চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

প্রিয় মাহবুব ভাই

মাহবুব মতিন ভাই। সারাক্ষণই হাসিখুশি, প্রাণবন্ত একজন মানুষ। চ্যানেল আইয়ের সিদ্ধেশ্বরীর ছোট্ট অফিসটা যে কয়জন মাতিয়ে রাখতেন তাদের একজন মাহবুব ভাই। সকালে এসেই অফিসের সবার খোঁজ নেয়াটা ছিলো তার রুটিন কাজ। নিজের পাশাপশি অন্যের দিনটাও হাসি আনন্দে শুরু করিয়ে দিতেন।

আমি তখন নিউজ ডেস্কে কেবল জয়েন করেছি। তার ওপর নিজেকে গুটিয়ে রাখার স্বভাব। আমার জন্য নতুন পরিবেশটা সহজ করে দিলেন মাহবুব ভাই। নিজে থেকে পরিচিত হলেন। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রতিদিনই অফিসে এসে সবার খোঁজ নেয়ার এক পর্যায়ে ডেস্কে ঢুকেই টেনে টেনে শিশুসুলভ ডাক দিতেন ‘ডা…লি…য়া…’।

পেশাগত দিক থেকে মাহবুব ভাই ছিলেন মেধাবী নির্ভীক সাংবাদিক। কোন ঘটনা কাভার করতে গিয়ে নিজেকে একেবারে এর ভেতরে নিয়ে যেতেন। এজন্য কতবার যে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন! আহত হয়েছেন। পুলিশের মার খেয়েছেন। ২০০৬ এ কানসাটে বিদ্যুৎ আন্দোলন কাভার করতে গিয়ে মারাত্মক আহত হন। আর হরতাল কাভার করতে গিয়ে তো পুলিশের হামলায় আহত হয়েছেন অনেকবার। এক সময় তার নামই হয়ে গিয়েছিলো পুলিশের মার খাওয়া সাংবাদিক।

ব্যক্তি মাহবুব ভাই ছিলেন একেবারে শিশুর মতো। সিরিয়াস সব বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করে আসার পর শিশুসুলভ দুষ্টুমিতে অফিস মাতিয়ে রাখতেন। শিশুদের নিয়ে অনেক কাজ করার স্বপ্ন ছিলো। গড়ে তুলেছিলেন শিশু সংগঠন ‘ছোটরাই’। সংগঠনটিকে কীভাবে বড় করা যায় সেই চেষ্টা ছিলো সব সময়। ‘ছোটরাই’ ঘিরে তার কত পরিকল্পনা ছিলো।

মাহবুব ভাইয়ের কত স্বপ্ন অপূর্ণ ছিলো জানি না। তবে একটা স্বপ্ন পুরোপুরিই অপূর্ণ ছিলো। সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন মাহবুব ভাই। ২০০৮-০৯ এর দিকে দুপুরের পর কিংবা বিকেলে একটা সিরিয়াল সম্প্রচার হতো চ্যানেল আইয়ে। তাতে অভিনয় করতেন সুমাইয়া শিমু। প্রায়ই বলতেন, দ্যাখো, এই মেয়েটাকে আমার সিনেমার নায়িকা বানালে কেমন হয়? বলতেন, এমন একটা সিনেমা বানাবো যে সাড়া পড়ে যাবে! কথাগুলো বলতেন আর ভবিষ্যৎ সাফল্যের স্বপ্নে চোখ মুখ চকচকে হয়ে উঠতো।

নতুন প্রযুক্তি নিয়ে মাহবুব ভাইয়ের খুব আগ্রহ ছিলো। ফেইসবুক তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মাহবুব ভাই বলতেন, তিনিও এরকম একটা নেটওয়ার্ক করবেন। তবে এটা হবে প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক। সাংবাদিকদের জন্য। নেটওয়ার্কিং নিয়ে কত যে এক্সপেরিমেন্ট চালাতেন! সফল হলে শিশুর মতো আনন্দে লাফিয়ে উঠতেন।

কিন্তু, ভেতরে ভেতরে হয়তো ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন, বুঝতে দেননি কাউকে। কেন যে এত চাপা ছিলেন! এত গল্প করতেন, স্বপ্নের কথা বলতেন, কিন্তু কখনোই নিজের কোন কথা শেয়ার করতেন না। এর মধ্যে এক রাতে মগবাজার মোড়ে ছিনতাইকারীর কবলে পড়লেন। তার প্রিয় ল্যাপটপটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন মাহবুব ভাই। শুধু বলতেন, আমার সবকিছুই ছিল এর ভেতর। আমার সব স্বপ্ন নিয়ে গেল। ধকলটা কাটিয়ে ওঠা একটু কঠিনই হবে!

এমন প্রাণবন্ত, সহজ আর উচ্ছ্বল মানুষটি হঠাৎ করেই এভাবে চলে যাবেন ভাবতেও পারিনি।

দিনটা স্পষ্ট মনে আছে, ২০০৯ এর ৭ অক্টোবর, বুধবার। ডিউটি শেষ করে সন্ধ্যায় মাহবুব ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম। পরের দিন থেকে আমার ছুটি ছিল। মাহবুব ভাই কখনো এমন বলেন না কিন্তু সেদিন কেমন আব্দারের সুরে বলেছিলেন, ‘চলে যাবে? থাকো না আর কিছুক্ষণ!’ মনে হচ্ছিলো কিছু বলবেন। কিন্তু তাড়া থাকায় ওনার কথা রাখতে পারিনি। বেরিয়ে পড়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু মনটা খারাপ লাগছিল। ওই ছিলো মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কথা।

১০ অক্টোবর দুপুরে ন্যাশনাল ডেস্কের সুলতানা আপা ফোন করে মাহবুব ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ জানালেন। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বার বার শেষ কথাটি মনে পড়ছিল, ‘থাকো না আর কিছুক্ষণ!’ শোকের সঙ্গে খুব অপরাধবোধ কাজ করছিল।

মাহবুব ভাইয়ের মৃত্যুর মাস খানেক পরই চ্যানেল আই অফিস তেজগাঁওয়ে শিফট করা হলো। আগেরই সেই গরমে গাদাগাদি করে কাজ করার পরিবেশ নেই। অত্যাধুনিক বিশাল নিজস্ব ভবন। নিউজরুমে মাহবুব ভাইয়ের জন্যও একটা ডেস্ক নির্ধারিত ছিল। বহুদিন ফাঁকা পড়েছিল নতুন অফিসের চকচকে ডেস্কটি। তেজগাঁ’র অফিসে মাহবুব ভাই কোনদিন আসেননি। তারপরও মনে হতো, এইতো মাহবুব ভাই আসবেন। হাসি আনন্দে ভরিয়ে তুলবেন সবাইকে।

মাহবুব ভাই, আপনি চলে গেছেন আজ ৮ বছর। নিউজরুম আপনার প্রাণবন্ত উপস্থিতি এখনও মিস করে। ভালো থাকেন, শান্তিতে থাকেন, মাহবুব ভাই!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)