৫৫ বছরের এক ঘটনাবহুল সংগ্রামী জীবন,বাঙ্গালিদের দিয়েছেন হাজার বছরের সেরা অর্জন। স্বাধীন দেশ, আত্মপরিচয়, নিজস্ব পতাকা, ভাষা সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা আরো কত কি ! কৃতজ্ঞ বাঙ্গালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বসিয়েছে পিতার আসনে, দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালির সম্মান। নিপীড়িত, শোষিত দেশবাসীর জন্য আমৃত্যু দিয়ে গেছেন সাধ্যের চেয়ে বেশী কিছু।
মৃত্যুর ৪০ বছর পরও বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালিদের শুধু দিয়েই যাচ্ছেন, সংগ্রামী মানুষকে জীবন সংগ্রামে জেতার অনুপ্রেরণা, ধূর্ত মতলবাজদের তার নাম ব্যবহার করে ব্যর্থতার অভিযোগ থেকে বাঁচার বাহানা। ২০১৬’র বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট তারই সর্বশেষ উদাহরণ।
টানা তৃতীয়বারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশীপে বাংলাদেশ ফুটবল দলের শোচনীয় বিপর্যয়ের পর দেশবাসীর অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বাফুফে’র কর্মকর্তাদের একটা মহীরুহের ছায়াতল প্রয়োজন ছিলো। সেই ছায়াতল বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের এবারের আসর।
কাজী সালাউদ্দিনের সভাপতিত্বের আট বছরের জমানায় বাফুফে বাংলাদেশ দলের ফুটবল মানের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে না পারলেও নানা চমক, ঠমক ও চতুরতা নিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে বেশ পরাঙ্গমতা দেখিয়ে যাচ্ছে। ব্যর্থতার অভিযোগে কোচ-ম্যানেজার বরখাস্ত করে সমালোচনার হাত থেকে যে বাঁচা যাবেনা এটা বুঝতে পেরেই এবার তাড়াহুড়ো করে মাঠে নামানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ । উদ্দেশ্য এক ঢিলে কয়েক পাখি শিকার। এবারের আসরের ৬টি বিদেশী দলের শক্তিমত্তার দিকে তাকালেই পরিস্কার হবে সব।
২০০৯ সালে বাফুুফে’র সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই কাজী সালাউদ্দিন শুনিয়ে আসছেন এশিয়ার সেরা দলের অংশগ্রহনে জাতীয় দলের অংশগ্রহনে এশিয়ার অন্যতম সেরা টুর্নামেন্ট হবে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির জনকের জন্য এরকম একটি টুর্নামেন্ট আয়োজনের স্বপ্ন ফুটবল পাগল বাঙ্গালির দীর্ঘদিনের।
সালাউদ্দিন সেই আবেগ’কে পুঁজি করলেও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন, জাতির জনকের জন্য অসম্মানকর। সাফ-বিপর্যয়ের পরই তড়িঘড়ি বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ আয়োজনের ঘোষণা দিয়ে বাফুফে বলেছিলো, শক্তিশালি জাতীয় দল কিংবা অলিম্পিক (অনূর্ধ্ব-২৩) দল আসছে টুর্নামেন্টে । খেলা মাঠে গড়াতেই পরিস্কার, জাতীয় দল তো দূরের কথা, পুরোশক্তির অনূর্ধ্ব-২৩ দলও পাঠায়ানি কেউ।
শ্রীলংকা দলে অনুর্ধ্ব-২৩’র আট খেলোয়াড়, মালদ্বীপে পাঁচ, মালয়েশিয়া পাঠিয়েছে তাদের লিগের পঞ্চম স্থানের ক্লাব দল ফিল্ডা ইউনাইটেড’কে, তাও পুরোশক্তির নয়, বিদেশী ফুটবলার বাদ দিয়ে নবীন ও তরুণদের নিয়ে গড়া কমশক্তির দল। অনূর্ধ্ব-২৩ জাতীয় দল পাঠায়নি বাহরাইনও। তাদের কোচ জানিয়েছেন, তারুণ্য-নির্ভর দলটি স্রেফ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যই এসেছে ।
তবে মজা আছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দল নিয়ে। অধিনায়ক রেজাউল,শিফাত,জিয়াউর ও অরুপ বৈদ্য সহ বেশ কয়েকজন ফুটবলার আছেন যারা জাতীয় দলের । আমন্ত্রিত দলের শক্তিমত্তার বিপরীতে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দলগঠনের চিত্রেই পরিস্কার পুরো দেশকে ধোঁকা দিতে বঙ্গবন্ধু’র নামে একটা টুর্নামেন্ট মাঠে গড়িয়েছে উদ্দেশ্য যে ভাবেই হোক বাংলাদেশের একটি দলকে ফাইনালে তোলা এমনকি চ্যাম্পিয়ন করা। তারপর কমজোরি দলগুলোর বিপক্ষে লাল-সবুজের সাফল্য’কে কথার ছলচাতুরিতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে সাফের টানা ব্যর্থতাকে আড়াল করা।
বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে সাফল্য মানেই বিজয়ী ফুটবলারদের সঙ্গে বাফুফে কর্তাদের জন্য গণভবনে ক্রীড়া অনুরাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবর্ধনা, পুরস্কার ঘোষণা এমনকি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও গ্রুপ ছবি তোলার বিরল সুযোগ। এতকিছু প্রাপ্তি হলে আবারো কথার তুবড়ি ছুটিয়ে ক্ষমতার আসন পাকাপোক্ত হয়। একটি সাধারণ মানের টুর্নামেন্ট আয়োজন করে তার সঙ্গে জাতির জনকের নাম জড়িয়ে তার প্রতি সম্মান দেখানো নাকি তাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে সেই বোধটুকুও হারিয়ে বসেছেন বাফুফে’র কর্তারা । পাশের দেশ ভারত তাদের মহান নেতা জওহরলাল নেহেরু’র নামে ১৯৮২ থেকে আয়োজন করতো নেহেরু কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা, সোভিয়েট ইউনিয়ন, ক্যামেরুন, নর্থ কোরিয়া, রুমানিয়া ‘বি’, হাঙ্গেরি একাদশ কিংবা ইরাকের মতো শক্তিশালি দল অংশ নিয়েছে সেই টুর্নামেন্টে ।
একই মাপের দলের অংশগ্রহন নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা বলেই ২০১২’র পর থেকে বন্ধ রয়েছে নেহেরু কাপ। ভারতীয়রা তাদের সেরা সন্তানের নামকে অমর্যাদা করতে চায়নি বলেই এই সিদ্বান্ত। আর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু’র পবিত্র নামকে নিয়ে চলছে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের নোংরা খেলা। ২০১৫’তে এমনই একটি সাদামাটা আসর আয়োজন করে বাফুফে খরচ করেছিলো ৬ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু’র নামে টুর্নামেন্ট বলেই সেবার স্পন্সর পেতে অসুবিধা হয়নি। এবার স্পন্সরদের লম্বা তালিকা বলে দিচ্ছে খরচ এবং স্পন্সরদের থেকে অর্জন অতিক্রম করবে গতবারের রেকর্ড। তবে এমন একটি বয়সভিত্তিক অপেশাদার দলের টুর্নামেন্টে কোন খাতে কিভাবে, কত খরচ হচ্ছে তার বিস্তারিত জানাতে আগ্রহী নয় বাফুফে। বাংলাদেশের ফুটবল অর্থের অভাবে ধুঁকছে এমন কথা বলা যাবেনা গত সাত/আট বছরে স্পন্সরদের স্বতস্ফুর্ত প্রনোদনায়।
প্রস্তাবিত ফুটবল একাডেমি হচ্ছে বাফুফে’র আরেক প্রিয় কুমির ছানা। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব স্থাপনা সিলেট বিকেএসপি’কে নিয়ে ফুটবল একাডেমি গড়ার কথা শোনানো হচ্ছে পাঁচ-ছয় বছর ধরে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে বাফুফে’র ফুটবল একাডেমি’র জন্য ৪ লাখ মার্কিন ডলার মঞ্জুরি দিয়েছিলেন সেসময়ের ফিফা সভাপতি সেফ ব্ল্যাটার। শেষ হয়েছে ‘ব্ল্যাটার-যুগ’। কিন্তু এখনো কোমর তুলে দাঁড়াতে পারেনি বাফুফে’র ফুটবল একাডেমি। শিক্ষার্থী হবেন কারা, অনূর্ধ্ব-১৬ নাকি অনুর্ধ্ব-১৮’র ফুটবলার, কিভাবে বাছাই হবে তাদের,এমন সুনির্দিস্ট পরিকল্পনা আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি চার দশক আগে আধুনিক পেশাদারী ফুটবল সিস্টেমের সাথে পরিচিত হওয়া কাজী সালাউদ্দিন ও তার সঙ্গীরা।
কিছুদিন আগে শুনিয়েছেন বেসরকারি এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে দেবেন একাডেমি পরিচালনার দায়িত্ব। তারা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে একাডেমি চালাবেন। ফুটবলার তৈরী’র পাশপাশি তাদের বিভিন্ন ক্লাবে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করবে, যার একাংশ পাবে বাফুফে। সিলেট বিকেএসপি’র মতো ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন সরকারি স্থাপনা ব্যবহার করে বাফুফে বা বেসরকারি ঐ প্রতিষ্ঠান কোন আইনে মুনাফা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করবে তার ব্যাখা অবশ্য মেলেনি। এমন অবাস্তব বক্তব্য আর কথার তুবড়ি ছুটিয়েই চলছে এদেশের ফুটবলের তথাকথিত উন্নয়ন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)