চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু এভিনিউর রক্তিম শেষ বিকেল

২২ আগস্ট ২০০৪, ভোর ৭টা ৩০ মিনিট। এক যুগেরও বেশি হয়ে গেল! তবু ভুলতে পারিনি দুঃসহ এক সকালের স্মৃতি। তখন আমার বয়স কত? ১৫ এর শেষ বেলা। হলিক্রস কলেজে পড়ি তখন। এদেশে তখনও আসেনি নীল খামের ফেসবুক। দেশের খবর বলতে সেই বিটিভির খবর আর সকালের পত্রিকা। তাও আবার ১২ ঘণ্টার বাশি খবর। তখনও অনলাইন সংবাদের চল আসেনি ।

২২ আগস্টের সেই দিনটি ছিল রোববার। ভুলোমনা আমার দিনক্ষণ মনে থাকার একটি বিশেষ কারণ ছিল-মিশনারি কলেজ রবিবার বন্ধ থাকে। তাই আমার কলেজও বন্ধ ছিল সেদিন।

২১ আগস্ট রাতে খুব অস্থির লাগছিল। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেষ বিকেলের রক্তিম বিদায়ের কথা আমার জানা ছিল না। মাকে দেখতে মনটা ছটফট করছিল। আমি তখন থাকি মনিপুরি পাড়ায় একটা খ্রিস্টান হোস্টেলে।

ছবি: রতন গোমেজ

সকাল ৬ টায় হোস্টেল গেট খুলতেই কাঁধে কলেজ ব্যাগটা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য গুলিস্তান। সেখান থেকে লাল রঙের বিআরটিসি বাস নিয়ে একেবারে সরাসরি নরসিংদী আমাদের বাসায়। মোবাইল ফোন ছিল না তখন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় হোস্টেলের ল্যান্ড ফোনে মা ফোন করতেন। কেন জানি সেই শনিবার মায়ের ফোন আসেনি। কিংবা হয়ত এসেছিল, কিন্তু ডেকে দেননি মাসি। সারাদিন কত জনের কত কত ফোন আসে। কত আর ডাকবে সে। এসব ভাবতে ভাবতে ফার্মগেট খামারবাড়ির সামনে থেকে একটা লোকাল বাসে উঠে পড়লাম।

খামার বাড়ি থেকে গুলিস্তান মোড়। স্টুডেন্ট ভাড়া ৪ টাকা। বাসের ভেতরে বেশ চাপা গুঞ্জন। গতকাল বিকেলে নাকি খুব গন্ডগোল হয়েছে। একজন বয়স্ক লোকের হাতে দেখলাম একটা খবরের কাগজ। তাতে বড় বড় করে লেখা ‘আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা’।

তখনও আমার রাজনৈতিক দর্শন তেমন পরিপক্বতা পায়নি। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি আলাদা করে বোঝার বয়স হয়নি। কোন কিছু মনে রাখার মত বয়স চিন্তা করলে বলতে পারি- আমাদের ঘরের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর একটা বড় ছবি ছিল। আর ৭ মার্চ, ১৫ আগস্ট সকাল থেকে রাত অবধি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজাতেন বাবা। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় শিশু একাডেমীতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের প্রথম ১৪ চরণ ভাষণ দিয়ে প্রথম হই। সেটা ১৯৯৭ সালের গল্প। আমার এলাকার মুক্তিযুদ্ধ রচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেও পুরস্কার পেয়েছিলাম। আমাদের বাসার কাছেই একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। তার মুখে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শুনতে শুনতে লিখে নিয়েছিলাম। এর পরেরবার বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকে প্রথম হই। এই প্রথম হবার পেছনে কৃতিত্ব আসলে আমার মায়ের। মায়ের চেস্টায় কচি হাতের ভুল শুধরে অবশেষে আঁকলাম প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে। আমার কাছে রাজনীতি মানে, মুক্তিযুদ্ধ মানে, দেশ মানে তখন কেবল বঙ্গবন্ধু!

আমার বাস এসে পৌঁছল ততক্ষণে শাহবাগ। ‘গ্রেনেড হামলা’- এই গ্রেনেড শব্দটা হঠাৎ খুব পরিচিত মনে হল। কোথায় যেন শুনেছি। পরক্ষণেই মনে পড়ল মুক্তিযুদ্ধের রচনা লিখতে গিয়ে লিখেছিলাম এর কথা। কিন্তু এখনত যুদ্ধ চলছে না। তাহলে গ্রেনেড হামলা কেন?

ছবি: রতন গোমেজ

কারা করল ?
কেন করল ?
কী তাদের উদ্দেশ্য ?
কারা আবার সোনার বাংলাকে রক্তাক্ত করতে চায়?

বাস এসে হঠাৎ থামল বায়তুল মোকাররমের সামনে। কর্কশ গলায় কন্ডাক্টার বললেন, ‘নামেন নামেন বাস আর যাইব না সামনে রাস্তা বন্ধ।’ আতংকিত যাত্রীরা বলাবলি করতে লাগল, এইত এইত একটু সামনেই পার্টি অফিস। ওখানেই গতকাল গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। বহু মানুষ মারা গেছে। আল্লাহ শেখ হাসিনাকে অল্পের জন্য বাঁচাইছে।

কথাগুলো ছুরির মত এসে বিঁধল গায়ে। বাঁশের বেষ্টনী ডিঙ্গিয়ে হাঁটা দিলাম সামনে। কয়েক কদম এগুতেই কেমন যেন চোখ জ্বালা করতে লাগল। একটা পুলিশ ভ্যান সাঁই করে চলে গেল আমার পাশ দিয়ে। হঠাৎ নিজের অজান্তেই সেটাকে অনুসরণ করে এসে দাঁড়ালাম ঠিক যেখানটায় গাড়িটা থামল। নাকে একটা উটকো গন্ধ এসে লাগল। কিছুটা কোরবানির ঈদের পরদিন ময়দানে যেমন একটা গন্ধ লাগে তেমন। এরপর আমার চোখের সামনে যে দৃশ্যটা আসলো তা আমি কোনদিন দেখিনি। আমি জানি কোনদিন কেউ দেখবেও না ।

সিনেমার পর্দায় যুদ্ধবিধ্বস্ত ময়দান দেখেছেন নিশ্চয়ই? যুদ্ধের নির্মমতা-নিষ্ঠুরতা প্রকাশে লাল রঙ্গে সাজানো ছবি আমাদের মনকে কষ্ট দেয়। আর সেদিন আমার সামনে লাল রঙ নয়, টকটকে লাল রক্তে রাঙা যুদ্ধের ময়দান। সূর্য কেবল তার রশ্মি দেয়া শুরু করেছে তখন। কতক্ষণ এক জায়গায় দাড়িয়ে ছিলাম জানি না। আমার চোখের সামনে হাহাকার করছিল বেওয়ারিশ মাংসপিণ্ড। সোনালি ফিতের এক পাটি জুতার ছোপ ছোপ লাল রঙ, হলুদ-কমলা মিশেলে এক টুকরো রঙ্গিন আঁচল,শার্টের ছিড়ে যাওয়া একটা বোতাম, একটা কাল ক্লিপ, একখানি কানের দুল আর একটি ছিন্নভিন্ন আঙ্গুল যার অর্ধেকটা কালচে রক্তমাখা।

দুনিয়া কাঁপানো শব্দে একটা পিকাপ ভ্যান এসে দাঁড়াল সেখানটায়। গোটা চারেক লোক নেমে এল তার থেকে। একজনের হাতে পাটের চট। কালচে রক্তদলা মাংসপিণ্ডগুলো পরম মায়ায় চটে মুড়িয়ে একসাথে জড়ো করতে লাগল সে। আরেকজন মালিকানাহীন জুতাগুলো কুড়িয়ে একপাশে রাখল তুলে নিবে বলে। অন্য একজন ওয়াসার পানির ট্যাংক থেকে পাইপ টেনে এগিয়ে আসছিল। ধুয়ে দিতে রক্তরঙ।

ছবি: রতন গোমেজ

আমার চোখ আবার ফিরে গেল দলিত মাংসপিণ্ডের ছোট্ট টিলায়। কী আশ্চর্য! সেই ছোট্ট টিলা এভারেস্ট সমান তীব্রতা নিয়ে বিদ্ধ করল আমার বুক। মূহুর্তেই ঝাঁজরা হয়ে গেল আমার বুকের সবকটি পাজর। আমার মায়ের মুখ, আমার দেশের মানচিত্র, আমার প্রিয় বঙ্গবন্ধু কন্যার মুখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এল।

১১টি গ্রেনেড একযোগে বিদ্ধ করল আমার চেতনা। কিন্তু দুষ্কৃিতিকারীরা জানে না- শত গ্রেনেডের আঘাতেও চেতনাকে মেরে ফেলা যায় না। কারণ সত্য চেতনার মৃত্যু নেই। তাই ১৪ বছরে দ্বিগুণ তীব্রতায় জ্বলজ্বল করছে চেতনা। শুধু আফসোস ২৪টি প্রাণ আজও বিচার না পাওয়ার বেদনায় বাতাসে ক্রন্দন করে।

আমরা ভুলি নাই, ভুলবোও না ২১ আগস্টের ভয়াবহ ও নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত সকল শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)