জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য তৈরি হলে সেটি ভেঙে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে ধর্মভিত্তিক কিছু রাজনৈতিক দলের নেতারা। এই হুমকিদাতারা ভাস্কর্যকে ‘মূর্তি’ আখ্যা দিয়ে সেটা তৈরি না করার জন্য সরকারকে ‘নির্দেশ’ দিয়েছেন। ব্যাকরণসম্মত না হলেও শব্দটাকে এখানে ‘নির্দেশ’ বলছি কারণ যে ভাষায় এসব বলা হয়েছে সেগুলো দাবির পর্যায়ে থেকে সরকারের প্রতি অনুরোধ থাকেনি। এটা স্পষ্টত নির্দেশনা; দুর্বলকে সবলের নির্দেশনা, যেখানে আছে নির্দেশ অমান্যে শাস্তির হুমকি। এই শাস্তি কী? ‘বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করা হবে, সূর্য ওঠা দেখবেন কিন্তু সূর্য ডুবা দেখবেন না’— এমন অনেক কিছু।
সরকারকে নির্দেশনা জনতার মধ্য থেকে কেউ সাধারণ অর্থে দিতে পারে না, ওই পর্যায় থেকে কিছু ওঠে আসা মানে দাবি কিংবা অনুরোধ। কিন্তু ‘মূর্তি’ বানানো হলে সেটা বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করা হবে— এমন কথাগুলো আর যাই হোক দাবি-অনুরোধের পর্যায়ে থাকছে না। এটা হুমকি, এবং কথামতো না চললে কী পরিণতি অপেক্ষা করছে সেটারও উল্লেখ আছে। ভেঙে দেওয়া হবে, বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করা হবে, সূর্য ডুবা দেখানো হবে না; কত ভয়ঙ্কর ভাবা যায়!
ইসলামি শাসনতন্ত্র বাংলাদেশের মাওলানা ফজলুল করিম পীর সাহেব চরমোনাই, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা মামুনুল হক, মুফতি নূর হোসেইন নূরানী নামীয় ব্যক্তিগণ এসব হুমকি প্রকাশ্য সমাবেশে দিয়েছেন। তাদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য যখন আসলো তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী চলছে, এই বার্ষিকী উপলক্ষে সরকার বছরব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে, দেশ-বিদেশে আমন্ত্রিত অতিথিও আসছেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংসদের বিশেষ অধিবেশন চলছে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলার ঘোষণা দেওয়া হলেও সরকার ও আওয়ামী লীগের কেউ টু-শব্দটি উচ্চারণ করল না। একমাত্র ব্যতিক্রম আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনিই কেবল প্রতিক্রিয়াশীলদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন। এরবাইরে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য কোন নেতার কোন বক্তব্য নাই। বক্তব্য নাই আওয়ামী লীগের কেন্দ্র নিযুক্ত মুখপাত্রদের, বক্তব্য নাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের, বক্তব্য নাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদের।
আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলের বঙ্গবন্ধুকে অপমানের প্রতিবাদ না করলেও প্রতিবাদ করেছে হাসানুল হক ইনু ও শিরিন আখতারের জাসদ। তারা মৌলবাদী দলগুলোর এই দাবির তীব্র প্রতিবাদ করে বলছে, ‘সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য স্থানান্তরিত করার মধ্য দিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ীদের আশকারা দেওয়ার ফলেই আজ এই অপশক্তি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করার দুঃসাহস দেখাতে পারছে।’ এইধরনের দলগুলোকে আর এক চুলও ছাড় না দিতে আওয়ামী লীগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ধোলাইপাড় মোড়ে যেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সেখানে চরমোনাই পীরের এক সমাবেশে মুফতি নূর হোসেইন নূরানী ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় সরাসরি হুমকি দিয়েই বলেছেন, ‘…এয়ারপোর্ট এলাকায় মূর্তি বানিয়ে রাখতে পারেননাই, ভেঙে দিয়েছি। আপনাকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, যদি বাহাদুরি দেখান আপনাকে দেখে নেওয়া হবে। মূর্তি বানালে সে মূর্তি এখানে থাকবে না, বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ধরাকে সরাজ্ঞান করবেন না, এই দেশ আপনার বাপ-দাদার একার নয়; মসজিদের শহর ঢাকাকে মূর্তির শহর বানাতে দেব না। মূর্তি বানিয়ে দেখুন, ২৪ ঘণ্টায় সেই মূর্তি বুড়িগঙ্গায় জমা হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ভোট ছাড়া যদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন তবে মূর্তি কীভাবে ভাঙতে হয় নবীজী আমাদের সে শিক্ষা দিয়ে গেছেন।… মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সূর্য উঠতে দেখবেন, সূর্য ডুবতে দেখবেন না।’
গত ১৩ নভেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে মাওলানা মামুনুল হক হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে তারা বঙ্গবন্ধুর সু-সন্তান হতে পারে না। এর মাধ্যমে মসজিদের শহরকে মূর্তির শহরে পরিণত করার অপচেষ্টা চলছে। এ মূর্তি স্থাপন বন্ধ করুন। যদি আমাদের আবেদন মানা না হয়, আবারও তওহিদি জনতা নিয়ে শাপলা চত্বর কায়েম হবে।’ ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনের চরমোনাই পীরও একইভাবে বঙ্গবন্ধুর নির্মিতব্য ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে সেটা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
ভাস্কর্যকে মূর্তি হিসেবে উল্লেখ করে সেটা বন্ধ ও অপসারণের দাবি জানানো বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলোর নতুন কিছু নয়। কিছু ভাস্কর্য তারা অপসারণ করেছে নিজেরা জোরপূর্বক, কিছু করেছে সরকারকে হুমকি দিয়ে। লালন ভাস্কর্য রাতের আঁধারে ভেঙে ফেলেছিল তারা। সুপ্রিম কোর্টের সামনের ‘জাস্টিসিয়া’ ভাস্কর্য অপসারণ করেছে এর বিরুদ্ধে প্রচারণা, হুমকি ও সরকারকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে। ২০১৭ সালে জাস্টিসিয়া অপসারণে হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো যখন আন্দোলনের হুমকি দিয়েছিল তখন খোদ প্রধানমন্ত্রীই এই ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে সেটা অপসারণের নির্দেশ দেন। ওই সময় আওয়ামী লীগ আর ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে এককাতারে শামিল হতে দেখেছি আমরা। ওইসময় বরাবরের মতো আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতারা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বিরোধিতা না করলেও জাসদের প্রয়াত সাংসদ মঈনউদ্দীন খান বাদল মাগুরায় দলের তার এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আগামীকাল এই …বাচ্চারা বলবে বঙ্গবন্ধুর ছবি ফেলে দিতে হবে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সরাতে হবে, মুক্তিযুদ্ধাদের ভাস্কর্য সরাতে হবে।’ বীর এই মুক্তিযোদ্ধার কথা অক্ষরে-অক্ষরে সত্য হতে চলেছে, জাস্টিসিয়া ভাস্কর্য সরানোর তিন বছরের মাথায় কেবল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতাই করছে না তারা, তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায়ও ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। এবং ভাস্কর্য নির্মাণ হলে শেখ হাসিনাকে ‘দেখে নেওয়া হবে বলেও হুমকি দিচ্ছে।’ আশকারার ফলাফল কেমন; ভাবা যায়?
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে এমন তীব্র ভাষায় প্রকাশ্য অপমান আগে খুব কমই হয়েছে। কিন্তু এরপরেও সরকার ও আওয়ামী লীগ চুপ। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এ নিয়ে আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখনও করোনা আক্রান্ত। তিনি এখন সামনে আসবেন না। উনি সুস্থ হলে এটা নিয়ে হয়তো আপনাদের সঙ্গে কথা বলবেন বা ওনার সঙ্গে আপনারা আলাপ করতে পারেন।’ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও তিনি এনিয়ে দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারেননি বা ব্যাখ্যা করেননি, ঋজু হতে দাঁড়াতে পারেননি। এখানে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর যে দাবি-হুমকি সেটাকে ধর্মীয় ভাবার সুযোগ নাই, কারণ বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র মুসলিম জনবহুল দেশ নয়। মুসলিম জনবহুল অনেক দেশে বিভিন্ন ব্যক্তির ভাস্কর্য রয়েছে। চরমোনাই, মামুনুল, নূরানিদের এই দাবি তাই কোনোভাবেই ধর্মীয় নয়, ওটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই রাজনৈতিক কৌশলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার ইচ্ছা যে আওয়ামী লীগের নেই সেটা ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য থেকে পরিস্কার।
দুঃখজনক এই বাস্তবতার সিঁড়ি একদিনে রচিত হয়নি। এটা রচিত হয়েছে ধাপে-ধাপে। ধর্মনিরপেক্ষতার মূলমন্ত্র নিয়ে এগিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ ক্রমে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক আদর্শের রক্ষাকবচ হয়ে ওঠছে। হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার খেসারত এটা। এই সংগঠনগুলো আওয়ামী লীগকে তার চিরায়ত আদর্শ থেকে বিচ্যুত করছে। অথচ ক্ষমতায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধর্মনিরপেক্ষতা ধারণ করে রাজনীতি করে আসছিল।
আওয়ামী লীগের এই বাঁকবদলের কারণ মূলত সর্বশেষ দুই জাতীয় নির্বাচন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার গঠনের পর, ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আসলে দলটিকে যেকোনোভাবে ক্ষমতায় থাকার মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছে। ফলে যেকোনো হুমকিতে দল ও সরকার কেঁপে ওঠে। বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক যেকোনো সংগঠনের যেকোনো দাবি-হুমকিতে তটস্থ হয় সরকার ও আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনগুলো আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছে ঠিক, কিন্তু দুর্বল করেছে ভয়ঙ্করভাবে। গত কয়েকবছরে সরকারি ও দলীয় কর্মসূচিগুলো খেয়াল করলে দেখা যায় ওসব জায়গায় সংগঠকের দায়িত্বে নেই আওয়ামী লীগ। সরকারের সকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে পুলিশ ও প্রশাসন। অথচ সংসদ ভর্তি আওয়ামী লীগের এমপি, দেশ ভর্তি আওয়ামী লীগের নেতা, ফেসবুক ভর্তি আওয়ামী লীগের অ্যাক্টিভিস্ট; কিন্তু প্রয়োজনের সময়ে কেউ নাই। বঙ্গবন্ধুকে এমন জঘন্য ভাষা ও ইঙ্গিতে হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও দলের কোন কর্মসূচি নাই, প্রতিবাদ নাই।
এই যাত্রায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নির্মাণ কাজ যদি বন্ধ করে দিতে পারে ধর্মভিত্তিক দলগুলো তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। জাতির পিতা আমাদেরকে একটা দেশ এনে দিয়েছিলেন, তার জন্ম শতবর্ষে তাকে এমন অপমানজনক প্রতিদান দিলাম আমরা? আওয়ামী লীগ কীভাবে পারছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এমন অপমান সহ্য করতে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)