অমর একুশে গ্রন্থমেলায় গত বছর পর্যন্ত কেবল নিজের জন্যই বই কিনতাম। এবার তার সাথে যুক্ত হয়েছে কন্যা। বয়স তিন হলেও এই বয়সেই সে যেভাবে বুকশেলফ থেকে নামিয়ে বড় বড় বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টায় এবং ছেড়ে, তাতে মনে হলো ভবিষ্যতে সে পণ্ডিত হবে। তো এই ভাবি পণ্ডিতকে সাথে নিয়ে এবার তিনদিন মেলায় যেতে হয়েছে এবং তার জন্য কিছু বই কিনতে হয়েছে।
এতটুকু বাচ্চার জন্য কী বই কিনব? শুধু রঙচঙা ছবিওয়ালা লেমিনেটেড বই? কিছু না হয় কেনা গেলো। কিন্তু কিছু গল্পের বইও তো কেনা দরকার। কেননা, সে প্রায়ই রাতে ঘুমানোর সময় তার মাকে বলে, মা ওই সিংহের গল্পটা বলো। ফলে খুঁজে খুঁজে কিছু বাঘ সিংহ শিয়াল আর খরগোসের গল্পটাইপের বইও কিনলাম। সমস্যা হলো, এর একটা বড় অংশই পড়তে গিয়ে আমি নিজেই বিরক্ত। ৪/৫ বছরের শিশুদের জন্য লেখা বইয়ে কতটুকু ওজনের শব্দ ব্যবহার করা যাবে, সেটিও যদি আমাদের লেখকেরা, বিশেষ করে কথিত শিশুসাহিত্যিকেরা না জানেন, তখন মনে হয় আমার তিন বছরের মেয়ে আমার সাথে বানিয়ে বানিয়ে যেসব কুকুর বিড়াল আর খরগোসের গল্প যে ভাষায় বলে, সেটি হুবহু লিখে দিলেই অনেক ভালো সাহিত্য হয়।
বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য নিয়ে এই তর্কটা বহুদিনের যে, শিশুদের জন্য আসলে কী লেখা হচ্ছে? যারা লিখছেন তারা কি শিশুর বয়স অনুযায়ী শব্দব্যবহার ও বাক্যগঠন জানেন? নাকি একটা বই লিখতে হবে এবং ভালো কাগজে রঙিন মোড়কে ছাপিয়ে দিলেই শিশুসাহিত্য হয়ে গেলো? লেখক ও প্রকাশকরা জানেন, শিশুদের বইয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি এবং তুলনামূলকভাবে শিশুদের বইয়ের দামও বেশি। কেননা এসব বই ছাপতে হয় উন্নত কাগজে, বহু রঙে। কিন্তু ভেতরের কনটেন্ট অর্থাৎ শিশুরা যেটি পড়বে, সেটি আদৌ শিশুপাঠ্য হলো কি না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
এতদিন বিষয়টা নিয়ে নানা ফোরামে কথা শুনলেও এবার নিজের মেয়ের জন্য বই কিনে সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করলাম। আমার পাকনা মেয়ে এই বয়সেই যেসব প্রশ্ন করে এবং বিভিন্ন বিষয়ে যেসব পর্যবেক্ষণ দেয়, সেগুলো তার ভাষায় লিখলেও উন্নত মানের শিশুসাহিত্য হবে বলে আমার ধারণা।
প্রসঙ্গ পাল্টানো যাক। গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ৪ হাজার ৫৯১টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে এবং এ বছর বিক্রি হয়েছে ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই। টাকার অংকে এটি নেহাত কম নয়। গতবার বিক্রি হয়েছিল ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার বই। অর্থাৎ এ বছর বিক্রি বেড়েছে। ‘মানুষ বই পড়ে না, শুধু ফেসবুকে থাকে’ ইত্যাদি অভিযোগের কালে ৭০ কোটি টাকার বই বিক্রি তো আশাব্যঞ্জকই। বিপরীতে যদি এটি বলা হয় যে, ১৭ কোটি মানুষের দেশে এক মাসের বইমেলায় ৭০ কোটি টাকার বই বিক্রি কী এমন ফিগার? ফলে এই তর্কটা অমীমাংসিত।
এবারের আরেকটা ফিগারের দিকে নজর দেয়া যায়। এই গ্রন্থমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির তরফে জানানো হয়েছে, এ বছর যে সাড়ে ৪ হাজার নতুন বই এসেছে, তার মধ্যে ৪৮৮টি মানসম্পন্ন। এখানেও সেই একই প্রশ্ন। গ্লাসের অর্ধেকটা ভর্তি না খালি? অর্থাৎ প্রায় ৫০০ মানসম্পন্ন বই একটি মেলায় প্রকাশিত হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু পক্ষান্তরে গ্লাসের অর্ধেক খালি তত্ত্বের আলোকে যদি প্রশ্ন করা হয়, সাড়ে ৪ হাজার বইয়ের মধ্যে মাত্র ৪৮৮টি অর্থাৎ মাত্র ১০ শতাংশ বই মানসম্পন্ন? কী লেখেন আমাদের লেখকরা? এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় প্রশ্নটিও সঙ্গত যে, বাংলা একাডেমি ৪৮৮টি বইকে মানসম্মত বলে দাবি করলো কিসের ভিত্তিতে? তারা কি ৪ হাজার ৫৯১টি বই পড়ে তার মধ্য থেকে ৪৮৮টি বাছাই করেছে?
মেলা চললো ২৮ দিন। তো শেষদিনেই তারা কী করে এই সংখ্যা দিতে পারলো? তাদের কি একটি বিশাল পাঠকগোষ্ঠী রয়েছে যারা বইমেলায় প্রকাশিত সব বই খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ে তার মান যাচাই করেন? যদি থাকেন তাহলে তারা কারা? বাংলা একাডেমি কি ওই পরীক্ষকদের পরিচয় প্রকাশ করবে? নাকি তারা দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে বই বাছাই করে সেখান থেকে মান যাচাই করে? সেক্ষেত্রে তো নির্দিষ্ট করে ৪৮৮টি বলার সুযোগ নেই। সেটি হবে সাড়ে চারশো বা পাঁচশো। গল্পটা কি এরকম যে, এক লোক জিজ্ঞেস করলেন, ভাই বলেন তো আপনার মাথায় চুল কয়টা? তিনি উত্তর দিলেন, এক লাখ ২৩ হাজার ৫৮২টা। প্রশ্নকর্তা বললেন, আপনি কী করে এই সংখ্যাটা বললেন? আপনি কি গুনে দেখেছেন? জবাবদাতা বললেন, জি গুণেছি। বিশ্বাস না হলে আপনি গুণে দেখেন।
আরেকটা প্রশ্ন করতে চাই। সেটি হচ্ছে, একাডেমি কর্তৃপক্ষ কি মনে করে যে, পরিচিত লেখকরা যা লেখেন তার সবই মানসম্পন্ন এবং এ কারণে তারা যাই লেখেন, গণহারে তার সবগুলোতেই মানসম্পন্ন বইয়ের তালিকাভুক্ত করে আর যারা পরিচিত নন তাদের বইগুলো পড়ে দেখে? অপরিচিত এবং একেবারেই নবীন অসংখ্য লেখক আছেন যারা কথিত বিখ্যাত ও জনপ্রিয় লেখকদের চেয়ে অনেক ভালো লেখেন। বাংলা একাডেমির কাছে সেই তালিকা আছে? আবার অনেক বিখ্যাতরা যে শুধুই চর্বিত চর্বন করেন, একই কুমিরের বাচ্চা প্রতি বছর বিক্রি করেন, কেবল প্রকাশকের তাগিদ আর পয়সার গুঁতোয় যা মুখে আসে তাই উগরে দেন, বাংলা একাডেমি কি এরকম একটি তালিকা করার ক্ষমতা রাখে?
বরাবরের মতো এবারও অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত নতুন বইয়ের মধ্যে সংখ্যার বিচারে কবিতার বইই শীর্ষে। ৪ হাজার ৫৯১টি বইয়ের মধ্যে ১ হাজার ৪৭২টিই কবিতার বই। মানে ৩২ শতাংশই কবিতার বই (যদিও দেশের লেখককূলের মধ্যে সম্ভবত ৮০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে কবি)। এরপর রয়েছে গল্প ও উপন্যাস। এবার গল্পের বই ৭০১টি এবং ৬৪৩টি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। আমরা যেসব বইকে মননশীল বলে চিহ্নিত করি, সেরকম বই প্রকাশিত হয়েছে ২৫৭টি। এর বাইরে গবেষণা ১২২টি, জীবনীগ্রন্থ ১০৭টি, রচনাবলী ১৫টি, নাটক ২৩টি, ভ্রমণ বিষয়ক ৯১টি, ইতিহাসের ১১০টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে ৯১টি। এগুলো কেবলই সংখ্যা নয়। এখানেও পাঠক ও লেখকের মনস্তত্ত্ব রয়েছে। যে ১ হাজার ৪৭২টি কবিতার বই বেরিয়েছে, ধারণা করা যায় তার মধ্যে ৯০ শতাংশই লেখক নিজের পয়সা খরচ করে বের করেছেন। কেউ কেউ প্রকাশককে পয়সা দেয়ার পাশাপাশি বিশেষ অনুরোধও করেছেন। এসব বইয়ের ক্রেতা ওই কবি নিজেই। কিছু বই তিনি পরিচিতজনদের অনুরোধ করে কিনতে বাধ্য করেন। হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলে ছাড়া আর কোনো কবিতার বইয়ের বিক্রি নিয়ে প্রকাশকরা খুশি হয়েছেন বলে মনে হয় না।
আমার বন্ধু কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ সম্প্রতি তার ফেসবুক ওয়ালে একটি পোস্ট দিয়েছে। লিখেছে, দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী এসে তাকে বলেছে যে, সে কিছু কবিতা লিখেছে। এখন সে একটি বই বের করতে চায়। তো তার পরামর্শ কী? অগ্রজ কবি হিসেবে ইমতিয়াজ তাকে পরামর্শ দিয়েছে, এবার তুমি আমার সাহিত্য জীবন নামে একটা বই লিখতে পারো।
তো এই যে প্রতি বছর অজস্র লেখক তৈরি হচ্ছেন এবং বইমেলা শুরু হলেই ফেসবুকের দেয়াল ভরে যায় লেখকদের বইয়ের বিজ্ঞাপনে তা জাতি হিসেবে কতটা আমাদের মননশীলতার পরিচয় বহন করে আর কতটা নিজেকে জাহিরের তাড়না, সেটা আরেক প্রশ্ন। কেননা কত হাজার বই প্রকাশিত আর কত টাকার বিক্রি হলো, তার চেয়ে বড় তর্ক, লোকজন আসলে পড়ে কি না। আমার ধারণা, বইকেনা, বইমেলা যাওয়া ইত্যাদিও এখন জাতে ওঠার একটা কায়দায় পরিণত হয়েছে। মহানাগরিকবৃন্দের ফোক ফেস্ট যাওয়ার মতো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)