ছোটবেলায় আমি একবার ফজরের নামাজ পড়তে আযানের অনেক আগেই ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। মসজিদে গিয়ে দেখি হুজুর, মুয়াজ্জিন ঘুমাচ্ছেন! অথচ আমি স্পষ্ট আযান শুনেই ঘর থেকে বের হয়েছিলাম!! আসলে আমার ভ্রম হয়েছিল। এখনও মনে আছে, বাড়ির গেইটে একবার, আবার বাজার আর মসজিদের সংযোগকারী ছোট গলিটায় দুইটা দুই রঙের কুকুর আমার দিকে কড়া নজর রেখেছিল! বাজারের পাহারাদার ওই সময় আমাকে দেখে হাতের লাঠি উঁচু করেছিলেন বটে, চিনতে পেরে আর বেশী কিছু করেননি। হঠাৎ বোধোদয় হওয়া, অন্ধকার, সুনসান বাজার, কুকুর, ফাঁকা মসজিদ দেখে খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম বৈকি।
বাড়ি ফিরে টেবিল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, আযান পড়তে আরও ঘণ্টা দুয়েক বাকি। মধ্যরাতে তাহলে আমাকে ঘুমের মধ্যে আযান শোনালো কে? অসময়ে ঘরের বাইরে যাওয়া শুধুই কি আমার কৈশোরের অস্থিরতা নাকি অন্য কিছু? দিনের বেলায় হুজুরের সাথে দেখা করলে তিনি বললেন, মধ্যরাতে ‘তেনারা’ এসে আপনাকে নাম ধরে ডাকবে, পরিবারের কোন সদ্যসের অথবা আপনার পরিচিত কোনো বন্ধুর কণ্ঠস্বর নকল করে। একবার বাইরে গেছেন তো আর ফিরে আসতে পারবেন না! হুজুর ছোট-বড় সবাইকে আপনি বলে ডাকতেন।
আমার না হয় ছোটবেলায় ভ্রম হয়েছিল। বাংলাদেশ এর আলোচিত-সমালোচিত পণ্ডিত ফরহাদ মজহার এর বড়বেলায় কী হল? উনি অত সকালে একা একা অত সাবলীল ভঙ্গিমায় চিরচেনা সাদা পোশাকে কোথায় যাচ্ছিলেন? কথিত ‘অপহরণকারীরা’ তাকে কী যাদুবলে সকালে শুভ্র পোশাকে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে প্রলুব্ধ করেছিল? তাকে কি হিপনোটাইজ করা হয়েছিল? যিনি নিজের সান্নিধ্য ও নানাবিধ আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের শত শত ছেলে-মেয়েকে ‘হিপনোটাইজ’ করে রেখেছেন তার মস্তিষ্ক অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করবে, এটা আমার কেন, কারোরই বিশ্বাস হবে না।
সিসিটিভি ক্যামেরায় স্পষ্ট দেখা গেছে তিনি একা, স্বাধীনভাবে বের হয়ে আসছেন। সিকিউরিটি গার্ড তাকে খানিকটা এগিয়ে দিতেও গেলেন। আচ্ছা এর পরে কী হয়েছিল? তিনি কি পায়ে হেঁটেই এলাকা পার হয়েছেন? নাকি বাসভবনের মূল ফটক থেকে কোন গাড়িতে উঠেছিলেন বা উঠানো হয়েছিল? মূল ফটকের বাইরেও নিশ্চয়ই সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। এর ফুটেজ দেখলে পরিষ্কার হবে, ফরহাদ মজহার স্বাধীনভাবে বাসা থেকে বের হয়ে কীভাবে এলাকা ছাড়লেন?
বাংলাদেশের শীর্ষ একটি বাংলা দৈনিক এমন কায়দা করে সংবাদ শিরোনাম এবং সূচনায় লিখেছে, পুলিশ নাকি বলেছে যে, ফরহাদ মজহারকে বাসা থেকে বের হওয়ার পরে টেনে হিঁচড়ে একটি মাইক্রোবাসে তোলা হয়েছে (?)। এই শিরোনাম আর সূচনা পড়লে যে কারো মনে হবে, পুলিশ নিজে তদন্ত করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। আসলে ফরহাদ মজহার এবং তার পরিবার পুলিশের কাছে এমন দাবি করেছে।
পুলিশ সেই পত্রিকার সাংবাদিককে তাদের রেফারেন্স দিয়ে বললেও শিরোনামে বিষয়টি অত্যন্ত চালাকির সাথে লেখা হয়েছে। সাংবাদিকতায় চালাকি নিয়ে রাষ্ট্র কতটুকু ভেবে দেখেছে? দৈনিকটি এ কথাও প্রচার করেছে যে, ফরহাদ মজহার নাকি ৫ টা ২০ এর দিকে ওষুধ কিনতে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন! বিষয়টা কি স্বাভাবিক? এই ৭০ বছর বয়সে ফরহাদ মজহার এর মত একজন অবস্থাসম্পন্ন, বিখ্যাত এবং স্পর্শকাতর ব্যক্তি ভোরে একা একা ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন বলে পরিবারের বরাত দিয়ে যে কথা প্রচারের চেষ্টা হয়েছে সেটি বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
ফুটেজ দেখে বাসার নিচে রাস্তায় আসা পর্যন্ত তার দেহভাষা, মুখের ভাব ইত্যাদি রিড করলেও বোঝা যাবে তিনি মানসিকভাবে কী অবস্থায় ছিলেন। ঢাকা থেকে কীভাবে তিনি সীমান্তবর্তী খুলনা অঞ্চলে পোঁছালেন, এ প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। এখন ঢাকার রাজপথে অনেক স্থানেই পুলিশের তত্ত্বাবধানে গোপন এবং প্রকাশ্য ক্যামেরা লাগানো আছে।
বাসা যেহেতু শ্যামলী, সকালের নিরবতায় বাসে করে চলে যাওয়া বা নিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। আর যদি মাইক্রোবাসেও গিয়ে থাকেন, তার হদিস করাও সম্ভব। মাইক্রোবাসে করে গেলে অথবা নিয়ে যাওয়া হলে অবশ্যই আরিচা বা মাওয়া ফেরি ঘাট ব্যবহার করা হয়েছে। ফেরী ঘাটগুলোতে কি গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়? দেখা যেতে পারে। ঘাট সংলগ্ন চায়ের দোকান, হোটেল রেস্তোরায় খোঁজ করলেও কিছু মিলে যেতে পারে। তদন্তে সব চেষ্টা করতে হয়।
যদি বাসে করে ফরহাদ মজহার গিয়ে থাকেন বা তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে বাসা থেকে বের হওয়ার পরে গাবতলী পর্যন্ত রাস্তার পাশের এবং কাউন্টারগুলোর সিসি ক্যামেরা চেক করলে ফুটেজ পাওয়া যেতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। ফুটেজ পাওয়া না গেলেও বাসের মালিকদের সহযোগিতা নিয়ে বাসের ড্রাইভার, হেল্পারদের ছবি দেখিয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তারা নিশ্চয় তাদের সব সোর্সকে ইতোমধ্যে একটিভ করেছেন। বাস হলে গাবতলী দিয়েই খুলনা গেছেন বলা যায়।
আরেকটি বিষয় তদন্তে অবশ্যই পুলিশকে ক্লিয়ার করতে হবে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার হাতে কিছু ছিল না। কিন্তু ১৮ ঘণ্টা পরে যশোরে তাকে যখন হানিফ পরিবহনের বাসের পেছনে পাওয়া গেল তখন পুলিশ তার কাছ থেকে একটি ব্যাগ উদ্ধার করেছে। সেই ব্যাগে কাপড়, মোবাইল ফোন, চার্জার ছিল।
যারা বিষয়টিকে অপহরণ হিসেবে দেখছেন বা বিশ্বাস করছেন, তাদের প্রশ্ন হল এই ব্যাগ এল কীভাবে? আবার যারা বিষয়টিকে ফরহাদ মজহার এবং তার সহযোগীদের সাজানো নাটক বলে ভাবছেন, তারা বলছেন, মজহার সাহেবের কোনো সহযোগী বা ভক্ত এই ব্যাগের যোগান দিয়ে থাকতে পারে। হানিফ পরিবহনের বাসে তাকে পাওয়া যাওয়া বিষয়টিকে অনেকে সাজানো বলার চেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে নেয়া যেতে পারে তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহরিয়ার পলক এর একটি ফেসবুক পোস্ট। ফরহাদ মজহারকে পাওয়া যাওয়ার সাথে সাথেই তিনি ফেসবুকে লিখেন, “খুলনা থেকে আসছি হানিফের বাসে করে! নোয়াপাড়ায় হঠাৎ করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হলো! সুপারভাইজার কোনো কথার উত্তর দিলো না। প্রায় ৪০মিনিট পর ৩টি র্যাবের গাড়ি এসে তল্লাশি করলো, আর বাসের পেছনের সিট থেকে উদ্ধার হলো – নিখোঁজ কবি ফরহাদ মজহার…..। উনি ভালো আছেন , সুস্থো আছেন!!”। শাহরিয়ার পলক পুলিশের লোক নন, ফিল্ম ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন, ফলে এই পোস্ট নিয়ে অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই।
ফরহাদ মজহার নাকি ‘অপহরণের’ পর উনার পরিবারে ফোন করে বলেছেন, ‘ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে’। বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর ফরহাদ মজহার ৪/৫ বার ফোনে পরিবারে কথা বলেছেন। অপহরণের কত ঘটনা আমরা দেখেছি! এমন অপহরণ একটু অস্বাভাবিক নয়? অপহরণকারী বা কারীরা ফরহাদ মজহারকে ফোন ব্যবহার করতে দিচ্ছিলেন কেন? ফোনতো প্রথমেই নিয়ে নেওয়ার কথা। ফরহাদ মজহার নাকি রাতে সজাগ হয়ে লেখালেখি করেন। আগের রাত/সন্ধ্যা থেকে তিনি কাদের সাথে ফোনে কথা বলেছেন সেই লিস্ট চেক করে দেখা যেতে পারে।
সকালে কি উনার কাছে কেউ ফোন করেছিল? আচ্ছা ওষুধ আনতে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এমন মানুষ সাধারণত একটি/দুটি নির্দিষ্ট ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনার কথা। অত সকালে হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোন সাধারণ ফার্মেসি খোলা থাকার কথা না। পাড়া-মহল্লার ফার্মেসি বন্ধ থাকার কথা। পুলিশের উচিত এ দিকটা ভালো করে তদন্ত করা। বিশ্বাস করলাম যে উনি ফার্মেসিতে যাচ্ছিলেন। দূরের ফার্মেসিতে গেলে উনার তো গাড়ি ব্যবহার করার কথা। উনার নিশ্চয় গাড়ি আছে।
ফরহাদ মজহার বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনীতির জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। একাডেমিক জ্ঞান চর্চা ছাড়াও রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক ময়দানে তিনি সবসময়ই সক্রিয় ছিলেন এবং আছেন। সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন চলাকালীন সহিংসতাকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তিনি সন্ত্রাসীদের সাথে তুলনা করেছিলেন। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনচলাকালীন মাহমুদুর রহমানদের সঙ্গে নিয়ে দেশজুড়ে পাল্টা ডিসকোর্স চালু করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
যার ফলশ্রুতিতে হেফাজতে ইসলামের মতো একটি শক্তির আবির্ভাব দেখেছে বাংলাদেশ। ফলে ফরহাদ মজহার যে শুধু একজন লেখক তা নন, এদেশের একটি বিশেষ ঘরানার রাজনৈতিক শক্তির বড় আশ্রয় তিনি। ফলের তার গায়েব হওয়া যাওয়া এবং পাওয়া যাওয়ার মধ্যকার, আগের এবং পরের রহস্য পুলিশকে উদঘাটন করতেই হবে। এক্ষেত্রে আমাদের আশা থাকবে পুলিশ শুধু জিজ্ঞাসাবাদ, স্বীকারোক্তি ইত্যাদি মান্ধাতা আমলের প্রক্রিয়া অবলম্বন করবে না। প্রযুক্তি এবং বুদ্ধি ব্যবহার করে অপরাধী বা অপরাধীদের চেহারাও উন্মোচিত করবে। কারাগারের শাস্তি থেকে সামাজিক শাস্তি কোনো কোন বিষয়ে অনেক বেশি তাৎপর্য বহন করে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)