আমরা এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি এখান থেকে সহজে বের হওয়ার পথ সহজ নয়। কিছু কিছু অসুখ প্রাথমিক অবস্থায় সঠিক চিকিৎসা না করালে ক্যান্সার বাসা বাঁধে। তখন আর তেমন কিছু করার থাকে না। হয় জীবানু আক্রান্ত অঙ্গটি কেটে ফেলতে হয়, না-হয় রোগাক্রান্ত মানুষটির মৃত্য নিশ্চিত। প্রশ্নপত্র ফাঁস একই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
এক কালের হাতে হাতে নকল প্রবনতা হিম ঘরে চলে গেছে। প্রযুক্তির অবদানে কষ্ট করে বস্তায় বস্তায় কাগজ, নোট হাতের আঙুলে, কলমের শরীরে, প্যান্টের ভাঁজে বহন করতে হয় না। বাসায় বসে, রাস্তায় চলতে, পরীক্ষার আগমুহূর্তে সেল-ফোনে পাওয়া যায় পূর্ণ প্রশ্ন। উত্তরসহ। আগের মতো প্রশ্নপ্রার্থীদের পেরেশানিতে পড়তে হয় না। তেমন ভাবতে হয় না। বাড়ি বাড়ি দৌঁড়তে হয় না। অনেক টাকাও খরচ করতে হয় না।
একজন বা দু’জন হয়তো মোটা অংকের টাকা ঢালে তারপর মোয়ার দামে কেল্লা-ফতে। কে কখন কোথায় থেকে এ প্রশ্ন ফাঁস করছে, তা নাকি হাজার মাইলের গলি পথ! নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিগণ তাই বলছেন। আমরা সাধারণরা অতসব বুঝি না। তাদের কথা শুনলে কখনো মন মানতে চায়, কখনো মন মানতে চায় না। যেহেতু আমাদের কিছু করার থাকে না সেহেতু আমরা শুধু শুনি আর দেখি। কষ্ট হয় সম্মুখ ভেবে। যাক এসব। হালকালে এসে আমরা খুব আশাবাদি এবং খুবই গর্ববোধ করি আমাদের দেশের আইটি সেকশন বা তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষে। দিন দিন আমরা ডিজিটাল সাফল্যের দিকে যাচ্ছি ও অনেক দূর এগিয়েছি তা মিথ্যা নয়। এ সত্য অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই যে, ডিজিটাল সফলতায় অনেক কিছুতেই সুফল পাচ্ছি, আরও পারো, একসময় দেশ ডিজিটাল নির্ভর হয়ে যাবে। আজকের লাঙ্গল ঠেলে অথবা কেরানীর হাতের কর্মে লেজারশিট তৈরি ভাবী ভবিষ্যতে আর থাকবে না।
ইঁদুরের গায়ে একটি চাপেই চোখের সামনে খুলে যাবে অতীত বর্তমান ভবিষ্যত। এ সুখকর দিনের ছোঁয়া, দিনের অপেক্ষা আমাদের সুখি করে এবং কিছু প্রশ্নের মুখোমুখিও করে। আমাদের সময় যখন সুফিয়া সময়। আমাদের সময় যখন ডিজিটাল উন্নতি ছুঁই ছুঁই সময়। আমাদের সময় যখন তথ্য প্রযুক্তির সময় তখন আমরা যদি বলি, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো আর সম্ভব নয়! তখন কার কাছে, কীভাবে বলবো, আমরা ডিজিটালে অগ্রসরমান একটি সমাজ বা রাষ্ট্র? যেসব সোনার ছেলেরা রূপোর কাঠিতে বা আলাদিনের চেরাগে ফুঁ দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে তারা কারা, তারা কে, তারা কোথায় কী করছে, কীভাবে করছে, কতটুকু প্রযুক্তি তারা জানে, কতটুকু প্রযুক্তি তাদের আয়ত্ত্বে, কতটুকু দক্ষতায় তারা মজবুত অথবা শক্তিশালী? আমাদের প্রযুক্তির স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভূঁই থেকে পাশ করে আসা প্রযুক্তিবিদদের চেয়ে ওই প্রশ্নপত্র ফাঁস করা ছেলে-মেয়েরা কি অনেক বড়, অনেক জ্ঞানী, অনেক শক্তিশালী? প্রযুক্তির মাধ্যমে নাকি এখন চৌদ্দগোষ্ঠীর নাম-দাম বের করা যায়, তবে তারা কি পনের গোষ্ঠীতে পড়েছে যে রাডারে ধরছে না বা জীবানুর চেয়েও ছোট যে যন্ত্রের আঙুল গলে ফসকে যাচ্ছে? যদি তাদের ধরা না যায়, যদি তাদের নাগাল পাওয়া সম্ভব না হয়, যদি তাদের শক্তির কাছে অসহায়ত্ত্ব প্রকাশ করতে হয়, যদি আমাদের সর্বস্ব তাদের কাছে সমর্পিত করতে হয়, যদি তাদের প্রযুক্তিগত শক্তি অনেক কৌশলী হয় তবে তাদেরও যে মেধা আছে, শিক্ষা আছে, কৌশল আছে তা তো অস্বীকার করা যাবে না।
তবে তো ওইসব হীরক খন্ড ছেলে-মেয়েদের আমাদের ডিজিটাল সুদূর প্রসারে কাজে লাগানো যেতেই পারে। যে শক্তির কাছে নতি স্বীকার করি যে শক্তি আমাদের শক্তির চেয়ে বড় সে শক্তিকে উড়িয়ে দিচ্ছি কেন? যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে তা যে এ দিয়ে অনেক অনেক অর্থ উপার্জন করছে তাও কিন্তু এখন সম্ভব না। সম্ভব হলে যারা প্রশ্নপত্র পাচ্ছে প্রশ্নটি শুধু তাদের হাতেই থাকতো। যেহেতু তাদের হাতে না থেকে তা ক্ষণিকে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে অনুমান করা যায় এর অর্থমূল্য কম। যারা এ কাজটি করছে, কেন জানি মনে হয় তারা একটি খেলা খেলছে। তারা পুরো ব্যবস্থাপনাকে চ্যালেঞ্জ করে ঘোষণা দিচ্ছে তারা কী পারে, কতটুকু তাদের শক্তি। তারা হয় জানে, তাদের কেউ কিছু করতে পারবে না, নতুবা তারা জানে, তাদের টিকিটি স্পর্শ করা সম্ভব নয়।
আবার এ সন্দেহও লোকমুখে প্রচলিত আছে সরিষার ভেতরে ভূতের আগড়া। বড় ক্ষেতের ভেতর থেকে হয়তো সেই ভূতের বাসা কিংবা ভূতটিকে বের করা কঠিন। কিন্তু আসলে কি ভূত বের করা কঠিন? আমরা সময়ের পরিক্রমায় কম ভূত দেখলাম না, কোন ভূত কি শেষ পর্যন্ত অধরা ছিল? সময়কে ফাঁকি দিয়ে এসব মানুষেরা ভূতের বেশে যা’ই করুন না কেন কাল পেরুলেই দেখা মেলে এদের। ততদিনে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়, অনেক এগিয়ে যাবার বদলে অনেক পিছিয়ে যাই আমরা, তবে ভূতটি কিন্তু বের হয়ে আসেই। যদি ক্ষেতের ভিতরেই লুকিয়ে থাকে পোকা সে পোকাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব ক্ষেতের পাহারাদারের। সে ক্ষেতের বরগাদারদের। বরগাদার যদি না পারেন, পাহারাদার যদি সঠিক পরিচর্যা করতে না পারেন, কাজে অবহেলা করেন আর সে ফলশ্রুতিতে ক্ষেতেটিকে কেটে পুকুর বানানো উচিত না পাহারাদার পরিবর্তন করা উচিত? যে বরগাদার ফসল ফলাতে গিয়ে ক্ষেতের ক্ষতি করেন তার কাছে জমি বরগা দেয়া কতটুকু সমীচীন তা জমির মালিকই জানেন ভালো। আমরা শুধু এ জানি, পাহারাদার পাল্টানো মালিকের পক্ষে সচেতনতার প্রতীক। পাহারাদার বদলানো কোন ভাবেই ইগোগত ভাবে বা শত্রুভাবাপন্নতায় ভাবার কোন যৌক্তিকতা নেই। পাহারাদার বড় না জমি বড় তা ভাববার প্রযোজন আগে। কোন পাহারাদারের পক্ষে সম্পদ রক্ষা করতে না পারাটা অতিসচেতনতা, অবহেলা নাকি অন্য কোথাও কোন জটিলতা তা নিশ্চিত হবার জন্যও তো পাহারাদার স্থায়ী বা সাময়িক বদলিয়ে নিরিক্ষা চালানো যেতে পারে। সাধারণের সাধারণ মতের চেয়ে অসাধারণ যারা রয়েছেন তারা অবশ্যই বিষয়টি বুঝবেন ও দেখবেন।
আমরা যারা দর্শক। যারা বাহির থেকে দেখি তাদের কাছে অনেক সময়ই অনেক কিছু মিলতে চায় না। মিলতে চায়না বলেই আমরা মিল খুঁজি, মিলানোর আহ্বান করি। অমিলের খুঁতগুলো চোখে পড়লে বলার চেষ্টা চালাই। প্রশ্নপত্র ফাঁস বিষয় সিরিয়াস বিষয় থেকে অনেকটা হাসির খোরাক হয়ে গেছে নানান উক্তি, বক্তব্য, ছেলেমানুষি ,অপ্রাসঙ্গিক কথা, অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা, রানাপ্লাজার খাম্বা ধাক্কানোর মতো অবুঝ বর্ণনায়। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আমরা এমন বলতে শুনেছি, শুনছি যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব না। তারা প্রযুক্তির সহজতার দোহাই দিচ্ছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই যারা বা যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এসব কথা বলছেন তারা কেউ’ই তথ্যপ্রযুক্তি বা ডিজিটাল অথবা কম্পিউটার টেকনোলজিস্ট নন। তারা যে কোন টেকনোলজিস্টের রেফারেন্সের ভিত্তিতে তা বলছেন তাও তাদের বক্তব্যে প্রমান পাই না। (মিডিয়ায় উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কয়েকদিনের বক্তব্য শুনতে পারেন কেউ)। আর এরকম যদি বলেন তাতে আমাদের প্রযুক্তির উন্নয়নকে কি অস্বীকার করা হচ্ছে না? যারা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য, যারা দেশে বিদেশে নাম করছেন প্রযুক্তিতে তাদেরকে কি খাট করা হচ্ছে না?
যখন পৃথিবীতে ‘‘কোন কিছু অসম্ভব নয়’’ এমন ধারণা চলছে তখন আমাদের শ্রদ্ধেয় ও নির্ভরশীল ব্যক্তিরা কেমন করে বলেন এমন কথা? বলাটা যার যার কাছে। আমাদের মনে হয় কথায় যথেষ্ট ফাঁক আছে পূরণ করার মতো। সে দায়িত্ব আমাদের না। যারা দৃশ্যে অদৃশ্যে আছেন তারা তা পূরণ করবেন- প্রত্যাশা। শুধু আমাদের কাছে মনে হচ্ছে কোথায় যেন একটা অনিয়ম আছে, কোথায় যেন একটা ব্যত্যয় আছে, কোথায় যেন মনে হচ্ছে গতি থামানোর জন্য বাহির থেকে বাঁধ দেয়া হচ্ছে কাদামটি দিয়ে। বানের পানি যখন আসতে থাকে তখন যেখানে ভিতর থেকে বাঁধ দিয়ে সে বান ঠেকানো কঠিন সেখানে বাহির থেকে বাঁধ দেয়ার চেষ্টাকে ঠুনকো লাগছে বড়। তাই যদি না হয় আমরা তো বলতেই পারি, ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক পিয়ন কম্পিউটার দোকানদার ফেসবুকার ছাড়া কোন বিশেষ ক্লু’ব্যক্তি কি ধরা পড়েছে? যে ছাত্র-ছাত্রীদের বহিস্কারসহ আটক করা হয়েছে তারা কোথায় পেল প্রশ্ন, কারা দিলো, এর উৎস কী তা পাওয়া গেছে? বলা হচ্ছে শেকড় অনেক দূরে, সে দূর কত দূরে? কথায় বলে বাংলাদেশের পুলিশ-গোয়েন্দারা বের করতে পারে না এমন কোন গোপনীয়তা নেই। এ কথাটি বাংলাদেশের সরল মানুষ শতভাগ বিশ্বাস করে। এ বিশ্বাস যদি থাকে মানুষের তবে কতজনকে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলো? পথে চলতে গেলে মানুষের মুখে শোনা যায়, ‘‘সরকার যদি একজন প্রশ্নফাঁসকারীকে দ্রুত উচিত শিক্ষা দেয় অথবা দৃষ্টান্তমূলক বিচার করে তাহলে কয়েকদিনেই এই প্রশ্নফাঁস কমে যাবে।’’
জানি না, চলার পথে শোনা এ ধারণা কতটা সঠিক। ঠিক বা বেঠিক যা’ই হোক, এরকম দৃষ্টান্ত দেখলে আমরাও মনকে শান্তনা দিতে পারতাম। তা না হয়ে শান্তনার পরিবর্তে হতাশ হচ্ছি অধিক গত কয়েকদিনে তাদের ‘সম্ভব না, সম্ভব না’ বক্তব্য শুনে। বাহিরে নয়- হাঁক-ডাক, প্রেস বক্তব্যের পরিবর্তে ঘরের ভিতর দিকে বাঁধ দেয়ার চেষ্টা করাটাই উত্তম বলে মনে হয়। কোন মানুষ যখন নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে কাজের দায়িত্ব অন্য কারো কাছে হস্তান্তর না করে তখন বুঝাই যায় সে মানুষ নিজেকে শুদ্ধ প্রমান করার জন্য বহু বায়না কাটছেন, পদে পড়ে থাকার জন্য আক্রে থাকছেন, মাথা ব্যথা থামানোর জন্য মাথা কেটে ফেলছেন। ভুলে গেলে হবে না, দিক পরিবর্তন করে ঝড়ের তোড় আটকানো যায় না, ঝড়কে আটকাতে হলে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হয় যুদ্ধাংদেহী রূপে। এ ডাল থেকে ওডালে গিয়ে ঘুণে খাওয়া থামানো যায় না, গাছ বাঁচাতে চাইলে ঘুণটাকে মারতে হয় সবার আগে। এ বুদ্ধি নিশ্চয় আমাদের চেয়ে তাদের ক্ষুদ্র নয় যারা বৃহৎ কর্মে নিয়োজিত।
যে যেখানেই নিয়োজিত থাকুক সে সেখানে থেকেই তার নিজের কাজটি সৎ ও সুন্দর ভাবে লালন করবেন সেটা ভাবাই স্বাভাবিক। তার ব্যত্যয় ঘটলে হতাশা জাগে। নিরাশ হয়ে পড়তে হয়। অসৎ সে শিক্ষক হোক, ছাত্র হোক, সন্ত্রসী হোক, অভিভাবক হোক সে ঘৃণ্য সবসময়। যে সরষের ভূত অকাজ করছেন সে ভূত যেমন ঘৃণা ও শাস্তি পাবার যোগ্য, যে শিক্ষক অনৈতিকতার আশ্রয় নিয়ে ছাত্রদের বেশি নম্বর পাওয়ানোর বা গোপনে অর্থজল পাবার চেষ্টায় নীরবে মগ্ন, যে ছাত্র-ছাত্রী একটি প্রশ্নের উত্তর বেশি দেওয়ার আশায় প্রশ্নফাঁসের অপেক্ষায়, যে অভিভাবক রাত জেগে নেটের সামনে, এফবিতে একচোখে রত তারা প্রত্যেকেই অপরাধী, তারা প্রত্যেকেই সাজা পাবার মত দোষী।
দোষ করতে করতে আমাদের মানসিকতা এমন এক পর্যায়ে নেমে এসেছে যে মাথায় বারি না পড়া পর্যন্ত, হেনস্থা না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে দোষী, অপরাধী, হীন ভাবছি না। আমাদের মানসিকতা ছোট হতে হতে এতটা ছোট হয়েছে যে, চোখের আড়ালে নীচে নামতে আজ আমরা দ্বিধা করি না। মনে করি, কেউ তো দেখছে না। আদতে তা যে পাপ তা আমরা মাথায় নেই না। বোধের মধ্যেই জাগাই না। এ এক অসুস্থ প্রতিযোগীতা চলছে ঘরে বাহিরে সব জায়গায়। যে যাই বলুক, নম্বর পাবার যে প্রতিযোগীতা অনেক দিন আগ থেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নিজেদের অযোগ্যতা আর ভুল চালের কারণে চালু করা হয়েছে তারই খেশারত হয়তো এখন এসে আমরা দিচ্ছি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যে মাত্রই জটিল কুটিল করে তোলা হচ্ছিল সে মাত্রই এ নিয়ে রব আর সরবতা কম হয়নি। তখন আমরা দেখেছি নানান দিক থেকে নানান কথা উঠেছিল কিন্তু সে কথা কেউ কানেই তোলেন নি। আর না তোলার ফলই আজকের শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রশ্নপত্র ফাঁস।
আর এ প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়েও যখন কথা হচ্ছিল, রোধ করার অনুরোধ বারবার করা হচ্ছিল তখন একপক্ষ থেকে বারবার তা অস্বীকার করা হচ্ছিল। পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করা হচ্ছিল। দুর্বল ভাবে ভাবা হচ্ছিল। অবহেলা করা হচ্ছিল। সেই অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের কঠিন ফল আজ আমরা দেখছি। দেখছি, তারপরও কেউ বলছেন না, এ দায় আমাদের, এ দায় আমাদের ব্যর্থতার। কেউ বলছেন না, ঠিক আছে আমাকে দিয়ে হচ্ছে নাঅপর কাউকে দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে দেখা হোক। বাংলাদেশে হয়তো এমনটি কল্পনা মাত্র। আমাদের মানসিকতায়ও নেমে এসেছে কৃষ্ণপক্ষ। নম্বর বেশি পাওয়ার অসুস্থ যুদ্ধে আমরাও সামিল হয়েছি। একটি প্রশ্নের জন্য দিককে রাত, রাতকে দিন বানিয়ে ফেলছি। কিন্তু যারা নকলের আশায়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশায় তারা কি আসলে ভালো রেজাল্ট করছে? মনে হয় না। অযোগ্যরাই নকলের অপেক্ষায় থাকে, অযোগ্যরাই সে প্রশ্ন খুঁজে বেরায়। একটির জায়গায় হয়তো তারা দুইটি প্রশ্নের উত্তর করতে পারে কিন্তু সবগুলো প্রশ্ন তারা পারেন। অভিভাবকদের জন্য একটি কথা বলা যায়, দশটি প্রশ্নের উত্তর করেও ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব নয়, সাত-াটটি প্রশ্নের উত্তর করেও সুন্দর ফলাফল করা সম্ভব। ভালো রেজাল্ট আর মেধার ফলন অন্য কোথাও।
ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে পাশ করা সম্ভব, মনে রাখবেন সে পাশ দিয়ে কোন কাজই হবে না যদি-না আপনার আমার সন্তানকে আমরা সততা আর সত্যতা শেখাতে না পারি। পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখুন- পাশ করা শিক্ষায় কোন কিছু হয় না। মেধার বিকাশ ঘটান তাতেই সন্তানের ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে। মিছে একটি প্রশ্নের পিছু না ছুটে, নিজের এবং সন্তানের মানসিকতা বিনাশ না করে বরং সন্তানকে বইয়ের দিকে, শিক্ষার দিকে ফেরানোর অধ্যবসায় করুন। যারা শিক্ষাব্যবস্থার দায় এবং দায়িত্ত্বে আছেন তারাও নিজের স্থান অবস্থান, পদ-পদবির দিকে না তাকিয়ে, কোটি কোটি ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে তাকান। চাপার জোড় আর ধমকি-হামকির বদলে দেশের দিকে তাকান। আপনাদের সন্তানেরা বিভুঁয়ে হট-ডগ খাচ্ছে বলে দরিদ্র এ দেশের লাখ লাখ ছেলে-মেয়ের স্বপ্নকে মন থেকে দুরে ঠেলে দিবেন না। এদেশটি আপনাও। সবমিলে আমি ও আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আজ খুব বড় বিষয়। মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে না পারলে প্রত্যক্ষে আমরা জিতে গেলেও পরোক্ষে পরাজয়ের অতলে মিশে যাবো, যার ফল আজ নয়, কাল নয়, অদূর ভবিষ্যতে কাল হয়ে আমাদেরকে এমন ছোবল দিবে যে, বিষে নীল হয়ে মরা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না।
কিছু করার না থাকলেও আমরা তো আমাদের সন্তানদের ফেলে দিতে পারবো না। পচা আম, পচা কাঁঠাল, পচা লিচু, পচা কামরাঙ্গা ফেলে দেয়া যায়, সন্তান নষ্ট হয়ে গেলে, পথ হারালে তাকে কী ফেলে দেয়া যায়? নিগূঢ় অন্ধকারময় এক জগৎ তৈরি হয় তখন। না মরা যায়, না বেঁচে থাকা যায়। দূরহ এক সময় বহন করতে হয় অভিভাবকদের। অভিভাবকরা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিশ্চয় চায় না আগামী প্রজন্ম যারা রাষ্ট্র সমাজ সংসারে নেতৃত্ব দেবে তারা পোকায় খাওয়া ফলে পরিণত হোক। শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চয় চায় না আজকের শিক্ষার্থীরা কেবল কাগজে কলমে শিক্ষিত হোক। শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চয় চায় না রঙিন প্যাকেটে মোড়িয়ে থাকুক রাড়ন্ত মেধা। যে অবস্থার ভেতর দিয়ে সময় চলছে অগোছালোভাবে তাতে শিক্ষার্থীরা কী শিখছে সে প্রশ্নের অন্ত নেই। যে অরাজকতার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেন তাতে বগি ভর্তি হচ্ছে পুস্তকে, সার্টিফিকিটে। মেধা মননের ঘর থাকছে ফাঁকা। ফাঁপানো, ফুঁলানো। তৈরি হচ্ছে মেধা শূন্য এক কারখানা। শক্তি আর দম্ভের নীতি- নির্ধারণ করছে দশদিক। চলমান সময়ের দিকে কাতালে, গভীরে ডুব দিলে মুখোশের আদল ধরা পড়ে হাতের আঙুলে।
আর ভবিষ্যৎ তো পড়েই রইল। শিক্ষা ব্যবস্থায় এই অসুস্থ্য প্রতিযোগীতা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, অধিক নম্বর, পাশের হার বাড়ানোর রেওয়াজ, অস্বীকারের রীতি আমাদের শিক্ষার্থীদের কী শেখাবে আর তারা কী নিয়ে সামনের দিনে যাবে তা ভাবতে গেলে ভাবনার গাঢ় অন্ধকার ধীরে ধীরে ঘীরে ধরে। চাতুর্যের চাকচিক্য আজ আমাদের যেন গিলে খাচ্ছে। আমরাও যেন সাঁঝের আলোয় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি নির্দ্বিধায়। এক গোছায় কয়েকটি ফল নষ্ট পচা থাকতেই পারে। থাকে। থাকবেও। তাই বলে কি সে নষ্টের অধিকারে সবাইকে যেতে হবে? আর নষ্টের যদি নামও থাকে তাতেই কি নিজেও নষ্ট হতে হবে? যা নষ্ট তা তো নষ্টই। নষ্টের ভবিষ্যৎ কোনদিনও সুখোকর, সুন্দর হয় না। যারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের পিছু ছুটছেন, যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করছেন তারা একবার ভাবুন তো, কী লাভ হচ্ছে তাতে! অধিক কিছু কি মুনাফা হচ্ছে আসলে? আসলে যা হচ্ছে তা হলো, আগামী প্রজন্মের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ও অভিভাবকদের বলতে চাই, নিজেকে ও সন্তানকে বেশি নম্বরের চেতনায় বড় না করে মেধায় বড় করুন, না হলে ভবিষ্যতে আপনাকেই পুরতে হবে আপন অনলে। সে অনল থেকে তখন আর কেউ শান্তি ফাঁস করে আপনাকে সাহায্য করবে না।
রাষ্ট্রযন্ত্র আর শিক্ষা ব্যবস্থাকে বলতে চাই, যে শিক্ষায় প্রজন্মকে শিক্ষিত করছেন তার ফল একদিন আপনাদেরও ভোগ করতে হবে। মননহীন জাতি তৈরি হলে সে দায় থেকে রক্ষা পাবে না কেউই। এককেন্দ্রিক চিন্তা আর লোভ থেকে বের হয়ে আসুন যারা লোভের লালায় সাঁতার কাটছেন। নিজে বড় বা বেশি নম্বর পাবার মানসিকতা থেকে মুক্তি না নিলে অদূর দিনে পা ফঁসকালে উদ্ধারের পথ পাওয়া হবে মুশকিল। সে অবস্থায় পড়ার আগেই আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো উচিত। এখন এ-সময়ে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এ রীতি নীতি অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ভঙ্গুর ভবিষ্যৎ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)