চৌদ্দ বছর আগে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী খনিবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ বাবুল রায় এখন পঙ্গু। শরীরের প্রায় অর্ধেক অংশ অবশ হয়ে হারিয়েছেন কর্মক্ষমতা। স্ত্রী আর তিন সন্তানকে যতটা ভাবনা, তারচেয়েও বেশি ভাবনা সেই কয়লা খনি নিয়েই।
ওই আন্দোলনের ১৪ বছর পূর্তির আগের দিন হুইল চেয়ারে বসে তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বললেন, ‘আমার জীবন থাকতে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি থেকে কয়লা তোলার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে দেব না। প্রয়োজনে আবারও রক্ত দেব।’
মঙ্গলবার ফুলবাড়ী উপজেলার সুজাপুর গ্রামে বাবুল রায়ের বাড়ীতে গিয়ে তার বর্তমান অবস্থান জানতে চাইলে তিনি দৃঢ়চিত্তে কথাগুলো বলেন।
২০০৬ সালে ২৬ আগস্টের সেই আন্দোলনের স্মৃতি স্মরণ করে বাবুল রায় জানান, প্রতিদিনের মতো সেদিন আর রিক্সাভ্যান বের করেননি তিনি। সকালে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বানে এশিয়া এনার্জির অফিস ঘেরাও কর্মসূচিতে অংশ নিতে বের হয়েছিলেন।
‘‘তখন আমার স্ত্রী তখন ৫-৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বিকেল ৩টায় ফুলবাড়ী ঢাকা মোড় থেকে খনিবিরোধী মিছিল শুরু হলে আমি তাতে অংশ নেই। ছোট যমুনা নদীর উপর ব্রীজের কাছে মিছিলটি আসতেই পুলিশ বিডিআর একযোগে গুলি বর্ষণ শুরু করে। লোকজন দিক-বেদিক ছুটাছুটি শুরু করে দেয়। হঠাৎ একটি গুলি আমার পিঠে বিদ্ধ হয়। আমি রাস্তায় পড়ে যাই। তারপর আর কিছুই বলতে পারি না।’’
সেদিন গুলিবিদ্ধ বাবুল রায়কে প্রথমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পিজি হাসপাতাল, ট্রমা সেন্টার ও গণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে দীর্ঘ ১১ মাস চিকিৎসা শেষে বাড়ীতে ফিরে আসেন। এখন হইল চেয়ারই তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
বাবুল রায় বলেন, ‘আমি আর কোনদিন দু’পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারবো না। আমার ৩ ছেলে মেয়ে কিভাবে মানুষ হবে তাও জানি না। আমি এখন কর্মক্ষমহীন মানুষ। তাতে আমার আক্ষেপ নেই।’
‘‘আমি আমার মনকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। যে এশিয়া এনার্জির কালো থাবা থেকে আপাততঃ আমরা ফুলবাড়ীবাসী মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু এখনও কয়লা খনি করার পায়তারা চলছে। এ নিয়ে আমি মর্মাহত। তাছাড়া এখনও কার্যকর হয়নি ফুলবাড়ীবাসীর দেয়া সরকারের সঙ্গে ৬ দফা চুক্তি। কবে তা কার্যকর হবে ? এ প্রতিক্ষার দিন গুনছি আমি।’’
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি প্রকল্প বাতিল, জাতীয় সম্পদ রক্ষা এবং বিদেশি কোম্পানি এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ী থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট এক প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেয়।
তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ও ফুলবাড়ী রক্ষা কমিটির সেই মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ-বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি)। গুলিতে নিহত ৩ জন। আহত অন্তত দুই শতাধিক মানুষ। যাদের অনেকেই আজ বাবুল রায়ের মতো পঙ্গু।
সেই আন্দোলের মুখে তৎকালীন বিএনপি-জামায়েত জোট সরবকার বাধ্য হয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন বন্ধ করাসহ ৬ দফা চুক্তি করে আন্দোলনকারীদের সাথে। কিন্তু দীর্ঘ বছর পরও সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি।