ভাষা সংগ্রামী তকীয়ূল্লাহ। পুরো নাম আবুল জামাল মুহাম্মদ তকীয়ূল্লাহ। পিতা ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯২৬ সালের ৪ নভেম্বর দেওয়ালী আমাবস্যা রাতে জন্ম। ৭ ভাই দুই বোনের মধ্যে চতুর্থ তকীয়ূল্লাহ।২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন এই ভাষা সংগ্রামী।
পরিচিতি: আবুল জামাল মুহাম্মদ তকীয়ূল্লাহ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে নির্বাচিত হওয়া প্রথম বাঙালি। ভাষা আন্দোলনের কারণে আর সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া হয়নি। ভাষা আন্দোলনসহ নানা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এই কমিউনিস্ট নেতা। ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ এবং ল’ তে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন রাজবন্দী। ১৯৬২ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তার হন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অনেকটা গুটিয়ে থাকেন প্রচার বিমুখ এই মানুষটি। স্বাধীনতার আগে থেকেই জুট মিলে কাজ করেছেন। ১৯৮০ সালে ঢাকা জুট মিল থেকে অবসর নেন। ১৮ বছর গবেষণা করে ইংরেজী বাংলা এবং হিজরী শতাব্দের ক্যালেন্ডার তৈরি করেছেন যা এখন বাংলাদেশে অনুসরণ করা হচ্ছে।
২০০৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভাষা সংগ্রামী তকীয়ূল্লাহর সাক্ষাতকার নিয়েছেন তারিকুল ইসলাম মাসুম।
তা ই মাসুম: স্যার, ভাষা আন্দোলনে আপনার অংশগ্রহণ বিষয়ে জানতে চাই।
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: আমি ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় ব্রিটিশ মিলিটারি স্কুলে নির্বাচিত হই। ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাশের পর, একটি বিশেষ সার্ভিস সিলেকশন বোর্ডের অধীনে। নারিকেল ডাঙ্গাতে ছিল মিলিটারি ট্রেনিং স্কুল। এর প্রিন্সিপাল ছিলেন জেমস বুকানন, যিনি ব্রিটিশ হোমগার্ড বাহিনীর প্রধান ছিলেন। ট্রেনিং শেষে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাইলে মধ্য প্রদেশের দেরাদুনে সার্ভিস সিলেকশন বোর্ড পরীক্ষা দিয়ে পাশ করি। কিন্তু বয়স কম হওয়ার কারণে এক বছর পর যোগ দেয়ার জন্য বলা হয়।
পাকিস্তান সরকার ফোর্টি সেভেনের শেষে আর্মির জন্য টেরিটোরিয়াল ফোর্স, পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড করে। টুয়েন্টি ফার্স্ট নাম্বার ক্যাম্পে ১ জানুয়ারি ট্রেনিংয়ে চলে গেলাম। আমি সেখানে চান্স পেলাম। তখন ভাষা আন্দোলন আরম্ভ হয়ে গেছে। আসল ভাষা আন্দোলন। ফোর্টি এইটের জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ট্রেনিংয়ে ছিলাম। এর মধ্যে আইএসএসবি’তে পরীক্ষা দিলাম। সেকেন্ড পিএমএ (পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি) কোর্সে নির্বাচিত হলাম। প্রথম বাঙালি হিসেবে পাকিস্তান আর্মিতে নিয়োগ পেলাম।
ফোর্টি সেভেনে দেশ ভাগ হল ফোর্টিন্থ আগস্ট। জুনে ডিসিশন হল, ঠিক হল ভাগ হচ্ছে, স্বাধীনতা দিবে ব্রিটিশরা। সেই সময় থার্ড আগস্ট নাইন্টিন ফোর্টি সেভেন, ১১ দিন আগের কথা। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাপ্তাহিক কমরেড পত্রিকায় একটা আর্টিকেল লিখলেন, ‘ল্যাংগুয়েজ প্রব্লেম অব পাকিস্তান’। পরে আজাদে বের হল।
সেই লেখাতে ডক্টর শহীদুল্লাহ বললেন, যদি বাংলাদেশের কোর্ট-কাচারী এবং স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালতের ভাষা বাংলা ছাড়া অন্য কিছু হয়,শিক্ষার মাধ্যম যদি অন্য কিছু হয়, এটা হবে পরাধীনতার নামান্তর।
পার্টিশনের পরে সারা বাংলার রাজনৈতিক কর্মী, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টিসহ সব রাজনৈতিক কর্মীদের নিয়ে আগস্টের শেষে ২৬ আগস্ট ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলন আয়োজন করে। সেই সময় সেই কর্মী সম্মেলনে যোগ দিতে বগুড়া থেকে ঢাকায় আসলাম। সেই সম্মেলনের বড় কথা আসল রাষ্ট্রভাষা। রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলা না হয় তাহলে কিসের স্বাধীন হলাম?সেই সম্মেলনের রেজ্যুলেশনে প্রথম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
এর মধ্যে পাকিস্তান গভর্নমেন্ট পোস্টাল ফর্মে ইংরেজি এবং উর্দু সিল মারল। সেই সিলে বাংলা নাই। যখন পাকিস্তান মুভমেন্ট হয়, লাহোর রেজ্যুলেশনে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক উনি তুলেন ২৩ মার্চ। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের ন্যাশনাল ডে নাইন্টিন ফোর্টি ওয়ানে। এই লাহোর রেজ্যুলেশনে বলা হল, মসুলিম অধ্যুসিত এলাকাগুলো পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত এক বা দুইটা সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। সেই জন্য ফোর্টি সেভেনের আগে, নাইন্টিন ফোর্টি সিক্সে নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর ‘বৃহত্তর বঙ্গ রেজ্যুলেশন’ এটা ফেল হয়ে গেল। অনেক মেম্বার ছিল, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট সব এমএলএকে এক সাথে বসায় নেয়। হিন্দু এবং মুসলমানদের আলাদা ডেকেছে।
যাহোক, একটা বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলা, যদি যুক্ত বাংলা হত তাহলেও বাংলাই রাষ্ট্রভাষা হতো। ২৬ আগস্টের মিটিং মূলতবী রাখা হল।
কাশেম সাহেব তমদ্দুন মজলিশ প্রতিষ্ঠা করলেন ১ সেপ্টেম্বর নাইন্টিন ফোর্টি সেভেনে। এর মূল দাবি ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা। ১৫ সেপ্টেম্বর একটা বই বের করলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু-না বাংলা?’। এই বইতে কাজী মোহাতার হোসেনের আর্টিকেল ছিল। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি যদি না মানা হয় তাহলে অসন্তোষ ধূমায়িত হবে, পূর্ব পশ্চিম বিচ্ছেদ হতে পারে’।
এইভাবে ভাষা আন্দোলন এগিয়ে নিতে তারা কাজ করেছেন। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র একটা বই আছে ‘লেখা এবং শেখা’। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত জানুয়ারিতে পার্লামেন্টে, গণ-পরিষদে বাংলার দাবি উত্থাপন করেন। পূর্ব বাংলার পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হল ফোর্টি এইটের জানুয়ারি। আমি তখন ক্যান্টনমেন্টে। রোববার বন্ধ, শনিবার ঢাকা আসতাম, সোমবার প্যারেডে চলে যেতাম। এই সময় তমদ্দুন মজলিশ বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে, তাদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। ফজলুল হক হলে যেতাম, ফজলুল হক হলের ভিপি ছিল তোহা, মতিন ঐ হলের ছাত্র। এই সময় আমি হলে আসতাম। পোস্টার লিখতাম। এক দিনের জন্য আসতাম আবার চলে যেতাম। যখন ক্রমশ ভাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে তখন তা দমাতে পাকিস্তান সরকার সচেষ্ট। হোল আন্দোলনটা কিন্তু উর্দুর বিরুদ্ধে ছিল না। এটা ছিল বাংলার জন্য আন্দোলন। এই জন্য আমরা পোস্টারে এই স্লোগান লিখতাম, ‘উর্দু বাংলা ভাই ভাই, অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই।
তরপরে ফার্স্ট মার্চ নাইন্টিন ফোর্টি এইট ঢাকায় আসছি, ফজলুল হক হলে। ছাত্রনেতারা ছিল, তমদ্দুন মজলিশের লোকজন ছিল। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ফর্ম হইল। কমরুদ্দিন আহমদ সভাপতি। কনভেনার করা হইল কমরুদ্দিন আহমদকে। পরে রাষ্ট্রদূত হইছিলেন বার্মার। টিটিসি’র টিচার ছিলেন। তিনি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন।
রেজ্যুলেশন হয়, ১১ই মার্চ সাধারণ ধর্মঘট। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রথম ধর্মঘট কল করা হয়। ১১ মার্চ হোল বাংলাদেশে স্ট্রাইক। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েট, পোস্ট অফিস, হইকোর্ট সব অচল হয়ে গেল। স্ট্রাইক সফল করার জন্য ছাত্রদের স্কোয়াড করা হইল। আমার ডিউটি ছিল জিপিও’র সামনে। মুজিব, অলি আহাদ ওদের ডিউটি ছিল সেক্রেটারিয়েটের গেটে। তোহা সাহেব সেকেন্ড গেটে।
পিকেটারদের সাথে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়। পিকেটিং করার সময় সেক্রেটারিয়েটের ফাস্ট গেটে পিকেটিং এ বাধা দেয় পুলিশ।
ঐ দিন অ্যারেস্ট হইল অলি আহাদ, শেখ মুজিবর, এরা সব, রওশন আলম, রফিকুল আলম। ওদের আটক করে। শেখ সাহেবদের কোতোয়ালী থানায় নেওয়া হল। তখন সোহরাওয়ার্দী সাহেব মুখ্যমন্ত্রী। নাইন্টিন ফোর্টি সেভেনে। তো কোতোয়ালী থানায় সোহরাওয়ার্দীর ছবি টানানো ছিল। কোতোয়ালী থানায় নেয়ার পর সোহরাওয়ার্দীর ছবি দেখে শেখ সাহেব স্যালুট করলেন, ‘মাই লিডার বলে’।
আমি ছিলাম সেকেন্ড গেটে। তখন ওবায়দুল্লাহ নামে একজন এসপি ছিল। আর আইজি ছিল জাকের।
ঐখানে লাঠিচার্জে তোহা সাহেব ব্যথা পেলেন। আমি তখন বর্তমান বিএমএ ভবনটা যেখানে ওখানে, তখন মাঠ ছিল। পুলিশ লাঠি চার্জ করছে, আমরা ঢিল ছুড়ছি। আমি তখন আর ঢিল খুঁজে না পেয়ে ওখানে একটা গরুর মাথা ছিল ভাঙ্গা। এসপি’র দিকে ঐ গরুর ভাঙ্গা মাথাটা মারলাম, হা হা হা। তারপরে সড়ে পড়লাম। তাড়াতাড়ি ইউনিভার্সিটিতে চলে আসলাম। ২টায় মিটিং হল পুলিশি হামলা ও অ্যারেস্টের প্রতিবাদে। ফজলুল হক সাহেব ব্যথা পেয়েছেন।
মিটিং শেষে মিছিল শুরু হল ৩টায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ গেট দিয়ে মেডিকেল কলেজ হয়ে হাইকোর্ট হয়ে, সেক্রেটারিয়েট গেটে মিছিল গেল।হাইকোর্টের সামনে থেকে অনেককে আটক করল। ’৪৮এ এরপরে, ’৪৮ না হলে ’৫২ হত না। ১৫ তারিখ পর্যন্ত সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে নাজিমুদ্দিনের বৈঠক হল, জেল থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের বের করে আনার জন্য। অবশেষে ৮ দফা চুক্তি হল। চুক্তিতে বিনাশর্তে সব দাবি মানা হল।
ফোর্টি এইটের মুভমেন্ট সাকসেসফুল হওয়ার পরে কিছুদিন বাংলা ভাষার দাবি আর উত্থাপন করতে হয় নাই। কারণ ৮ দফা চুক্তি হয়েছে, তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় আসলেন ১৯ মার্চ। ২১ মার্চ ভাষণ দিলেন। ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ভাষণ দিলেন। এটা ইম্পর্টেন্ট ভাষণ, এটা রেডিও পাকিস্তানে প্রচার করল।
ঐ ভাষণে তিনি বললেন, ‘উর্দু অ্যান্ড উর্দু শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাংগয়েজ অব পাকিস্তান’, দেয়ার নো অবজেকশন। ইউ অ্যান্ড ইয়োর লিডার উইল ডিসাইড ইট। দেয়ার আর নো অবজেকশন। ’ তার এই ভাষণের সময় সমাবর্তন হলে থাকা ছাত্ররা তার প্রতিবাদ করল। নো নো বলে চিৎকার দিল। ছাত্রদের আচরণে তিনি স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। তাড়াতাড়ি হল ত্যাগ করলেন। পরে অনেক দেন দরবার হয়েছে, বৈঠক হয়েছে, আলোচনা হয়েছে, কিন্তু বাংলার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
ফোর্টি এইটের বিজয় ১৫ মার্চ এর বিজয়। ১৫ মার্চ বিজয় দিবস। জিন্নাহর বক্তৃতার পর বাংলা ভাষার আন্দোলনটা স্তিমিত হয়ে যায়। ফোর্টি এইটের পরে ১১ মার্চ প্রতি বছর ভাষা দিবস পালিত হত। ১১ মার্চ পিকেটিং করেছি। আমি তখন হলে থাকতাম। জিপিওতে পিকেটিং করেছি। এর মধ্যে হলে গিয়ে ক্যামেরা আনলাম, কোডাক ক্যামেরা। আমার কাছে তখন একটা কোডাক ক্যামেরা ছিল। ঐ ক্যামেরাটা দিয়ে মিছিলের ছবি তুললাম। ৫টা ছবি তুললাম। এইটাই একমাত্র ৪৮ এর ভাষা আন্দোলনের মিছিলের ছবি।
১৫ থেকে ১৭ মার্চ এই ঘটনাগুলো ঘটল। এপ্রিলে কাকুলে যাওয়ার কথা। এরপর কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। বাবা, বড় ভাই এর সমর্থক ছিলেন। জিন্নাহ ১১ই সেপ্টেম্বর মারা যান। ফোর্টি নাইনে আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট বের হল। শহীদুল্লাহ কায়সার সহ ২৭ জনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্সপেল করা হয়। ২৭ জনকে শাস্তি দেয়া হল। ফোর্টি নাইনে ঐ আন্দোলন হয়।
আরেকটা আন্দোলন হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি বিয়ারার্স মুভমেন্ট। কর্মচারীদের পক্ষে ১৯৪৯ সালে। বিয়ারার্স মুভমেন্টের ফলে এক্সপেল করা হয় ২৭ জনকে। শেখ সাহেবও তাদের মধ্যে একজন। শেখ সাহেব অ্যারেস্টে হল, জেলে গেল।
আমাকে পার্টি বলল আত্মগোপন কর। ফোর্টি নাইনের পরে আমি ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি হলাম। এই যে মুভমেন্ট দিয়ে ফোর্টি নাইন, ফিফটিতে ওরকম হল। ফিফটি ওয়ানে মতিন এরা সমনে আসল। ফিফটি টুতে ২৯ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমুদ্দিন বলল, উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করল। জনসভা থেকেই ছাত্র-জনতা এর প্রতিবাদ করল। এর পরের কথা সবাই কম বেশি জানে।
এই সময় আমি আন্ডার গ্রাউন্ড। ফিফটি-ফিফটি ওয়ান এই সময়ে শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন করেছি। ছাত্রফ্রন্টের দায়িত্বে ছিলাম। ’৫২ সালে রণকৌশল পরিবর্তন করি। ’৫১ সালে যুবলীগ ফর্ম হইল অলি আহাদের নেতৃত্বে। ইস্ট পাকিস্তানের এই সব সংগঠন ও মুভমেন্ট ২১শের ভাষা আন্দোলনের মূল।
এই যে প্রোপাগান্ডা চালাইলাম ১৯৪৮, ’৪৯, ’৫০ সারা বাংলায়। এতে সারা বাংলাদেশে সবাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে চলে আসে।
নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হয়ে বেঈমানী করল। সে ৮ দফা চুক্তি করেছিল ১৯৪৮ সালে যার মধ্যে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার কথা ছিল। সে সেই চুক্তি ভঙ্গ করল। সেই চুক্তির সাথে বেঈমানী করে ২৯ জানুয়ারি ১৯৫২ পল্টনে বলল, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
এই বেঈমানীর প্রতিবাদ আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি অ্যাসেম্বলিতে যাওয়া হবে মিছিল করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ সময় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি করা হল একথা সবার জানা। এর মধ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি মুসলিম লীগ সরকার ১৪৪ ধারা জারি করল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল সহকারে যাওয়া হবে কিনা তা নিয়ে মত বিরোধ হল। ছাত্র নেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ কের মিছিল করার কথা বলল।
যারা পলিটিক্যাল পার্টির লিডার তারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বললেন।
তারা বললেন, সামনে ইলেকশন, এই সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা ঠিক হবে না, তাহলে এই অজুহাতে ইলেকশন নাও দিতে পারে। তখন কমিউনিস্ট পার্টি সিদ্ধান্ত নিল অবস্থা বুঝে আন্দোলন করব। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে আমরাও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করব।
এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি আমতলায় মিটিং হল। গাজীউল হক সভাপতিত্ব করল। মতিন, গাজীউল বলল আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙব। সিদ্ধান্ত হল একসাথে ১০ জন ১০ জন করে আবার এক সঙ্গে ৪ জন ৪ জন করে বের হবে। এভাবে ৪ জন ৪ জন করে অ্যাসেম্বলিতে যাবে। এই সময় আমি ছিলাম না। আমি অ্যারেস্টে হই ১৯৫১ সালে। ১৯৫১ সালের মে-জুন মাসে আমার ওপর হুলিয়া জারি হয়। অভিযোগ, হাজং এলাকায় আর্মস স্ট্রাগল হচ্ছে। ১৯৪৯ সালে সেখানে আর্মস দরকার। ঢাকা জেলা কমিটি থেকে গুলি সাপ্লাই দিছি।
১৯৪৯-৫০ সালে মনি সিং এর নামে ১০ হাজার টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়। আর আমার নামে ৫ হাজার টাকা ঘোষণা করা হল। কারণ আমি একজন ট্রেইনার। তখন আমাকে অ্যারেস্টে করে। এজন্য ৫২’র আন্দোলনের সময় আমি ছিলাম না।
’৫২ তে একটা ইম্পর্টেন্ট ঘটনা হইল। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা বিভাগের ডিন। ঐ সময় ডক্টর শহীদুল্লাহ উপস্থিত। ছাত্ররা সমাবেশ করছে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে। তখন শহীদুল্লাহ সাহেব, মোহাম্মদ সুলতান যুবলীগের সেক্রেটারি এরা দেখলেন, এখানে সব স্কুলের ছেলেরা। এই ছেলেদের এখান থেকে পাঠাও। শহীদুল্লাহ নিজে বাচ্চাদের বের করে দিচ্ছেন। ছাত্র নেতারা যখন কিশোরদের বের করে দিচ্ছে তখন এই সুযোগে বড়দের ২-৩টা ব্যাচ বের হয়ে গেছে। তারা মিছিল করতে পারে নাই। তাদের ধরে নিয়ে গেছে পুলিশে, তাদের ধরে নিয়ে টঙ্গীর রাস্তায় নিয়ে ছেড়ে দিছে।
ভাষা আন্দোলনের ঐদিন মিছিল বের হয় নাই। মেডিকলে কলেজ আর ইউনিভার্সিটির দেয়াল ৬ ফুট। শহীদুল্লাহ সাহেব বললেন, এই দেয়াল ভেঙ্গে ফেল। দেয়ার ভেঙ্গে বাচ্চাদের বের করতে। এবং ছাত্ররা জমা হল মেডিকেল কলেজ ব্যারাকে। তারা সেখানে মিছিল দেয়। পুলিশ তখন বাইরে থেকে গুলি করে। বরকত ২২ বা ২০ নম্বর ব্যারাকের বারান্দায় ছিল। গুলি খেয়ে ওখানে পড়ে যায়। মেডিকেল কলেজ ব্যারাকে। রাস্তায় একজন পড়ে যায়। সালাম বোধ হয়। মেডিকেল কলেজে ঐ মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একজনের ছবি তোলে আমানুল্লাহ। সেটা বোধ হয় রফিকের ছবি, মাথা থেতলানো।
ইউনিভার্সিটির মধ্যে টিয়ার গ্যাস মারলে শহীদুল্লাহ সাহেব তার মধ্যে পড়ে যান।
তখন তিন বলেন, ছাত্রদের, বাচ্চাদের বের করে দাও। টিয়ার গ্যাসে আহত গাজীউল হককে রাখা হল বারান্দায়। পুরনো ঢাকার লোকেরা আগে বাংলা ভাষার আন্দোলনকে সাপোর্ট দেয় নাই। ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি খাওয়ার পর ২২-২৩ ফেব্রুয়ারি সারা ঢাকায় মিছিল আর মিছিল। এরপরে পুরনো ঢাকার লোকেরা বাংলা ভাষার দাবির প্রতি সহানুভূতি দেখায়।
২২-২৩ ফেব্রুয়ারির মিছিলে নবাবপুরে গুলি হয়, ওখানে শফিকুর রহমান অহিউল্লাহ সহ ৩ জন মারা যায়। এই কয়জন নিয়ে ভাষা শহীদ ৭ জন। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলন ঢাকা থেকে গামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। ২১শে’র সময় সব রাজনৈতিক দল ভাষার প্রশ্নে এক হয়ে যায়। কেউ আর বিরোধী দল ছিল না। সব ঐক্যমত। সব এক হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন হয় নাই। এই ভাষা আন্দোলনের বিজয় স্বীকৃতি পেল নাইন্টিন ফিফটি সিক্সে। গণ-পরিষদে বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
তা ই মাসুম: ২১শে’র চেতনা কতখানি বাস্তবায়ন হয়েছে?
আ জা মু তকীয়ূল্লাহ: ২১শে’র চেতনা বাস্তবায়ন হয় নাই, কিন্তু এখনো সেই চেতনা আছে। আমরা কিছুটা দূরে সরে গেছি। ভাষা আন্দোলনের চেতনাতেই যুক্তফ্রন্ট হয়েছে। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা হয়েছে। ২১ দফার বাস্তবায়ন হল ভাষা আন্দোলনের মূল বাস্তবায়ন। মুক্তিযুদ্ধের পরে কিছুটা ছিল সেই চেতনা। যেমন কল কারখানা রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। জমিদারী প্রথা বাতিল করা হয়। সবার টাকার হিসাব দিতে হবে।
২১ দফার রূপায়ণ হলে স্বাধীনতার পরে আমাদের কাজ হয়ে যেত। কিন্তু তা হয় নাই। হ্যাঁ, বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে আমরা আস্তে আস্তে দূরে সরে গেছি। ভাষা আন্দোলনের মূল দাবির বাস্তবায়ন হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রূপায়ণ হবে। জনগণের মধ্যে চেতনা আনতে পারেন না। কারণ জনগণ নিরক্ষর, অশিক্ষত। জনগণ শিক্ষিত হলে তারা তাদের অধিকার জানতে পারত। জাতিকে শিক্ষিত করতে পারলে জনগণের হেল্প হবে অন্যথায় হবে না।
ডক্টর শহীদুল্লাহ বলেছেন নিরক্ষরতা দূর করতে না পারলে, ইলেকশনের নামে মানুষ না বুঝেই টিক মার্ক দিবে। যারা লেখা পড়া জানে না তারা কাজ করতে পারে না। ভোটার শিক্ষিত না হইলে দেশের উন্নতি হবে না। নিরক্ষরতা দূর করতে হবে।
চলবে…