ফেসবুক মারফৎ এক অদ্ভুত প্রেসক্রিপশন বা রোগীর ব্যবস্থাপত্রের সন্ধান পাওয়া গেলো; যেখানে দেখা যাচ্ছে, ডাক্তার মহাশয় রোগীকে ২০টিরও বেশি ওষুধ লিখেছেন। প্রশ্ন হলো, এত ওষধু খাওয়ার পর রোগীর আর ভাত-তরকারি খাওয়ার প্রয়োজন পড়বে কি না? কারণ এত ওষধু খাওয়ার পরে অন্য কোনো কিছু খাওয়া সম্ভব নয়। আবার অন্য কিছু খাওয়ার পরে এই বিপুল পরিমাণ ওষুধ প্রবেশ করানোর মতো শূ্ন্যস্থান পাকস্থলিতে থাকবে কিনা তাও ভাবা দরকার।
তবে ডাক্তার সাহেবের হাতের লেখা ভালো। ওষুধের নাম পরিস্কার বোঝা যায়। পক্ষান্তরে অধিকাংশ ডাক্তারের হাতের লেখা সাধারণ শিক্ষিত মানুষ তো দূরে থাক অনেক সময় হাতের লেখা বুঝতে ফার্মেসিওয়ালাদেরও গলদঘর্ম হতে হয়। এরকম বাস্তবতায় সোমবার উচ্চ আদালত একটি নির্দেশনা দিয়েছেন স্বাস্থ্যসচিব এবং বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রারের প্রতি; যেখানে বলা হয়েছে, চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) স্পষ্টভাবে বা বড় অক্ষরে বা ছাপানো আকারে দিতে চিকিৎসকদের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে সার্কুলার জারি করতে হবে।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ‘ভুল ওষুধ গ্রহণের ঝুঁকিতে রোগীরা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২ জানুয়ারি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে দুই আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের শুনানি শেষে আদালত ওই নির্দেশনা দেন।
প্রেসক্রিপশনে অস্পষ্ট লেখার কারণে অনেক সময় ফার্মেসি থেকে ভুল ওষুধ সরবরাহ করা হয় এবং এর ফলে ঝুঁকিতে পড়ে জনস্বাস্থ্য। এই পরিস্থিতি এড়াতে আদালত এরকম একটি নির্দেশনা দিলেন। যদিও আজকাল অনেক ডাক্তার কম্পিউটারে ওষুধ লেখেন এবং এটিই সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি। কারণ দ্রুত লেখার কারণে অনেক সময় দুয়েকটি বর্ণ এদিক-ওদিক হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।
প্যাঁচানো এবং দুর্বোধ্য লেখায় ডাক্তারদের জুড়ি নেই। একটা গল্প আছে। এক মেয়ে গেছেন ফার্মেসিতে। গিয়ে বললেন, ভাই আমাকে লেখাটা উদ্ধার করে দিন। ফার্মেসির লোকটা বললেন, এখানে লেখা আছে-আই লাভ য়্যু। ফার্মেসিওয়ালা ওই মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এটা আমাকে কেন দেখালেন? মেয়েটি বললো, চিঠিটা আমাকে আমার ডাক্তার বয়ফ্রেন্ড দিয়েছেন। কিন্তু তার হাতের লেখা বুঝি না বলে আপনার কাছে নিয়ে এলাম।
তবে শুধু এই হাতের লেখার অস্পষ্টতাই নয়। প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখার অভিযোগও ডাক্তারদের বিরুদ্ধে বহু পুরনো। সম্প্রতি আমার শাশুড়ি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বেশ কয়েকদিন রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ফলে একটা বড় সময় আমাকে হাসপাতালের বারান্দা, বিভিন্ন ডাক্তারের রুম, রোগীদের ওয়ার্ড এবং অপারেশন থিয়েটারে কাটাতে হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, রোগীদের দুর্ভোগ, ডাক্তারদের আচরণ ও বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে কথা হত এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে যিনি একটি নামকরা ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা। দীর্ঘদিন এই সেক্টরে কাজ করার ফলে তিনি দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তার এমন সব অভিজ্ঞতা আমার সাথে শেয়ার করছেন, যেগুলো নিয়ে ৫০০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখে ফেলা সম্ভব। বিশেষ করে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ডাক্তাররা কীভাবে প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় ওষুধের নাম লেখেন তা জানলে ডাক্তারদের প্রতি সাধারণ মানুষের ন্যূনতম কোনো শ্রদ্ধা ভক্তি থাকবে না। তবে এও ঠিক যে, সব ডাক্তার ওষুধ কোম্পানির এইসব প্রলোভনের শিকার হন না বা সুবিধা নিলেও অপ্রয়োজনীয় বা মানহীন কোম্পানির ওষুধ লেখেন না।
কিন্তু বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে নগদ টাকা, ফ্রিজ, বিদেশ ভ্রমণের বিমান টিকিট এমনকি ক্ষেত্রে বিশেষে দামি গাড়ির মতো সুযোগ-সুবিধা নেয়ার পরে চিকিৎসকদের একটা নৈতিক বাধ্যবাধকতা তৈরি হয় বেশি বেশি ওই কোম্পানির ওষুধ লেখার বিষয়ে। আমার ওই বড় ভাই বললেন, ডাক্তাররা যখনই রোগীকে বেশি বেশি ভিটামিন বা সাপ্লিমেন্টারি লেখেন তখন বুঝতে হবে ডাক্তার সাহেব এসব লিখেছেন কোম্পানিকে খুশি করতে। ওইসব ভিটামিন না খেলে রোগীর খুব একটা ক্ষতি নেই।
তবে সময় সময় যে কোম্পানিকে খুশি করতেই ডাক্তাররা বেশি ওষুধ লেখেন তা নয়। বরং আমরা ধারণা, ডাক্তার সাহেব সঠিক রোগটি ধরতে না পেরে অনেকগুলো ওষুধ দেন, যেকোনো একটিতে যদি কাজ হয় এই ভেবে। যে কারণে বলা হয়, ভলো ডাক্তাররা ওষুধ কম লেখেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)