নানাভাবে ইউরোপ যেতে চাওয়া বাংলাদেশিরা ভয়ংকর সব পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে প্রায়শই। মৃত্যু যেখানে ওঁত পেতে থাকে সেখান দিয়ে যেতে হচ্ছে স্বপ্ন পূরণের জন্য। অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার জন্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে বাংলাদেশিদের মৃত্যু এখন আর নতুন কোনো সংবাদ নয়। মানব পাচারকারীদের হাতে জিম্মি হয়ে এই ভয়ংকর যাত্রা ও যাত্রা পথে মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর গত পাঁচ বছর ধরে নিয়মিতই গণমাধ্যমে আসছে। এই মানব পাচারের এখন নতুন পথ হিসেবে আলোচনায় এসেছে মধ্য ইউরোপের দেশ বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ও স্লোভেনিয়া।
সাবেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র মধ্য ইউরোপের এই দুটি দেশের জঙ্গলে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে বাংলাদেশিসহ ছয় শতাধিক অভিবাসনপ্রত্যাশীর আটকা পড়ার খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স। মানব পাচারকারী চক্রগুলো অভিবাসন প্রত্যাশীদের বিভিন্নভাবে ক্রোয়েশিয়া হয়ে বসনিয়া বা স্লোভেনিয়ায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে অড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দিয়ে ইটালি, ফ্রান্স স্পেনসহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে পাঠাতে এসব মানুষকে বিপদসংকুল পথে নামিয়েছে পাচারকারীরা। এক বছর যাবত ইটালির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশিরা বসনিয়া ও স্লোভেনিয়া যাচ্ছে। বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়া বা স্লোভেনিয়া-ক্রোয়েশিয়া হয়ে উঠেছে ইউরোপে মানব পাচারের অন্যতম রুট বা পথ। গত এপ্রিল থেকে বসনিয়ায় অভিবাসীদের জন্য অন্তত সাতটি তাঁবু পরিচালনা করছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা। বসনিয়ার কর্তৃপক্ষ তাঁবুগুলো গুটিয়ে ফেলেছে। দুই সপ্তাহ ধরে ওই সব তাঁবুতে থাকা লোকজন ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী বসনিয়ার বন-জঙ্গল ও পরিত্যক্ত ভবনে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে সড়কের ধারে ঝুপড়ি বানিয়ে অবস্থান নিয়েছে।
রয়টার্সের প্রকাশিত বিভিন্ন ছবিতে দেখা গেছে, হাড়কাঁপানো শীতে লোকজন আগুন জ্বালিয়ে উষ্ণতা পাওয়ার চেষ্টা করছে। জঙ্গলের এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরি করছে, নামাজ পড়ছে, কেউবা পরিত্যাক্ত কারখানায় রান্না করছেন। আবার সীমান্তবর্তী সড়ক ধরে ক্রোয়েশিয়ার পথে যাত্রা করেছে সারি সারি লোক। প্রকাশিত ২৫টি ছবির সবগুলোতেই বাংলাদেশিদের দেখা গেছে। এক অভিবাসী প্রত্যাশী জানায়: তাদের থাকার কোনো ঘর নেই, পানি নেই, টয়লেট নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তাদের ৫০০ জনকে বিহাক ও ভেলিকা ক্লাদুসা শহরের তাঁবু থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এ কারণে তাঁদের জঙ্গলে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। স্লোভেনিয়ার বার্তা সংস্থা জানায়: দেশটির দক্ষিণ পশ্চিমের ইলিরস্কা বিস্ত্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে গত রোববার মোট ১৪৪ জনকে আটক করা হয়েছে। আটক অভিবাসীদের অধিকাংশই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নাগরিক। গত মঙ্গলবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয় ওরমজ এলাকায় পুলিশ একটি ভ্যান থেকে ২২ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে আটক করেছে। তাঁদের মধ্যে ১১ জন বাংলাদেশের নাগরিক। ক্রোয়েশিয়ার দক্ষিণ সীমান্তবর্তী ইলিরস্কা বিস্ত্রিকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গত রোববার ১১৩ জন অবৈধ অভিবাসীকে আটক করা হয়। এ বছরের প্রথম আট মাসে স্লোভেনিয়ায় অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপরাধে ১০ হাজার ২২৩ জন অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর এবং স্থলসীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছানো ব্যক্তিদের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকা করেছে। ওই তালিকার চতুর্থ স্থানে আছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের প্রথম আট মাসে বাংলাদেশের ৩ হাজার ৩২৫ জন নাগরিক ভূমধ্যসাগর আর স্থলপথে ইউরোপে পৌঁছেছে। এ ছাড়া ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মারা গেছে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। সর্বশেষ গত মে মাসে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইটালি যাওয়ার আগে মরুভূমিতে পাচারকারীদের গুলিতে প্রাণ হারান ২৬ বাংলাদেশি। এরপরও পাচারকারীদের প্রলোভন থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বিরত করা যাচ্ছে না। চক্রগুলো পাচারের জন্য খুলছে নতুন নতুন পথ।
আমরা সরকারের কাছে প্রত্যাশা করবো ইউরোপের দেশগুলোতে বৈধভাবে শ্রমিক রপ্তানির পথ খুলতে যেনো সরকার তৎপর হয়। নতুবা এই মৃত্যুর মিছিল কখনও বন্ধ হবে না। গ্রাম ও শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যুবকরাই মূলত উন্নত জীবন শুধু নয়, বেশি টাকা উপার্জনের উপায় হিসেবে ইউরোপ যাওয়াকে লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছে। তাদের এই অদম্য স্বপ্নকে থামাতে পারে সরকারি উদ্যোগ। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইউরোপে শ্রমশক্তির বাজার প্রসারিত করলে বৈধভাবে যেতে পারবে বাংলাদেশিরা। এভাবে অবৈধ পথে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসা একটি পরিবারের জন্য মর্মন্তুদ ঘটনা। জমিজমা ভিটেমাটি বিক্রি করে ইউরোপ যাওয়ার এই আত্মনাশী প্রচেষ্টা বন্ধ করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা আশা করি সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অচিরেই উদ্যোগ নেবে।