সময়ের ফ্রেমে বন্দী হয়ে বিদায় নিতে যাচ্ছে ইংরেজি বছর ২০১৯, আসছে নতুন বছর। বছর জুড়ে আমাদের যাপিত জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে ছিল দেশ-বিদেশের বহুমাত্রিক সংবাদ। সেসব সংবাদের ভিড়ে আমাদের উচ্চ আদালতের একগুচ্ছ সংবাদ বছরের বিভিন্ন সময় মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে। বিদায়ী বছরের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে ফিরে দেখা সেইসব সংবাদ।
সাংসদদের শপথের বৈধতা নিয়ে করা রিট খারিজ
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে জয়ী সাংসদদের শপথ অবৈধ দাবি করে ২৯০ জনের সাংসদ পদে থাকার বৈধতা নিয়ে এবছরের ১৪ জানুয়ারি হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাহেরুল ইসলাম তৌহিদের করা এই রিট নিয়ে সে সময় ব্যাপক কৌতুহল তৈরি হয়। পরবর্তীতে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রিটটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেন। এরপর একই রিট বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ রিট সরাসরি খারিজ করেন। এরপর হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে বলে জানান রিটকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন।
বন্দীদশা থেকে জাহালমের মুক্তি
দুর্নীতি দমন কমিশনের করা ২৬ মামলায় ‘ভুল আসামি’ হয়ে প্রায় ৩ বছর কারাগারে থাকার পর হাইকোর্টের আদেশে এবছরের ৩ ফেব্রুয়ারি কারামুক্ত হন পাটকল শ্রমিক জাহালম। জাহালমের বন্ধীদশা নিয়ে পত্রিকার প্রকাশিত প্রতিবেদনটি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত হাইকোর্টের নজরে আনার পর বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ দেন। এর কয়েক ঘন্টা পরই কারাগার থেকে মুক্তি পান হতভাগা যুবক জাহালম। তবে জাহালমের জীবনের ৩টি বছর নষ্টের জন্য তাকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া সংক্রান্ত রুল শুনানি এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।
ভেজাল খাদ্যপণ্য নিয়ে সাড়াজাগানো আদেশ
প্রতিবছর রমজানে আগে ঘটা করে খাদ্যে ভেজালের নিয়ে হইচই শুরু হয়। সময় গড়ালে আবার এবিষয়ে সুনসান নীরবতা নামে। তবে মেয়দ উত্তীর্ণ ওষুধ, দুধ, দই এবং গোখাদ্যে ভেজালের বিষয়সহ এবছর ভেজালের একাধিক বিষয় হাইকোর্টে আসে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে দেশের নামীদামী কম্পানির তেল-ঘি-লবন ও মশলাসহ ৫২টি খাদ্যপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। যতক্ষণ পর্যন্ত এসব পণ্য বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় পুনরায় উত্তীর্ণ না হবে ততক্ষণ এগুলোর উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কনসাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি (সিসিএস) এর করা এক রিটের পর গত ১২ মে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদালত মাদকবিরোধী অভিযানের মতো খাদ্যে ভেজাল মেশানোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বরখাস্ত ডিআইজি মিজানকে পুলিশে দেন হাইকোর্ট
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় আগাম জামিন নিতে এলে পুলিশের সাময়িক বরখাস্তকৃত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানকে পুলিশে দেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১ জুলাই মিজানুর রহমানের জামিন নাকচ করে তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়। এবং গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে মহানগর বিশেষ জজ আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আদেশের সময় হাইকোর্ট বলেন, ‘মিজানুর রহমান অত্যন্ত (ডেসপারেট) বেপরোয়া একজন পুলিশ অফিসার। সে (মিজান) পুলিশের ভাবমূর্তি পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। ওইদিন হাইকোর্টের আদেশের পর রাতে মিজানকে শাহবাগ থানায় রেখে পরিদন সকালে তাকে ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ ইমরুল কায়েশের আদালতে হাজির করা হয়। এরপর আদালত মিজানুর রহমানের জামিন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠান। সেই থেকে মিজান করাগারে আছেন।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের দণ্ডে অন্তরীণ শিশুদের মুক্তি
ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেয়া দণ্ডে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে অন্তরীণ শিশুদের মুক্তির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এই আদেশের পরই টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা ১২১টি শিশুর সবাই মুক্তি পায়।
‘আইনে মানা, তবু ১২১ শিশুর দণ্ড’ শিরোনামে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে নিয়ে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গত ৩১ অক্টোবর রুলসহ আদেশ দেন।
প্রথা ভাঙা ভালবাসার জয়
এক হৃদয় নিংড়ানো প্রেমের প্রেক্ষাপটে ব্রাহ্মণ বাবা-মায়ের ঘর ছেড়ে হরিজন বর্ণের ছেলে তুষারকে ভালবেসে বিয়ে করে শরীয়তপুরের মেয়ে সুম্মিতা। কিন্তু এমন প্রথা ভাঙা ভালবাসার অপরাধে সুম্মিতার মায়ের করা মামলায় প্রেমিক তুষারকে যেতে হয় কারাগারে। অন্যদিকে স্বামীকে কারামুক্ত করতে তিন মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে হাইকোর্টে ঘুরতে থাকে সুম্মিতা। অবশেষে গত ১ আগস্ট বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের জামিন আদেশের পর কারামুক্ত হন তুষার। জয়ী হয় সুস্মিতার প্রেম।
জীবন্ত সত্তার মর্যাদা পায় নদী
দেশের নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা এবং লিগ্যাল পারসন ঘোষণা করে এবছর এক ঐতিহাসিক রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ। তুরাগ নদ রক্ষায় মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের করা রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ রায় দেয়া হয়। হাইকোর্ট তার রায়ে বলেন: ‘দূষণ ও দখলের নামে নদীকে হত্যা করা আমাদের সকলের সম্মিলিত আত্মহত্যার নামান্তর। নদীকে হত্যা করার অর্থ হলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হত্যা করা। আর নদী দূষণ ও দখলকারীরা দেশের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু, মানবতার শত্রু এবং সভ্যতাকে হত্যাকারী।’
আদালতে জাতির জনকের প্রতিকৃতি
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রামের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি এবছর টাঙানো হয়েছে দেশের সব আদালতে।
সুপ্রিম কোর্টের তরুণ আইনজীবী সুবীর নন্দী দাসের এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ দেশের সব আদালত কক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি প্রদর্শন ও সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। এরপরই দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে শুরু করে হাইকোর্ট ও দেশের সব আদালতে জাতির জনকের প্রতিকৃতি টাঙানো হয়।
অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে তিন বিচারপতির ছুটি
এবছরের মাঝামাঝিতে হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে বিচারকার্য থেকে তাদের বিরত রাখার পর ছুটিতে যান তারা। এই তিন বিচারপতি হলেন: বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক। এবিষয়ে গত ২২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির সাথে পরামর্শক্রমে তাদের বিচারকার্য থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করা হয় এবং পরে তারা ছুটির প্রার্থনা করেন। পরবর্তীতে এই তিন বিচারপতির ছুটি মঞ্জুর হয়। তবে কত দিনের জন্য এদের ছুটি, তা পরে আর বলতে পারেননি সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র।
পা হারানো রাসেল পেল ১০ লাখ টাকা
গ্রিনলাইন পরিবহনের বাসের চাপায় পা হারানো রাসেল সরকারের ক্ষতিপূরণের ৫০ লাখ টাকার মধ্যে ১০ লাখ টাকা এবছর পরিশোধ করা হয়। তবে ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে জারি করা রুল হাইকোর্টে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আট কিস্তিতে বাকি ৪০ লাখ টাকা দেয়ার বিষয়টি স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ। রাসেলের পা হারানের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য উম্মে কুলসুম স্মৃতি। এরপর হাইকোর্ট ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে রুল জারি করেন এবং পরবর্তীতে রাসেল সরকারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেন আদালত।
গ্রামীণফোনের প্রতি সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ
তিন মাসের মধ্যে বিটিআরসিকে ২ হাজার কোটি টাকা দিতে গ্রামীণফোনের প্রতি নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। গত ২৪ নভেম্বরের ওই আদেশে আরো বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে এ টাকা না দিলে গ্রামীণফোনের কাছে বিটিআরসির নিরীক্ষা দাবির ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকার পাওনা আদায়ের ওপর হাইকোর্টের দেয়া নিষেধাজ্ঞার আদেশটি বাতিল হয়ে যাবে।
পাখির বাসায় হানা দিতে হাইকোর্টের মানা
বছর জুড়ে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার নানা বিষয় হাইকোর্টে আসে। এবছরের অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রজ্ঞা পারুমিতা রায় পাখির বাসা ভেঙে ফেলা নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন। যেখানে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের একটি আমবাগানে কয়েক হাজার পাখির বাসা বাগান মালিক ভাঙতে চান বলে পত্রিকার প্রতিবেদন পড়ে আদালতকে জানান হয়। এরপর হাইকোর্ট ওই আম বাগানের পাখির বাসায় হানা দিতে মানা করে ওই আমবাগান এলাকাকে কেন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। সেই সাথে ওই আমবাগান এলাকাকে পাখিদের অভয়ারণ্য ঘোষণা করলে বাগান মালিক বা ইজারাদারের কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে তা নিরুপন করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন আদালত।
জামায়াত নেতা আজহারুলের মৃত্যুদণ্ড বহাল
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
মৃত্যুদণ্ডের রায়ে বিরুদ্ধে আজহারুলের করা আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ৩১ অক্টোবর এই রায় দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।
আদালতে ‘নজিরবিহীন’ হট্টগোলের পর খালেদার জামিন নামঞ্জুর
বছরের শেষে এসে গত ১২ ডিসেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালত জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার জামিন নামঞ্জুরের আদেশ দেন। এর আগে গত ৫ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই জামিন শুনানির তারিখ নির্ধারণকে কেন্দ্র করে ২১০ মিনিটের ‘নজিরবিহীন’ হট্টগোল হয়। বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের চিৎকার ও শ্লোগানের একপর্যায়ে এজলাস ছেড়ে চলে যান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ। আদালত কক্ষের ওই হট্টগোলের প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতির ওই আদালত কক্ষে পরবর্তীতে ৮টি সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা বসানো হয়।
এই মামলায় এর আগে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। তার আগে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান খালেদা জিয়াকে এ মামলায় ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন।