দিনগুলো হয়তো একভাবে কেটে যাচ্ছে। দিন তো কারো জন্য অপেক্ষায় থাকে না। কিন্তু বুকের মধ্যে প্রতিনিয়ত যে একান্ত কথাগুলো জমছে, সে সব কথা কারো সঙ্গে শেয়ার করা যাচ্ছে না। সব কথা তো আর সবার সঙ্গে শেয়ার করা যায়ও না। আর যায় না বলেই মানসিক একটা যাতনা নিয়ে দিনগুলো অতিবাহিত হচ্ছে।
অপ্রকাশের বেদনা কি যে ভয়াবহ, কি যে যন্ত্রণাকর, কি যে দুর্বিষহ, সেটা বুঝিয়ে বলা যায় না। আর আমার মতো নিভৃত স্বভাবের হলে তো কথাই নেই। এমন মনোভাব হলে কি যে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হয়, সেটা ভুক্তভোগী না হলে অনুধাবন করা যাবে না। আধুনিক জীবনের পরিভাষায় এটাকে এক ধরনের মানসিক রোগ বললেও অত্যুক্তি হবে না।
এমন স্বভাবের মানুষের বন্ধুত্বের গণ্ডি নির্দিষ্ট একটা সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে মনের সীমানা হারিয়ে ফেললে ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’-এর বাসিন্দা হয়ে যেতে হয়। যে কারণে আমি তো এখন মনের জগতে ঘুরছি অনেকটা অভিবাসীর মতো।
হে বন্ধু আমার, অন্তত তুই তো আমাকে ভালো করে জানতিস। আমার যা কিছু কথা, যা কিছু আনন্দ, যা কিছু বেদনা, সবটাই তো তোর সঙ্গে সেন্সর ছাড়াই শেয়ার করতাম। নিজেকে কতভাবেই না উজাড় করে দিতাম। কোনো রাখ-ঢাক না রেখেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দিনের পর দিন। কখনও সামনা-সামনি।
কখনও দূরালাপনীতে। আমার যে কথা কেউ জানে না, একমাত্র তুই জানতিস। একমাত্র তোকেই আমি নির্ভর করতে পারতাম। তোর সব কথাও তো কেবল আমি জানতাম। নাকি আর কেউ জানে? যদিও এই মুখচোরা আমি তোর কাছে যতটা অকপট, যতটা প্রাণখোলা, যতটা প্রগলভ ছিলাম, তুই কিন্তু ততটা ছিলি না। একটু বোধহয় র’য়ে-স’য়ে নিজেকে প্রকাশ করতি।
আমি জানতে চাইলে বলতি, না হলে নিজ থেকে খুব একটা উৎসাহী ছিলি না। আমি তোর কাছে যতটা বাচাল হয়ে যেতাম, যতটা খোলামেলা ছিলাম, যতটা বেপরোয়া ছিলাম, তুই কেন জানি নিজেকে একটু বেশি গুটিয়ে রাখতি।
সেটা তো হতেই পারে। দু’জনের মনোভাব যে হুবহু একই রকম হবে, এমনটা তো সাধারণত হয় না। দু’জনেই যদি কথা বলতে থাকি, তাহলে কে শুনবে কার কথা? মজার ব্যাপার হলো, যে আমি কথা বলতে গেলে প্রতিনিয়ত হোঁচট খাই, সেই আমি তোর কাছে হয়ে যেতাম হাল আমলের এফএম রেডিও’র ‘কথাবন্ধু’। অনর্গল বকে যেতাম। আমার কথা যেন শেষ হতে চাইতো না। তবে অনেক কিছু আমাদের অদ্ভুতভাবে মিলে যেত। পছন্দ-অপছন্দ তো বটেই। এমনকি কথার পিঠে কথাও।
মনে পড়ে, একবার বৃষ্টিভেজা বিকেলে রিক্সায় ঘুরতে ঘুরতে মুখে মুখে কবিতা রচনা করছিলাম। বিস্ময়করভাবে আমাদের কণ্ঠে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল অবিকল একই পংক্তি। চিন্তা-ভাবনায়, জীবন যাপনে আমরা তখন ‘বন্ধনহীন গ্রন্থি’ হয়েছিলাম, যে কারণে এমনটি হতে পেরেছিল। আমি তোকেই আমার অকৃত্রিম ও প্রকৃত বন্ধু মনে করতাম। যার কাছে নিজেকে মেলে ধরা যায়। সমর্পণ করা যায়। তুই হয়তো সেটা ততটা করতি না। তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আমি তোর বন্ধুত্বটুকুই চেয়েছিলাম। সেটা আমি মনে-প্রাণে বেশ উপভোগ করতাম। যে কারণে আমাদের বন্ধুত্ব নিবিড় হতে পেরেছিল। আর বন্ধুত্বের এই ভেলায় ভেসে ভেসে আমরা কত না পথ পাড়ি দিয়েছি।
এই আমি বলা যায়, জন্মের পর থেকেই এ শহরের আলো-হাওয়ায় বড় হয়েছি। কিন্তু ঘরকুনো স্বভাবের কারণে এ শহরের আগাপাছতলা আমার দেখা হয় নি। এ শহরে বরাবরই আমি অনেকটা নবাগত হয়ে ছিলাম। যদিও ইচ্ছের পাখি হয়ে শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা আমার ঘুরে ঘুরে দেখতে সাধ জাগতো। ওই পর্যন্তই। শেষ অব্দি কোথাও যাওয়া হতো না। কিন্তু তোর কারণে এ শহরটাকে কিছুটা হলেও চিনেছি। জেনেছি। রোদে-বৃষ্টিতে, আলো-আঁধারে কত জায়গায়ও না ঘুরেছি। কত অচেনা পথে ঘুরপাকে পড়েছি। কত জানা-অজানা জায়গায় আড্ডা মেরেছি। কত তিক্ত-মধুর অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষেই কত না পাগলামি করেছি। কোনো কিছুরই পরোয়া করি নি। হায়! উন্মাদনাময় সেই দিনগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বন্ধু, তোর কি মনে পড়ে না?
আমাদের কোনো পিছুটান ছিল না। উৎসবের দিনগুলো আমাদের কাছে অনেক বেশি রঙিন হয়ে আসতো। ঈদের দিনও দূরে দূরে কোথাও চলে গিয়েছি। আমাদের তো গন্তব্যের কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। পথে বেরিয়ে খুঁজে নিতাম আমাদের গন্তব্য। সেটা হতে পারে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব কিংবা পশ্চিম। কোথাও গেলেই হলো। আমাদের প্রিয় বাহন ছিল রিক্সা। কত দিন অকারণেই রোদে পুড়েছি। বৃষ্টিতে ভিজেছি। আমাদের চলাচল মূলত এই ঢাকা শহরেই সীমাবব্ধ ছিল। কখনও দূরে চলে গেলে মনে হতো, বিশ্ব জয় করে ফেলেছি।
সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়ে মনে হয়েছিল, কত দূরেই না চলে এসেছি। ক্রমশ প্রসারমাণ বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গিয়ে মনে হয়েছে, ভিন্ন কোনো জগতে চলে এসেছি। ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ সিনেমায় বাতাসে ঢেউয়ে ঢেউয়ে দোল খেতে থাকা বড় বড় সবুজ ঘাস আর কাশবন তো আমরা তো আগেই দেখেছি।
সাঁতার না জেনেও দুরন্ত সাহস নিয়ে মেঘলা দিনে বুড়িগঙ্গা নদীতে মনের আনন্দে নৌকায় ঘুরেছি। জোছনা রাতে নৌকাভ্রমণের মজাটাও কম ছিল না। যদিও মাঝিটা ছিল বিরক্তিকর। নাজিমউদ্দিন রোডের ‘নীরব’ হোটেলের রকমারি ভাজি-ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়ার স্বাদ মুখে লেগে আছে।
ছুটতে ছুটতে গিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘বোস কেবিন’-এ। এ দোকানের চা পান করে প্রশংসা করেছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। আমরা কি সেই চা পান না করে পারি? পাগলায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ব্রিটিশ আমলের ভাসমান রেস্তোরাঁ মেরি অ্যান্ডারসনে গিয়ে নিজেদের বেশ ভিআইপি অতিথি মনে হয়েছিল। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা স্পিড বোটে ঢেউয়ে ঢেউয়ে দোল খেয়েছি।
তোর তো লেখকদের প্রতি একটা সফট-কর্নার ছিল। পুরানো ঢাকার বাংলাবাজারে লেখক-সাহিত্যিকদের এক সময়ের জমজমাট আড্ডাখানা ‘বিউটি বোর্ডিং’-এ গিয়েছিলাম। দেশভাগের পর গড়ে ওঠা এই বোর্ডিং-এ এখনও পাওয়া যায় পুরানো দিনের ফ্লেভার। সেখানে গিয়ে খুঁজেছি লেখকদের সান্নিধ্যের স্মৃতি। বোর্ডিং-এর হোটেলে ঐতিহ্য অনুসারে স্টিলের বড় একটা থালায় পরিবেশন করা হয় ভাত-মাছ। ক্ষুধা পেটে তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিলাম। সিনেমা দেখতে গিয়ে পছন্দ না হওয়ায় মাঝখানে হল ছেড়ে চলেও এসেছি। আমরা তো গানের আসরেও যেতাম। তোর পরিচিত এক শিল্পীর ঘরোয়া গানের আসরে উপস্থিত ছিলাম। বেশ মজাই হয়েছিল।
একবার তো গাজীপুরের শালবনে গিয়ে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। কী দুশ্চিন্তায় না পড়ে গিয়েছিলাম। আরেকবার ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম। ঢাকা শহর ছাড়িয়ে একদম প্রত্যন্ত এলাকায়। স্থানীয় কিছু মাস্তান টাইপের ছেলে কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল। তোর চোখে অশ্রু দেখেছিলাম। আমিও খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বন্ধুদের আড্ডায় একদিন রাতের বেলা খুব অসুস্থ হয়ে তোকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিলাম। তুই যে কীভাবে সেই বেসামাল পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলি, সেটা ভাবলে তোর প্রতি আমার মাথা নুয়ে আসে। এটা আমি কখনই ভুলতে পারবো না।
আমাদের সাহস যখন অনেকখানি বেড়ে যায়, তখন গিয়েছিলাম মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ফেরি ঘাটে। পাড়ি দিয়েছিলাম একসময়ের উত্তাল পদ্মা নদী। দুপুরের খাওয়ার মেন্যু ছিল টাটকা ইলিশ মাছ। জমজমাট সেই ফেরি ঘাট হয়তো তো হারিয়ে যাবে। সেখানে গড়ে উঠছে দীর্ঘ পদ্মা সেতু। রয়ে যাবে আমাদের স্মৃতিটুকু। তুই বিদেশি লেখকদের বইয়ের অনুবাদ খুব পছন্দ করতিস।
সেই সুবাদে আমাকেও অনেক বই উপহার দিয়েছিস। তোর কারণেই বিদেশি সাহিত্যের কিঞ্চিৎ ছোঁয়া পেয়েছি। তুই কি এখনও আগের মতোই বই পড়িস? দুঃখজনক হলেও সত্য, বলতে গেলে বইয়ের জগতের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগই নেই। সারাদিনই তো কেটে যায় ‘শুধু দিন যাপনের, শুধু প্রাণ ধারনের গ্লানি’তে। বই আর পড়বো কখন? যদিও এটা কোনো অজুহাত হতে পারে না। তারপরও সত্যটুকু তোকেই জানাতে চাই। বৃষ্টি, জোছনা, জোনাকি, নদী, অরণ্যের প্রতি আমার মুগ্ধতার কথা তুই ভালো করেই জানিস।
অথচ এসবের সঙ্গে এখন কোনো যোগাযোগ নেই। ভাবতে পারিস তুই? গান এত তীব্রভাবে ভালোবাসি, সেই গানই তো এখন খুব একটা শোনা হয় না। জীবনের সব আনন্দই এখন বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। তুই তো হালের আমাকে চিনিস না। অথচ তোর সঙ্গে কত কত ঘটনা। কত কত কত স্মৃতি। মনের স্মরণিকায় সব ভিড় করছে। মনে হচ্ছে, বন্ধুত্বের এই দিনে সবটাই উজাড় করে দেই। এই পরিসরে সেটা তো আর সম্ভব নয়।
জন্মগতভাবেই আমি ভীষণ মুডি টাইপের। তবে তোর মুডের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যেতাম। তুই ছিলি অসম্ভব রকমের খামখেয়ালি। এ কারণে কত কত দিন কথা হয় নি। যোগাযোগ হয় নি। তুই কিন্তু কখনই এগিয়ে আসতি না। সব সময় আমাকে উদ্যোগী হতে হতো। যেন বন্ধুত্বের যাবতীয় দায়ভার আমার একার। সেই দায় নিতে আমার দিক দিয়ে কোনো খামতি ছিল না। কিন্তু সব সময় তো একইভাবে মানিয়ে নেওয়া যায় না। মন-মেজাজও একই থাকে না। আমারও তো মান-অভিমান থাকতে পারে। দুঃখ-কষ্ট থাকতে পারে। তাই না? সেটা তুই মানতে চাইতি না।
তোর দিক থেকে কখনই নমনীয়তা ছিল না। যে কারণে একটা দূরত্ব গড়ে ওঠে। একটু একটু করে সেটা যে এত বড় হয়ে যাবে, এটা আমি কোনো দিন ভাবতেও পারি নি। দেখতে দেখতে কত কত বছর পেরিয়ে গেছে। ভাবলেই একবুক দীর্ঘশ্বাস হাহাকার ছড়ায়। আমি জানি না, তুই আমাকে মনে রেখেছিস কিনা? মনে তো হয় না। আমি কিন্তু তোকে ভুলি নি। তোর সঙ্গে যে বন্ধুত্ব, যে আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে, সেটাকেই জীবনের মূল্যবান সম্পদ হিসেবে হৃদয়ের খাজাঞ্চিখানায় সযতনে জমা রেখে দিয়েছি। সেখানে আর কাউকে হাত দিতে দেই নি। তুই কি এখনও আগের মতো আছিস?
তোর নিশ্চয়ই এখন অনেক বন্ধু। নতুন বন্ধুরা কি তোর মুডের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে? খুব জানতে ইচ্ছে করে। তোকে চুপি চুপি বলে রাখি, আমি কিন্তু আর কারও বন্ধু হতে পারি নি। চারপাশে ‘কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি’। কিন্তু বন্ধু খুঁজে পাই না। চাইলেই কি আর বন্ধু পাওয়া যায়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)