বাংলাদেশের অভিনয় জগতে জলজলে একটি নাম হুমায়ুন ফরীদি। অভিনয়ের সকল মাধ্যমেই ছিলো তার বিচরণ। অভিনয় ক্যারিয়ারে যার বাজার দর ছিলো সব সময় রমরমা! অথচ এই অভিনেতা নাকি ‘ফিরে এসো বেহুলা’ ছবিতে অভিনয় করে পারিশ্রমিক হিসেবে নিয়েছিলেন মাত্র এক প্যাকেট ব্যানসন লাইট!
তানিম নূরের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘ফিরে এসো বেহুলা’। ২০০৯ সালে ছবির শুটিং শেষ করলেও ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রিমিয়ার হয়। একই বছরের জানুয়ারির ২০ তারিখে তারকাবহুল ছবিটি বলাকা সিনেমা হলে মুক্তি পায়। এরপর প্রায় অর্ধযুগ ছবিটি নিয়ে আর কোনো কথা শোনা যায়নি। তবে আসছে ঈদুল আজহায় ওয়ার্ল্ড টিভি প্রিমিয়ার হতে যাচ্ছে আলোচিত ছবিটির।
‘ফিরে এসো বেহুলা’ ছবিটির ওয়ার্ল্ড টিভি প্রিমিয়ার করতে চলেছে চ্যানেল আই। ঈদের পঞ্চম দিন সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে দেখানো হবে ছবিটি। এমন খবরে যেনো উচ্ছ্বাসের শেষ নেই নির্মাতার! একেতো প্রথম ছবি, তার উপর ছবিটি ছিলো তারকা সমৃদ্ধ! বিশেষ করে দেশের প্রখ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির উপস্থিতি! এই ছবি নির্মাণকে কেন্দ্র করে দেশের গুণী এই অভিনেতার সহযোগিতা ও তার সঙ্গে সখ্যতার স্মৃতি অকপটে বলেছেন তানিম নূর:
ফরীদির সাথে প্রথম সাক্ষাৎ:
হুমায়ুন ফরীদিকে ‘ফিরে এসো বেহুলা’য় কাস্ট করার কথা জানিয়ে নির্মাতা তানিম নূর স্মৃতিচারণ করে বলেন, এটা ২০০৮ সালের কথা। মাস্টার্সে পড়ছি তখনো। কিন্তু এরমধ্যেই আমি সিদ্ধান্ত নেই ‘ফিরে এসো বেহুলা’ সিনেমাটি যেভাবেই হোক করবো। তো একটি চরিত্রের জন্য ফরীদি ভাইকে(হুমায়ুন ফরীদি) সিলেক্ট করলাম। কিন্তু উনার সঙ্গে কীভাবে সাক্ষাৎ করি! এ নিয়ে যখন ভাবছি তখন আমার এক বন্ধু জানালো ফরীদি ভাইয়ের মেয়ে দেবযানী তার ক্লাসমেট বন্ধু! এভাবেই লিঙ্ক ধরে সেই বন্ধুটিকে নিয়ে আমি ফরীদি ভাইয়ের ধানমন্ডির বাসায় দেখা করতে গেলাম। বয়স কম থাকায় তিনি ভেবেছেন আমি হয়তো এই ছবিতে অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছি। তিনি আমাকে বললেন, তুমিই পরিচালক নাকি সাথে আরো কেউ আছে? নিজেকে পরিচালক পরিচয় দেয়ায় তিনি আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হয়েছিলেন! সেই প্রথম তার সামনে দাঁড়ানো।
ফরীদিকে অভিনয়ের প্রস্তাব:
প্রথম দিন সাক্ষাৎ করে ছবি নিয়ে আলাপ জুড়ে দেই। তাকে বলি ‘ফিরে এসো বেহুলা’ ছবিতে আপনার ক্যারেক্টারটি কিন্তু বড় নয়। ছোট একটি ক্যারেক্টার। স্ক্রিনে বড়জোর সাত থেকে আট মিনিটের অ্যাপেয়ারেন্স! তিনি বললেন, সমস্যা নেই। তুমি আমাকে স্ক্রিপ্ট দাও। এটা পড়ে তোমাকে জানাচ্ছি। স্ক্রিপ্ট দিয়ে আমি চলে আসি। তার ক’দিন পর তিনি আমাকে জানালেন, উনি ছোট চরিত্রটিই করবেন। ক্যারেক্টারটি তার পছন্দ হয়েছে। আমি জানি না কেন, তিনি ছোট ক্যারেক্টারটিই খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, উনার কস্টিউমগুলো তিনি শুটিংয়ের সাত দিন আগে নিজের কাছে নিয়ে নেন। যেন ক্যারেক্টারের মধ্যে ঢুকে যেতে পারেন!
‘ফিরে এসো বেহুলা’য় কতো পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন ফরীদি?
উনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন। এতো হিউমার উনার! সব কিছু নিয়ে মজা করার সহজাত অভ্যাস ছিলো তার। তো শুটিং যখন করতাম তিনি মজা করে আমাকে বলতেন, কি মিয়া! টাকা পয়সা দিবা না! প্রায় প্রতিদিন তিনি এমনটা করতেন। আমিও বলতাম, ফরীদি ভাই, এইতো দিয়ে দিবো। শুটিং শেষ হওয়ার আগেই দিয়ে দিবো! কিন্তু যেদিন শুটিংয়ের শেষ দিন, সেদিন তিনি আমাকে বললেন, কি মিয়া, শুটিংতো শেষ। পয়সাতো দিলানা? আমি বললাম, দিচ্ছি ফরীদি ভাই, পয়সা রেডি করে রাখছি। তিনি আমাকে বললেন, নাহ! তুমি আমাকে এক প্যাকেট বেনসন লাইট দাও।
এটা একটা অদ্ভূত ঘটনা। তিনি যে সময় আমার ছবিতে অভিনয় করলেন সেসময়ে তিনি সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক নিয়ে কাজ করতেন। অভিনয় ক্যারিয়ারে সব সময় তার রমরমা অবস্থা ছিলো। অথচ আমার সিনেমায় অভিনয় করে তিনি কোনো কারণে রেমুনারেশন নেননি। প্রফেশনাল আর্টিস্ট, অল্প হলেওতো নিবে। তাই তিনি এক প্যাকেট বেনসন লাইট চেয়েছিলেন শুধু।
কিন্তু ছবিটি দেখে যেতে পারেননি ফরীদি…!
ফরীদি ভাইয়ের সাথে ছবিটি করার পর আমার ব্যক্তিগত ভাবে তার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। উনি সাহিত্য আর স্পোর্টস খুব পছন্দ করতেন। আমারও এই দুটি বিষয় পছন্দের। ফলে আমরা সাহিত্য ও খেলাধুলা নিয়ে প্রচুর আড্ডা দিয়েছি। আমাদের সম্পর্ক গাঢ় হয়েছিলো। এমনকি ফরীদি ভাই আমাকে বলেছিলেন, তুমি ভবিষ্যতে যতো কাজ করবা আমাকে বললেই হবে। ‘ফিরে এসো বেহুলা’ করার পর আমাদের বেশ ভালো যোগাযোগ ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ছবিটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ছবিটির প্রিমিয়ার হয়। কিন্তু তিনি দেখতে আসতে পারেননি। আমাকে বলেছিলেন ডিভিডি পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু এরপরেতো তিনি অসুস্থই হয়ে যান। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান।
‘ফিরে এসো বেহুলা’ ছবিতে হুমায়ুন ফরীদি ছাড়াও অভিনয় করেন জয়া আহসান, মামুনুর রশিদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, জয়ন্ত চ্যাটার্জী, তৌকীর আহমেদ, শতাব্দী ওয়াদুদ, ইন্তেখাব দিনারসহ এরকম আরো বহুজন।
সম্প্রতি তানিম নূর শেষ করেছেন ‘স্বল্পদৈর্ঘ্যে দীর্ঘ যাত্রা’ স্লোগানে তরুণ ১১ নির্মাতাকে নিয়ে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের আলোচিত অমনিবাস চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রজেক্ট ‘ইতি তোমারই ঢাকা’।