ে উঠালো। সেখানে আরও চারটা মেয়ে। গোডাউনের পাশে বরিশাল সদর হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের একটি আবাসিক ভবন ‘ফোরকান কোয়ার্টার’ ওখানে নিয়ে মেয়েগুলোকে দোতালায় উঠানো হলো। দোতালার সম্মুখে মাঠ আর নতুন অনেক ইটের স্তুপ। ওদের খাওয়া-দাওয়া নাই দীর্ঘক্ষণ। অপহৃত ওঁরা সবাই আতঙ্কে কাঁপছিল। কখন জানি কী হয়! সন্ধ্যার দিকে সবাইকে আলাদা আলাদা করে ভাগ করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। এরপর শুরু হয় ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন। ওইদিন তিন জন পাকিস্তানি সেনা একসাথে মনোয়ারাকে ধর্ষণ করে। তারপর থেকে দিনের পর দিন এভাবেই চলতে থাকে তাদের জীবন।

কিশোরী-যুবতী এবং মধ্যবয়সী অনেক নারী ক্যাম্পে বন্দী ছিল। প্রতিদিন তাঁদের ওপর পাশবিক শারীরিক নির্যাতন করা হত। শরীর হতো ক্ষত-বিক্ষত। সমস্ত শরীরে নরপশুদের কামড়ের দাগ। পানি খেতে চাইলে প্রস্রাব করে দিত। কিল, ঘুষি, লাথি মারত। বুট দিয়ে পারাতো। অকথ্য নির্যাতনের পর কখনো কখনো ফোরকান কোয়ার্টারের বাঙ্গালী এ মেয়েগুলো অজ্ঞান হয়ে যেত। মাঝে মাঝে ওদের কয়েক জনের নাম শুনতে পেতো মনোয়ারা—সরফরাজ, মেহেদি খান, ইউনুস খান, জামশেদ এরকম আরও অনেক পাকিস্তানীর নাম। মাঝে মাঝে নির্যাতনের পরে জ্ঞান ফিরলেও অজ্ঞানের মতো ভান করতো- এটা বুঝতে পেরে একদিন একজন এসে মনোয়ারার চুল ধরে তার মাথা ও মুখ দেয়ালের সাথে ঘষে রক্তাক্ত করে দেয়। সেই কাটা দাগ এখনো মনোয়ারার কপালে রয়ে গেছে সেই ভয়াল বেদনার স্মৃতি হিসেবে।

এভাবে ক্যাম্পে তাঁর প্রায় তিন মাস কাটে। একদিন হঠাৎ করে পাকি সেনারা শুধু মনোয়ারাকে অন্য একটি সেলে নিয়ে যেয়ে প্রশ্ন করে—‘তুমহারা ভাই কীধার হ্যায়? ম্যায়নেতো সুনা হ্যায় তেরা ভাই মুক্তি হ্যায়, মুঝে বাতাও।’ মনোয়ারার খালাতো ভাই জালাল মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সিলেটে মুক্তিবাহিনীতে ছিলেন কিন্তু বিষয়টি গোপন থাকে না। স্থানীয় রাজাকারেরা পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে এই খবরটি সযত্নে পৌঁছে দেয়। যার কোন কিছুই মনোয়ারা তখন জানতো না। কিন্তু তারপরেও পাকি সেনারা মনোয়ারাকে পাওয়ার হাউজের (এখনকার ওয়াপদা) টর্চার সেলে নিয়ে যায়। কত মানুষের যে আহাজারি তখন সেখানে! কতজনকে ঝুলিয়ে রেখেছে। অনেকের পেটের ভেতর বেয়নেট ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সবাই ভয়ার্ত স্বরে ‘ওরে মা, ওরে বাবা’ বলে চিৎকার করছে। কয়েকজন সেনা মেয়েদের স্তন কেটে দিচ্ছে। সব কিছু মনোয়ারার চোখের সামনেই ঘটছে। সর্বত্র শুধু আর্ত চিৎকার আর পাশবিকতার আওয়াজ। প্রায় পাঁচ থেকে সাত দিন মনোয়ারার কাটে ওখানে। খাবার হিসেবে দিত শুধু রুটি। এই সময় একদিন হঠাৎ করেই অনেক জোরে প্লেন আসা-যাওয়ার শব্দ শোনা যায়। মনোয়ারার মনে হয়— কিছু একটা হতে চলেছে আজ। কিছুক্ষণ আগে থেকেই সবকিছু যেন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে পরপর কয়েকটি বোমার বিকট শব্দ শোনা যায়। বাংলার মুক্তিসেনারা আর ভারতীয় মিত্রবাহিনী পাকিস্তানী শকুনদের ঘিরে ফেলে। পাকিস্তানী পশুগুলো তখন পালানোর পথ খুঁজছিল। শুরু হয় ওদের ছোটাছুটি। পাকিস্তানী হায়েনার দল পালানোর আগে বলছিল, ‘ইহাছে সব চলো, মুক্তি আয়া হ্যায়!’ অবশেষে পাকিস্তানী শকুনদের দল সব ফেলে রেখে ভয়ে পিছু হটলো। একদিকে ওরা পালাচ্ছে একইসাথে সশস্ত্র মুক্তিসেনারা চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে। কিছুক্ষণ পর গগনবিদারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হলো শহর বরিশাল। অবশেষে বরিশাল শত্রুমুক্ত হলো।

তখন কারা যেন মনোয়ারাকে নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি করেছিল তা ঠিক মনোয়ারার মনে নেই। হাসপাতালে প্রথম চোখ মেলে স্বাধীনভাবে ‘বাঁচার কী সাধ’ তা যেন নিজের জীবনের চরম অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করলো সে। ঐ হাসপাতালের স্নেহময়ী মেট্রন দিদি ও ইভা নামের হিন্দু সিস্টার আর মেরি পলিন নামের খ্রিস্টান দিদিরসেবার কথা মনে পড়ে তার। মনোয়ারার মতো চারিদিক থেকে সবাই শুধু তাঁদের ডাকাডাকি করতে থাকতো ‘সিস্টার-সিস্টার’ বলে। মনোয়ারাকে যে ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল সেখানে আরও অনেক নির্যাতিত মেয়েরা ছিল। মনোয়ারার পাশের সিটে একটা মেয়ের একটা স্তন কাটা ছিল। সে অনেক কষ্ট পেত। এ পরিবেশে প্রায় একমাস থেকে মনোয়ারা কিছুটা সুস্থ হয়।

শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায় মনোয়ারা। হাঁটতে হাঁটতে বরিশাল সদর হাসপাতাল থেকে মাধবপাশার বাদলা গ্রামে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয় সে। মনে তখন তার নতুন করে বেঁচে থাকার আশা! বাড়ি ফিরে তার বাবা, মা, ভাই-বোনের দেখা পায় সে। যদিও বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দু’একজন এলাকার লোক তাকে দেখে ভুরু কুঁচকে কী যেন বলাবলি করছিল। ওদের এড়িয়ে মনোয়ারা সোজা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। দেখতে পায় তার বাবা বাড়িতেই। তিনি একটা চৌকির উপর বসা ছিলেন। মনোয়ারার মা দৌঁড়ে এসে মনোয়ারাকে জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু মনোয়ারার বাবা রাগত স্বরে মনোয়ারাকে বলেন, ‘তুই এই বাড়ি আইছস ক্যা- তুই এহনি বাড়ি থ্যাইক্যা বাইর হইয়া যাইবি। মোগ দ্যাশ তোর জন্যি আর না।’ তারপর মনোয়ারার মাকে সাবধান করে বলেন, ‘যদি তোর মাইয়ারে এ বাড়ি রাখস মুই বাড়ি ছাইড়া চইলা যামু। অহন তুই ঠিক করবি তুই কি করবার চাস।’ এ অবস্থায় মা মনোয়ারাকে বলেন, ‘যা মা, তুই অন্য কোথাও চইলা যা।’ মনোয়ারা মাকে বলে, ‘আমি কোথায় যামু?’ মা বলেন, ‘তুই যদি থাকস, সে আমারে সব পোলাপাইনসহ বাড়ি থ্যাইক্যা বাইর কইরা দিবে।’ সবার কথা চিন্তা করে অবশেষে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় মনোয়ারা।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাটঁছে আর চিন্তা করছে মনোয়ারা এখন সে কোথায় যাবে, কী করবে? ভাবতে ভাবতে তাঁর চোখ ভিজে আসে। পাকিস্তানী সেনারা তাঁর নানি বাড়ির ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দিয়েছে। নানীও মৃত। হাঁটতে হাঁটতে মনোয়ারা বরিশাল সদর রোডের কাছাকাছি এসে পৌঁচ্ছায়। তখন সন্ধা হয়ে গেছে। এ সময় অশ্রুসিক্ত মনোয়ারাকে দেখে একজন অচেনা পুরুষ এগিয়ে আসে। জানতে চায় কান্নার কারণ। মনোয়ারা তার দুঃখের কারণ খুলে বলে তাকে। অচেনা লোকটি সবকিছু শোনার পর মনোয়ারাকে প্রস্তাব দেয় তার সাথে বাগেরহাটে তার বাসায় যাওয়ার জন্য। নিরুপায় মনোয়ারার তখন যাওয়ার কোনো জায়গা নেই । মনে ভয় থাকলেও কিছু করার ছিল না তখন। চারিদিকে সবারই তীব্র অভাব অনটন আর সমস্যার পর সমস্যা। কে থাকতে দেবে তাকে? কে দেবে খেতে? এসব ভেবে মনোয়ারার মন সায় দেয়। লোকটাকে তার ভালো মনে হয়। লোকটি তাকে বলে তার বাড়ি বাগেরহাট। সে তার এক আত্মীয়কে দেখতে এসেছিল এই সদর হাসপাতালে। এসব ব’লে সেই অচেনা লোকটি মনোয়ারাকে স্টিমারে করে পরদিন বাগেরহাট সিনেমা হলের (লাইট হল) পিছনে নিয়ে যায়। অনেক মেয়েরা ছিল সেখানে। অচেনা লোকটি মনোয়ারাকে বলে ‘এরা আমার বোন, খালা’। কিন্তু তাদের দেখে মনোয়ারার মনে হল এরা গ্রামের সাধারন বউ মেয়েদের চেয়ে একটু আলাদা। পরিচয়ের পর একটা মেয়ে এসে মনোয়ারার নাম জানতে চায় আর ডিম ভাত খেতে দেয়। মনোয়ারা তখনও বুঝতে পারেনি এরপর তার জীবনের আরেক অভিশপ্ত অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে।

খাওয়ার সময় অচেনা লোকটি মনোয়ারাকে বলে ‘তুমি এখানে থাকো, খাওয়া-দাওয়া করো, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।’ এরপর থেকে অচেনা লোকটি নিরুদ্দেশ। ঘন্টা যায়, রাত যায় দিন আসে, কিন্তু অচেনা লোকটি আর ফিরে আসেনি। মনোয়ারা পরে জানতে পারে যে, তাঁকে এখানে বিক্রি করা হয়েছে।

যার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল তার নাম ছিল মালা। ওরা তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আর ভয় দেখিয়ে ঐ রাস্তায় চলতে বলে এবং কথা না শুনলে বাধ্য করে। মনোয়ারা এক সময় ওদের হাতের পুতুল হয়ে যায়। কারণ তাঁর পালিয়ে যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না এবং সুযোগও ছিল না। গেটে সবসময় পাহারাদার থাকতো ইচ্ছে করলেই বের হওয়া যেত না। তাই সহজে কেউ পালাতেও পারত না। এভাবে হাত বদল হয়ে মনোয়ারার জীবন কাটতে থাকে বাগেরহাট, খুলনা, মাদারীপুর এবং সবশেষে ফরিদপুর কালিবাড়ীতে। কালিবাড়ীতে থাকাকালীন সে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। সন্তানটি একটু বড় হওয়ার পর মনোয়ারা বরিশালে মাকে দেখতে যায়। তখন তার বাবা মারা গেছেন। দীর্ঘদিন পর মা-মেয়েতে দেখা হয়।

মনোয়ারা অভিযোগের স্বরে মাকে বলে, ‘আমার জীবনটা এমন হত না যদি তোমরা আমাকে সেদিন আশ্রয় দিতে মা’। উত্তরে মা বলেন, তিনি অসহায় ছিলেন। কারণ, উনি মনোয়ারার আপন বাবা ছিলেন না। মনোয়ারাকে কোলে নিয়ে তিনি দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হয়েছিলেন। (বিষয়টা মনোয়ারা তখনই প্রথম জানতে পায়) মনোয়ারার আসল বাবার বাড়ি ছিল হোসেনপুর, গাভা রামচন্দ্রপুর, বরিশাল। বাবার নাম— আব্দুল জব্বার। এলাকায় তাকে সবাই ‘জবেদ’ বলে ডাকত। সম্পর্কে মনোয়ারার বাবা-মা ছিলেন আপন খালাতো ভাইবোন। মনোয়ারার বাবা ভারতে মিলিটারির চাকরি করতেন। পরিবারের খোঁজ খবর নিতেন না বলে এক সময় তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মনোয়ারার মা তখন আমি যুবতী। বাধ্য হয়ে তাঁর মা তাঁকে অন্য জায়গায় বিয়ে দেন। তারপর থেকে তিনি এই বাদলা গ্রামে মনোয়ারাকে নিয়ে নতুন সংসার শুরু করেন। মনোয়ারার নতুন বাবার নাম গহর খলিফা।

মায়ের কাছে নিজের জীবনকাহিনীর প্রথম একটা অংশ শুনতে পায় মনোয়ারা । এরপর মা শুনলেন মেয়ের কাছে মেয়ের জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলো।

এরপরে মনোয়ারা আবার ফেরত চলে যায় সেই আগের জায়গায় আগের জীবনে। ফরিদপুরে। মাঝে মাঝেই এই ভেবে তাঁর মন অনেক খারাপ হত। এইভাবেই কি বাকী জীবন কাটাতে হবে? এরপর একদিন এক পুলিশের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ওখানে আসতেন। জিজ্ঞেস করতেন—‘কী হয়েছে তোমার? সারাক্ষণ মন খারাপ থাকে কেন?’ একদিন মনোয়ারা সবকিছু তাকে খুলে বলেন। সব কিছু শুনে তিনি মনোয়ারাকে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি দিলেন। তিনি ছিলেন মনোয়ারার কাছে একজন প্রকৃত ভালো মানুষ। কারণ, তিনিই প্রথম মনোয়ারাকে বিয়ে করে স্ত্রীর সম্মান দেন আর মনোয়ারার মেয়েকে বাবার ছায়া দেন। এ সুখ ও ছায়াও বেশীদিন স্থায়ী হলো না। মনোয়ারার স্বামী মারা। তারপর থেকে তিনি তার মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে বেঁচে আছেন।

একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানী সেনারা মনোয়ারাকে যৌনদাসী বানিয়ে ব্যবহার করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজও পরবর্তীতে তাঁকে সেই ভূমিকাতেই বন্দি করে রেখেছে। মুক্ত স্বাধীন নাগরিকের সন্মানের জীবন তার ভাগ্যে জোটেনি। স্বাধীনতার এত বছর পর যখন এই বীরাঙ্গনা নারী মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি হই তখন নিজের অজান্তেই একটা অপরোধ বোধ ঘিরে ধরেছে আমাদের। প্রথম সাক্ষাতে যখন প্রশ্ন করি তাঁকে—‘এত বছর পার হয়ে গেল এতদিন কেন মুখ খোলেননি? এ প্রশ্নের জবাবে জীবনের একদম শেষ প্রহরে পৌঁছে যাওয়া মনোয়ারা বেগম বলেছেন, ‘স্বামী, সমাজ, মেয়ে ও নাতি নাতনিদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কথা আমি বুকে জমা রাখছিলাম। সমাজের অবহেলার জন্য আমি মুখ খুলতে পারি নাই।’

মনোয়ারা আক্ষেপ করে আরও বলেন, ‘বাবার আদর-ভালোবাসা পাই নাই। আমার মেয়েটাও কিছু পাইলো না। আমাকে এই সমাজ-সংসার আজও মাইন্যা নেয় নাই । অথচ এ ঘটনা গুলার জন্য আমি দায়ী না। ৭১-এ দ্যাশ স্বাধীন হবার পর একজনই শুধু মাইন্যা নিছিলেন—সেই মানুষের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আমাদের বাবার নামের জায়গায় লিখতে বলছিলেন ‘শেখ মুজিবুর রহমান’!

হয়তো মেয়েদের অন্তর এক বিশাল সমুদ্র। হয়তো তাঁর গহীনেই সে জমিয়ে রাখে থাকে সব। মনোয়ারার মতে, মুক্তি সংগ্রামের পর যে সকল বীরাঙ্গনা নারীদের তাদের নিজের পিতার বাড়িতে ঢোকার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাদের জন্য বঙ্গবন্ধু নিজ সন্তানের সন্মান দিয়ে দরজা খুলে দিয়ে গেছেন। তাই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরই তার ঠিকানা। নিজেকে তিনি আজ শেখ মুজিবের কন্যা বলেই মনে করেন। আর তাই তার অন্তরের সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে সুঁইসুতো দিয়ে তিনি সাদা ক্যানভাসে ফুঁটিয়ে তুলেছেন বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিকৃতি। দিনের পর দিন বছরের পর বছর ধরে তিনি এই সূচিকর্মটি করেছেন বাঙ্গালী জাতির পিতার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)