ফোনের নেশা কাটাতে বাবা-ছেলে আমেরিকা থেকে ভ্রমণ করলেন মঙ্গোলিয়ায়। দুজনে মিলে ভ্রমণ করেছেন ২ হাজার ২শ’ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ!
অভিযাত্রী জেমি ক্লার্ক ও তার সন্তান খোবে মোটরসাইকেল, ঘোড়া ও উঠের পিঠে চড়ে মঙ্গোলিয়ার প্রত্যন্ত উপত্যকায় চষে বেরিয়েছেন মাসখানেক। কখনো তারা ঘুরেছেন উপত্যকায়, কখনো সমতলে। থেকেছেন তাবু টাঙ্গিয়ে, খেয়েছেন নিজেরা রান্না করে। অনেক ছবিও তুলেছেন। কিন্তু সেই ছবি ভ্রমণের সময় তারা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন তারা।
বিবিসি বলছে, কীভাবে একজন কিশোর তার ফোন রেখে আপনার সাথে কথা বলবে, মঙ্গোলিয়ায় ভ্রমণ করে জেমি ক্লার্ক সেটির সন্ধান করলেন। মঙ্গোলিয়ার একটি প্রত্যন্ত উপত্যকা দিয়ে নিজের মোটরসাইকেলের পেছনে চড়ে জেমি ক্লার্ক তার চিন্তাকে বাতাসের সঙ্গে একাত্ম করলেন, সন্তানের সঙ্গে চড়ে হলেন চমৎকৃত।
আজীবন স্কিচালক, পর্বতারোহী এবং ট্র্যাকার জেমি ক্লার্ক অনুভব করলেন যে, তিনি তার প্রিয় সন্তান খোবের সান্নিধ্য পাচ্ছেন না। যে কিনা সব সময় আলবার্টার ক্যালগরির নিজ বাড়িতে ফোনের ভেতরেই ডুবে থাকে সব সময়। যদিও তিনি তার জন্য নিজেকেই দায়ী করলেন আংশিকভাবে। অন্য সবার মতোই তার একটি ব্ল্যাকবেরী স্মার্টফোন রয়েছে এবং সন্তান ছোট থাকাকালীন তাকে নিয়ে নিয়মিত গেমস খেলা উপভোগ করতেন। ।
ক্লার্ক বিবিসিকে বলছিলেন, যদি আমাদের পরিবারে আজকে কারো কোনো নেশা থাকে, তবে তার জন্য আমরা নিজেদেরকে (পিতা-মাতা) নির্দোষ বলতে পারি না। প্রযুক্তির ডিভাইসগুলো দুর্দান্ত, যা আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছে!
বিষয়টি কয়েক বছর আগে তার মাথায় এসেছিলো যখন ক্লার্ক তার ৫০তম জন্মদিন উদযাপের জন্য সাপ্তাহিক ছুটিরতে পরিবারের নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার একটি হোটেলে যান। ওই এলাকায় কোনো ওয়াই-ফাই ছিলো না।
খোবে বিবিসিকে বলছেন, মূলত সাপ্তাহিক ছুটিতে আমার ফোন ছাড়া কখনো আগে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। এটা আমার জন্য অদ্ভূত ছিলো। খোবে স্বীকার করেন যে, সে সময় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কারণ তাকে যেতে হবে এবং দুঃখজনক কারণ ইনস্টগ্রাম স্ন্যাপচ্যাট ছাড়া থাকতে হবে।
এই ব্যাপারটি প্রযুক্তি তার পারিবারিক জীবনকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছিলো তা ক্লার্ক বুঝতে পারেন এবং কীভাবে এখান থেকে রেহায় পাওয়া যায় তা তিনি চিন্তাভাবনা করতে থাকেন।
দীর্ঘদিন ধরে ক্লার্ক একটি বাইকে করে মঙ্গোলিয়াজুড়ে ভ্রমণের স্বপ্ন দেখছিলেন। এখন তার ছেলে বড় হয়ে গেছে। তবে তাকে সাথে নিয়ে নয় কেন?
প্রায় এক বছর আগে তিনি খোবেকে প্রস্তাব করলেন মঙ্গোলিয়ার ব্যাপারে।
খোবে বলছেন, ‘বাবার প্রস্তাবে তিনি তাড়াতাড়ি কোনো কিছু বলেননি। তবে তার বাবার প্রস্তাবকে তিনি ফান হিসেবে নিয়েছিলেন। কারণ এটি ব্যাপক প্রস্তুতির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।’
ইতোমধ্যে অবশ্য খোবে তার মোটরসাইকেলের লাইসেন্স পেয়েছিলো এবং দুজনে দীর্ঘ পথ অনুশীলণ করে নিযেছে। যদিও তার বাবা ক্লার্ক দুবার এভারেস্টে উঠেছেন, আর খোবে নিজে কখনো পাহাড়ে উঠেননি। তাই তাকে পাহাড় নিয়েও অনুশীলন করতে হয়েছে।
অনুশীলন শেষ করে তারা ২৮ জুলাই বের হলেন এবং পরের মাসে তারা মোটর সাইকেল, ঘোড়া এবং উঠের পিঠে চড়ে মঙ্গোলিয়ায় চষে বেরিয়েছেন ২,২০০ কিলোমিটার (১,৩৬৭ মাইল) এর বেশি পথ। ভ্রমণের সময় তারা ফিরে আসার আগ পযন্ত ছবি পোস্ট করা থেকে বিরত থাকেন। যদিও খোবের ফোন থেকে দূরে থাকা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিলো।
খোবে বলেন, পুরো সময় আমার ফোনটি মিস করেছি। তবে তার বাবার জন্য এটা অনেক মূল্যবান ছিলো। বিশেষত সময়টা তারা তাদের তাবু, রাস্তায় কাটানোর জন্য রান্না এবং পারস্পরিক বন্ধন তৈরিতে কাজে লাগিয়েছে।
“আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে যখন তিনি কোনো কাজের পরিবেশ এবং পরিবার থেকে দূরে থাকেন তিনি সম্ভবত আমার বয়সের কাছাকাছি অভিনয় করেন”- বলছিলেন খোবে।
একইভাবে খোবের বাবা ক্লার্কও অবাক হয়েছেন তার সন্তান কতোটা পরিণত হয়েছে তা জেনে।
তিনি বলেন, এই ভ্রমণ খোবেকে নতুনভাবে দেখার জন্য সাহায্য করেছে। আমি তাকে দেখতাম সে শিশুর মতো তার জ্যাকেট টেবিলে রেখে চলে যেতো। পরিষ্কার করার পত্রে রাখতো না। কিন্তু এখন আমি তাকে একজন তরুণ হিসেবে দেখছি। আমি খুশি এই জন্য যে, সে এখন চাপের মধ্যে থেকেও কাজ করতে পারে।
তবে অলাভজনক সংস্থা কমনসেন্স মিডিয়ার প্যারেন্টিং এডিটর ক্যারোলিন নর বলছিলেন, আপনার সন্তানদের সাথে বন্ধন তৈরির জন্য আপনাকে বিশ্বের অন্যপ্রান্তে যেতে হবে না। মিডিয়া এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে পিতামাতকে শিক্ষিত ও সচেতন হলেই চলবে। এক্ষেত্রে অভিভাবকরা বাড়িতে স্ক্রিনমুক্ত সময় অঞ্চল স্থাপন করতে পারেন, বিশেষত ছুটির দিনগুলোতে।
তিনি বলছেন, আনপ্লাগ সময়ে মজাদার কিছু করার চেষ্টা করুন। যেমন সন্তানকে নিয়ে কোনো গেম খেলুন, বেড়াতে যান বা এমনকি সিনেমা দেখুন।
নিজে সোফায় শুয়ে থেকে ফোনে ব্যস্ত না থেকে সন্তানদের সময় দিলে ইতিবাচক ফল আসে।
“আমি আমার ফোন বন্ধ করছি যাতে আমাদের পারিবারিক সময় মজাদার হয়”, বলেন তিনি।
অবশ্য জেমি ক্লার্ক এখন বলছেন যে, তাদের ভ্রমণ শেষ হয়েছে। তিনি এবং তার সন্তান তাদের প্রতিদিনের ভ্রমণের জীবনে যে শিক্ষা পেয়েছেন তা প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন।
তিনি বলছেন, আমি এখন বুঝতে পারছি যে, প্রযুক্তি মূল্যবান এবং এটি ব্যবহার করুন এবং তবে বুঝতে হবে যে, এটি কীভাবে গ্রহণ করতে হবে। প্রযুক্তিকে আমি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
খোবে বলছেন, তিনি প্রযুক্তি নিয়ে এমন নতুন কিছু করতে চান, যা সামাজিকতা রক্ষা করে। যখন আপনি একটি গ্রুপে থাকেন আর তখন প্রত্যেকে ফোনে ব্যস্ত থাকেন, তখনই আমি আমার অভ্যাসটি পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি। মানুষের দিকে মনোযোগ না দেওয়াটা অভদ্রতা।