রেডক্লিফের টেনে দেওয়া খামখেয়ালী রেখার দুপাড়ের দুটো দেশ। সাংস্কৃতিক মিলটা চোখে পড়ার মত। বাংলাদেশের সঙ্গে ভাষাগত মিলও আছে ভারতের বড় একটি জনগোষ্ঠীর। সাদা চোখে দুদেশের সম্পর্কটা তাই প্রতিবেশীর। কিন্তু পাশের বাড়ির প্রতিবেশী পরিবারটির সঙ্গে ওই বাড়ির পরিবারটির যে আন্তরিকতা, অন্তত একটি জায়গায় সেটির ছিটেফোঁটাও যেনো নেই! সেটি ক্রিকেটীয় আদান প্রদানে। তাইতো ভারতের বিপক্ষে টেস্ট খেলে ক্রিকেটের যে অভিজাত সংস্করণের ইতিহাসে পথ চলা শুরু টাইগারদের, প্রথমবারের মত সেই দেশটিতে সাদা পোশাকে খেলতে অপেক্ষা করতে হলো প্রায় দেড় যুগ।
দেরিতে হলেও হচ্ছে। ভারতে টেস্ট খেলতে ডাক পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যেটি হতে পারতো ঐতিহাসিক সফর। কিন্তু দীর্ঘ সময় আমন্ত্রণ না জানানোর বঞ্চনার কারণেই হোক বা মনোযোগটা অন্যদিকে না সরাতে, এটিকে ঐতিহাসিক সফর মানতে নারাজ টাইগারদের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। সেটি দেশ ছাড়ার আগেই স্পষ্ট জানিয়ে গেছেন তিনি।
বিরাট কোহলি অবশ্য পুরো উল্টো পথে হাঁটলেন। মুশফিকদের এই সফরকে কেবল দুদলের জন্যই নয়, দুদেশের জন্যই ‘ঐতিহাসিক’ বললেন ভারতীয় অধিনায়ক। ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন বাংলাদেশকে দীর্ঘ সময় সফরের আমন্ত্রণ না জানানোর তথ্য শুনেও। তাতে অতিথি সমাদর মন্দ হলো না বলা যায়। অবশ্য সেটা বহাল থাকবে দুই অধিনায়কের টস করতে না নাম পর্যন্তই।
হায়দরাবাদের রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার টসের মুদ্রা ছোঁড়ার পর থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার দামামা বেজে উঠবে। যাতে ছেড়ে কথা বলবে না কোহলির দল। ঘরের মাঠে কয়েক সপ্তাহ আগেই ইংল্যান্ডকে উড়িয়ে দেওয়া দলটি ধরে রাখতে চাইবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটতে থাকার ছন্দ। টানা ১৮ টেস্ট হারের স্বাদ পায়নি দলটি।
সেখানেই আসল চ্যালেঞ্জ মুশফিকদের। সাম্প্রতিক সময়ে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে উত্তেজনাপূর্ণ দুটি টেস্ট খেলেছে টাইগাররা। যার একটিতে দাপুটে জয়ে মাঠ ছেড়েছিল। পরে নিউজিল্যান্ড সফরের দুই টেস্টে আত্মসমর্পণ! যাতে ঢাল হতে পারতো বিরুদ্ধ কন্ডিশন ও বাউন্সি পিচ। কিন্তু স্মরণকালের সবচেয়ে পেস-ভীতিহীন নিউজিল্যান্ডের পিচে আমন্ত্রণ পেয়েছিল বাংলাদেশ। সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেনি। এবার উপমহাদেশীয় স্পিন পরীক্ষা।
সুযোগ হাতছাড়ার আক্ষেপের প্রসঙ্গ আসলে শুরেতেই চোখে ভাসে সামর্থ্যটা পারফরম্যান্সে রূপান্তর করতে না পারার বিষয়টি। উইকেট ছুঁড়ে আসা, ক্যাচ ফসকে যাওয়া, প্রতিপক্ষের দুর্বল জায়গা না বুঝে বল করা, ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী পারফর্ম করতে না পারার বিষয়গুলো। কি নেই সেই রূপান্তর করতে না পারার তালিকায়।
সমস্যার শুরুটা গোড়া থেকেই। তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান হয়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ; কেউ দায়িত্ব নিয়ে খেলতে পারছেন না, কেউ দারুণ একটা ইনিংস খেলতে খেলতে আবার বাজে শটে আত্মাহুতি দিয়ে আসছেন। দলের তরুণ সদস্যরাও সেই প্রবণতার বাইরে নন। অথচ এমন নয় তাদের সামর্থ্য নেই। সেটাকে দল হিসেবে মাঠে টেনে নেওয়াতেই যত ঘাটতি। বেশিরভাগ সময়ই তাই দিনের সমাপ্তি আসে হতাশায়। মুশফিকের কথাতেও সেটারই ইঙ্গিত। তাইতো দল হিসেবে খেলার বার্তা দিলেন সতীর্থদের।
ম্যাচের আগেরদিন দুপুরে হায়দরাবাদের উইকেট দেখে সন্তুষ্ট টাইগার অধিনায়ক। প্রচলিত ভারতীয় উইকেটই অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন তিনি। শুরুতে মন্থর হবে। পেসাররাও শুরুতে সাহায্য পাবে। স্পিনারদের জন্যও বাউন্স থাকবে। ম্যাচের বয়স বাড়ার সঙ্গে ধীরে ধীরে স্পিন ধরবে।
অবশ্য ম্যাচে হতাশার মাঝেও আশার কথা টাইগারদের ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ঝলকের দেখা মিলছে নিয়মিতই! উন্নতির ছাপটাও তাই স্পষ্ট। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন সাকিব। তার সঙ্গে তিনশ পেরোনো জুটি গড়া মুশফিক সেঞ্চুরি করেছেন। নিজেকে হারিয়ে খোঁজা সৌম্য সরকার রানে ফিরেছেন। রানে আছেন মুমিনুল হক, সাব্বির রহমানও।
বোলিংয়ে আনকোরা কামরুল ইসলাম রাব্বি, তাসকিন আহমেদ বা শুভাশিস রায়রা সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। স্পিনের সাকিবের সঙ্গে জুটি বাঁধবেন ইংলিশ বধের নায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ। কিউই সফরটা ভালো না গেলেও উপমহাদেশের পিচে অভিষেক সিরিজের ঝলক ফিরে আনার চেষ্টার কথা বলেছেন তিনি। ভারতের পিচে তিন স্পিনার নিয়ে না নামার কোনো কারণ নেই। সুযোগের অপেক্ষায় থাকা তাইজুল ইসলাম প্রস্তুতি ম্যাচে নিজেকে ঝালিয়ে নিয়েছেন প্রস্তুতি ম্যাচে তিন উইকেট দখল করে। আক্ষেপের উল্টো পিঠে এসবই আশা যোগাচ্ছে ভারতের মাটিতে ভালো কিছু করার স্বপ্নকে।
প্রতিপক্ষের শক্তির কথা চিন্তা করলে এই ম্যাচে ভীতির বিষয়ও থাকছে। পরিসংখ্যান বলছে এই মাঠে হওয়া তিন টেস্টে মোট ৮৭টি উইকেট তুলে নিয়েছেন বোলাররা। যার মধ্যে স্পিনারদের ঝুলিতে গেছে ৫৮টি, ২৬টি পেসারদের। যার ২ টেস্টে সর্বোচ্চ ১৮ উইকেট নেওয়া অশ্বিন থাকছেন স্পিন আক্রমণের নেতৃত্বে। সঙ্গী জাদেজা-যাদবরাও স্পিন বিষ ছড়াতে প্রস্তুত। উইকেট ছুঁড়ে আসার অভ্যাসটা জারি রাখলে পান্ডিয়া-ইশান্তরাও সহজ সাফল্যের দেখা পেয়ে যেতে পারেন।
অন্যদিকে বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান কোহলি থাকবেন ব্যাটিং আক্রমণের নেতৃত্বে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ট্রিপল সেঞ্চুরি করে চমকে দেওয়া করুন নায়ার থাকছেন। পূজারা, লোকেশ, রাহানেরা তো নিজেদের দিনে যেকোনো প্রতিপক্ষের জন্যই ভয়ঙ্কর।
সব মিলিয়ে কঠিন এক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে মুশফিকদের জন্য। যেটি উতরে যাওয়ার সূত্রও আছে নিজেদের হাতেই। যা ধরা দেবে সামর্থ্যটা মাঠের পারফরম্যান্সে অনূদিত করতে পারার মধ্যদিয়ে। যেজন্য উদ্দীপ্ত হতে প্রায় দেড় যুগ ডাক না পাওয়ার বঞ্চনার পিঠে গড়ে ওঠা আবেগকেই ভালো খেলার সঞ্জীবনী ভাবতে পারেন টাইগাররা। তাতে ভারতের বিপক্ষে সাদা পোশাকে ৮টি ম্যাচ খেলে ৬টি হার, চারটি ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়ের পিঠে দুটিতে ১০ ও ৯ উইকেটে হারের বেদনার স্মৃতি মুছে ফেলার শুরুটা হতে পারে হায়দরাবাদেই।
কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও সেই আবেগের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ক্রিকেটের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও ক্রিকেটারদের আবেগের মিশ্রণে ভালো কিছু করার প্রত্যয় গড়ে তোলার বার্তা দিয়েছেন শিষ্যদের। আবেগের সঠিক ব্যবহার শেখার জন্য অবশ্য বেশি বেশি খেলার কথাটিও মনে করিয়ে দিয়েছেন হাথুরু। সেখানেই আবার বড় করে প্রশ্নটি উঠে যায়- কবে বেশি বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। হয়তো হায়দরাবাদে দারুণ কিছু করে সেই দাবিতেও উচ্চকণ্ঠ বার্তা দেবেন মুশফিকরা।