দেড়মাস ধরে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া কলেজের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা যে আন্দোলন করছেন এতদিন তা ফুলবাড়িয়ার বাইরে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সম্প্রতি তারা ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করার পরও বিষয়টি সরকার বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মনোযোগ কাড়তে পারেনি। এখন শুধু মন্ত্রণালয় নয়, পুরো দেশই ফুলবাড়িয়া কলেজকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের কথা জেনে গেছে। কিন্তু, এর মধ্যেই ঘটে গেছে চরম দুঃখজনক ঘটনা। রোববার পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে ফুলবাড়িয়া কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং পথচারী সফর আলী মৃত্যুবরণ করেছেন। পুলিশ অবশ্য বরাবরের মতো তাদের দায় অস্বীকার করে শিক্ষকসহ দু’জনের মৃত্যুকে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে দাবি করেছে। সর্বশেষ ফুলবাড়িয়া পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। এর সবই শুরু ফুলবাড়িয়া কলেজের পরিবর্তে সেখানকার অন্য একটি ছোট কলেজকে জাতীয়করণে তালিকাভুক্ত করার পর থেকে। সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, সম্প্রতি সরকার ২৩টি কলেজকে জাতীয়করণে তালিকাভুক্ত করে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থেকে যে তিনটি কলেজের নাম পাঠানো হয়েছিল সেখান থেকে তালিকায় স্থান পায় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ। ফুলবাড়িয়া কলেজটি যেখানে প্রতিষ্ঠিত ১৯৭২ সালে, সেখানে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কলেজটি ১৯৯৯ সালে তখন এবং এখনকার এমপি মোসলেম উদ্দিনের নামে মোসলেম উদ্দিন কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পরে ২০০৯ সালে কলেজটির নাম করা হয় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের এ কলেজটিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা তিনশর মতো, আর সাত বিভাগে অনার্সসহ ফুলবাড়িয়া কলেজের শিক্ষার্থী পাঁচ হাজার তিনশ। এসব কারণে ফুলবাড়িয়া কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং স্থানীয় মানুষের আশা ছিল যে ওই উপজেলা থেকে কোন কলেজ যদি জাতীয়করণ করা হয় তাহলে এ কলেজটিই হবে। শেষ পর্যন্ত তা না হওয়ায় তারা হতাশ হয়েছেন। এজন্য স্থানীয় এমপির দিকেই অনেকের অভিযোগের আঙুল। তবে, এমপি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, তিনি স্থানীয় তিনটি কলেজের নাম প্রস্তাব করেছিলেন এবং মন্ত্রণালয় সেখান থেকে একটি কলেজকে বেছে নিয়েছে। অনেকেই মনে করেন, মন্ত্রণালয় আগেপিছে কোনকিছু বিচার না করে শুধু নাম দেখেই ফুলবাড়িয়া কলেজকে বিবেচনায় না নিয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কলেজকে তালিকাভুক্ত করেছে। ফুলবাড়িয়ার সাধারণ মানুষের এও ধারণা যে, স্থানীয় এমপি এ কারণেই নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজটিকে ২০০৯ সালে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কলেজ করেছেন। এভাবে ‘কূটকৌশল’-এর কাছে ফুলবাড়িয়া কলেজের ন্যায়সঙ্গত অধিকার মার খেয়েছে। কোন সচেতন মানুষই এমন কৌশলকে সমর্থন জানাতে পারেন না। এরকম কৌশলে একদিকে যেমন একটি নামের কারণে কেউ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তেমনি শুধু একটি নামের বিরুদ্ধে যাবে বলে অধিকারের আন্দোলন থেকে অনেকে সরে যেতে বাধ্য হয়; কিংবা হাজারো মানুষকে এমন সর্বজন শ্রদ্ধেয় নামের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় যে নামে তারাও সবসময় শ্রদ্ধাবনত। তারপরও তারা অধিকারের পক্ষে দাঁড়ালে শেষ পর্যন্ত এটা প্রমাণের চেষ্টা করা হয় যে ওই জনগোষ্ঠী শ্রদ্ধেয় নামের বিরুদ্ধে। ফুলবাড়িয়ায় যারা আন্দোলন করছেন সেখানে দুয়েকজন আওয়ামী লীগ বিরোধী হওয়ায় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নাম নিয়ে আপত্তির কারণে আন্দোলনে শামিল হয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু বড় অংশই শুধুমাত্র যেটা ন্যায্য সেটার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তাদের মূল দাবি জাতীয়করণ হলে সব শর্ত বেশি করে পূরণ করা তাদের কলেজকে জাতীয়করণ করতে হবে। এখন আন্দোলনটা নিজেদের দাবির পক্ষে সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তির ‘চালবাজি’র কারণে একটি কলেজের বিপক্ষে গেলেও তাদের ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ অন্যায্য হয়ে যাবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যেমন ফুলবাড়িয়া কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবিটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে, তেমনি যারা ব্যক্তিস্বার্থে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণীর নাম ব্যবহার করছেন তাদের বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে। একইসঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের নাম নিজ স্বার্থে এবং যথেচ্ছ ব্যবহার করতে দেওয়া হবে কিনা সেই বিষয়টিও সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।