চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বইমেলা এবং আনন্দসব

কেমন হবে এবারের বইমেলা? কেমন জমবে? এসব নিয়ে ভাবনা কাদের? ভাবনাগুলো কেমনই বা?
অমর একুশে গ্রন্থমেলা, মানে বাংলা একাডেমির বই মেলা, মানে আমাদের বইমেলার কথা এলেইতো আলগোছে, হেঁটে চলে আসেন চিত্তরঞ্জন সাহা। একা, একজন মানুষ একটা বইমেলা, বইয়ের মেলা, বইয়ের আড়ং জমিয়ে দিয়ে গেলেন।
কতটা স্বপ্নবান হলে এমন কাণ্ড ঘটে! ঘটতে পারে!

এতএব, বইমেলা নিয়ে কিছু লেখার আগে, বলার আগে, ভাবার আগে তাকে প্রণতি জানাই। তারপর বলি, আমাদের বইমেলা দিনে দিনে, একটু একটু করে এখন একটা বিরাট ঘটনা বটে। পুরো এক মাস, মহান ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি জুড়ে বইয়ের মেলা, বই নিয়ে উৎসব বিশ্ব বাঙালির কাছে অনেক বড় ঘটনা এখন।

তো সেই ঘটনাটা কেমন জমবে এবার? যে মানুষটার প্রথম বই বের হবে এই মেলায়, তার মনের ভেতর, বুকের গভীর তলে এখন কী ঘটছে কে জানে! কে জানে কোথায় কোন নবীন পাঠক মেলা নিয়ে কী ভাবছেন! কী ভাবছেন প্রবীণ আর নবীন প্রকাশকরা! কী ভাবছে বই মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি! আর যে প্রেমিক, নববসন্তে, তার প্রথম প্রেমের হাত ধরে যাবে বইমেলার আঙিনায়, তার মনের ভেতর কী খেলা চলছে এখন?

যে যাই ভাবুন, ভাবুক; আমি চাই ভীষণ জমে উঠুক বই মেলা। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ নতুন নতুন বই, নতুন চিন্তা, নতুন বাক্য, নতুন গল্প, নতুন কবিতারা নেচে বেড়াক বইমেলায়। মানুষের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি কথাতো এক একটি চিন্তা, ফিলোসফি। প্রতিটি বই, নতুন বইতো এক একটি ভাবনা, চিন্তা, এক একটি পথ। একটি বই, একটি লেখা, একটি কবিতায় যদি নতুন একটা ভাবনার উপাদান না-ই পাওয়া যায় তাহলে তা পড়বো কেনো আমি; এই কথাটা বলতেন মহান বাঙালি পণ্ডিত হুমায়ুন আজাদ। আর বইমেলা এলেই তিনি ফিরে ফিরে আসেন। ফিরে ফিরে আসে আনন্দসব। বিগত শতাব্দীর শেষ দশক, আর একবিংশ শতাব্দীর শুরুটা বই মেলা হুমায়ুন আজাদের জন্য অন্যতম এক আনন্দের জায়গা ছিলো। তখন বইমেলা মানেই পুরোটা সময় তিনি বাংলা একাডেমি চত্বরে, আগামীর স্টলে। অনেকটা সময় তিনি বিপুল আনন্দ নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে বসে থাকতেন। মেলা দেখতেন, মানুষ দেখতেন, বইয়ের পাতায় অটোগ্রাফ দিতেন তার পাঠককে। আর বলতেন নতুন নতুন সব কথা। কাছে পেয়ে অনেক নবীন-প্রবীণ লেখক তাদের বইটি হুমায়ুন আজাদকে দেখানোর জন্যে, হাতে দেয়ার জন্যে উতলা হতেন। তিনি হাতেও নিতেন সেই বই। পাতা উল্টে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করতেন। তারপর পাশে থাকা একটি কাগজের বাক্সে ফেলে রাখতেন বইসব।

ভাবতাম দিনশেষে বইগুলো নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু না। প্রতিদিন একই ঘটনা। তিনি রাতে যখন একা একা, ফুরফুরে নির্ভার ভঙ্গিতে বেরিয়ে যেতেন মেলা থেকে, তখন হাতে একটি বইও থাকতো না। এ নিয়ে তাকে একদিন প্রশ্ন করতেই বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলে বলেছিলেন, ‘একটি বাক্যও শুদ্ধ হয় না, পড়া যায় না।’ তারপর একটা উপন্যাসের বই আমাকে দিয়ে বললেন ‘পড়ো’। আমি পড়তে শুরু করতেই তিনি বললেন, ‘ভুলটা ধরতে পারলে?’ তার তাড়ায় আমি আঁধারে পথ খুঁজতে থাকি। তারপর তিনি বলেন, ‘প্রথম বাক্যটা পড়ো।’ ‘তারা পরস্পর হাঁটছে’- আমি পড়ি। ‘বাক্যটি ঠিক আছে?’ বাংলার শিক্ষক, কবি, ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আজাদ প্রশ্ন করেন। এবার আমি অন্ধকারে ব্যাকরণ খুঁজি। আর তিনি একটু বিরক্তি কণ্ঠে এনে বলেন, ‘তুমিও দেখছি মূর্খ। ‘তারা পরস্পর হাঁটে কী করে? একজনের হাঁটা কি অন্য জন হাঁটতে পারে? তাই বাক্যটি সবদিক দিয়ে ভুল। আর যে বই, বা অপন্যাস (হুমায়ুন আজাদ তথাকথিত উপন্যাসকে অপন্যাস বলতেন)- এর প্রথম বাক্যটি ভুল তা কী করে পড়া যেতে পারে?’ বলেই তিনি একটু তাচ্ছিল্যভরে হাসলেন।

ঠিক তার একটু পরেই, একজন এলেন। হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ কিনে বাড়িয়ে দিলেন অটোগ্রাফের জন্যে। কলম খুলে নাম জানতে চাইলেন ‘অলৌকিক স্টিমার’- এর লেখক হুমায়ুন আজাদ। মুগ্ধপাঠক তার প্রিয় লেখকের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘মঞ্জিতা’। হুমায়ুন আজাদ একটু অবাক। ‘এটা কেমন নাম হলো?’ ‘স্যার, ওই যে মন যোগ জিতা’। জবাব শুনে মন ভরলো না ‘নারী’র লেখকের। তিনি কথা-বার্তায় বেপরোয়া এটা কে না জানে। তাই মুগ্ধপাঠিকার মুখের ওপর বলে দিলেন হুমায়ুন আজাদ। ‘কে বলেছে এটা তোমাকে। এটা ভুল।’ মুহূর্তে একজন মানুষের উজ্জ্বল মুখে আঁধার নেমে এলো। তিনি বই হাতে মিলিয়ে গেলেন মেলার ভিড়ে। আর ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’র লেখক হুমায়ুন আজাদ মেতে উঠলেন অন্য আনন্দে।
তাকে নিয়ে, মানে হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে বইমেলায় এমন অনেক অনেক গল্প আছে, প্রতিদিনের। আছে অনেক আনন্দ আর বেদনা গাঁথা। আছে অন্যের মুখ উজ্জ্বল করে দেয়ার গল্প। আছে অন্যের মুখ ম্লান করার কাহিনিও।

আর, আর আছে বইমেলার ধুলোওড়া বিকেলে, সন্ধ্যায়, একটু একটু করে নেমে আসা রাত্রিতে অনেক হারিয়ে যাওয়া মুখ ফিরে পাওয়ার আনন্দ।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)