প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েও এ বিষয়ে সকলেই অবহিত রয়েছেন। জাতীয় সংসদ ভবনে শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যদের বিষেদাগার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগকেই প্রমাণ করে থাকে। পাশাপাশি সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পূর্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন সেটের প্রশ্ন পাওয়া যায়। অনেকগুলো সেটের মধ্যে কোনটা হুবহু আসে তা সঠিক করে বলা না গেলেই ফাঁসকৃত প্রশ্নের মধ্য হতেই পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে। কয়েকদিন আগে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণ পূর্বে প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস হয়। অর্থাৎ শুনতে তিক্ত হলেও এটাই সত্যি যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় এবং হচ্ছে।
পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি সরকারি চাকুরি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস এখন হরহামেশাই হচ্ছে। যা আমাদের বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত ঘৃণিত এবং গর্হিত অভিশাপের ন্যায় পরিণত হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ফলে আমাদের মানবসম্পদ ধ্বংসের মুখে অবস্থান করছে। প্রশ্নফাঁসের কারণে ভাল-মন্দের পার্থক্যকরণ অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে। এর ফলে যেমন অনেক অযোগ্য ছেলেমেয়ে গোল্ডেন এ প্লাস পাচ্ছে আবার ঠিক তেমনি অনেক অযোগ্যরা ভাল চাকুরিতে পদায়ন পাচ্ছেন। বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত মেধাবীরা। কাজেই, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং এর সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে যেন ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ভয়াবহ ন্যাক্কারজনক কাজের সাথে জড়িত না হয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে কারা জড়িত? সরকারের যেহেতু প্রশ্নফাঁস ইস্যুটি প্রেস্টিজ ইস্যু, তাই সরকার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী ফলাফল পাচ্ছে না, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্নজনকে গ্রেফতার করা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু প্রশ্নফাঁস রদকরণ কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে একটি চক্র তথা সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের মূলোৎপাটন ব্যতীত প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা কখনোই সম্ভবপর হবে না। আমার মাঝে মধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, এই সিন্ডিকেটের সাথে অভিভাবকরা জড়িত নয় তো? এমন কোন অভিভাবক কি সৎ সাহস রেখে বলতে পারবেন যে, আপনি কিংবা আপনারা প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত নয় কিংবা প্রশ্নফাঁসের ব্যাপারে পরোক্ষভাবে হলেও জড়িত নয়? কোচিং সেন্টারের শিক্ষক অথবা বাসার টিউটরকে প্রায় সকল অভিভাবক পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্নের কথা বলে থাকেন। আবার অনেকেই এও বলে থাকেন, সবাই প্রশ্ন পেলে আমি কেন এর বাইরে থাকবো? বিষয়টা এমন, সবাই চুরি করবে দেখে আমিও চুরি করবো। কেন, আমি কি ভাল থাকতে পারি না ? আমার সন্তানকে চুরি বিদ্যা থেকে দূরে রাখতে পারি না। অবশ্যই পারি, যদি আমাদের সুচিন্তা এবং সৎ মানসিকতা থাকে। প্রশ্নফাঁস করে পরীক্ষায় এ প্লাস পাওয়ার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব সেখানেই যেখানে পরীক্ষার মত পরীক্ষা দিয়ে পাশ করা হয়। পরীক্ষার মত পরীক্ষা বলতে নির্ভেজাল পরীক্ষা পদ্ধতিকে বুঝানো হয়েছে। যেখানে ছাত্র কখনো কল্পনাই করতে পারবে না, প্রশ্ন ফাঁস হয় কিংবা হচ্ছে। শিক্ষকদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের ব্যবস্থা হবে যথাযথ। কেবল পাশ করানোর জন্যই খাতা দেখা এ ধরনের চিন্তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংস্কৃতির ফলে কি হচ্ছে? দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। ছেলেমেয়েরা জ্ঞানার্জনের চিন্তা চেতনা বাদ দিয়ে প্রশ্নফাঁসের ধান্দায় থাকে। পরীক্ষার পূর্বের রাতে পড়াশোনা বাদ দিয়ে মেসেঞ্জারে কখন প্রশ্ন আসবে সেই চিন্তায় বিভোর থাকে।টেনশনে অনেক সময় ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা হয় না। পরের দিন পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্নফাঁস ছাড়া ঐ ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে কি ভালভাবে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব! শুধু কি ছাত্রছাত্রীরা পাশাপাশি অভিভাবকেরা এ ধরনের নিকৃষ্ট কাজে ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করতে কুন্ঠাবোধ করেন না। কোচিং সেন্টারের শিক্ষক, বাসার টিউটর কিংবা কলিগদের সাথে যোগাযোগ করতে দ্বিধা করেন না অভিভাবকেরা।
এককথায় বলা যায় অভিভাবকদের ইন্ধনে ছেলেমেয়েরা প্রশ্নফাঁসের মতো অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। আবার এও দেখা যাচ্ছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করেই ক্ষান্ত হয়ে বসে থাকছে না অভিভাবকেরা। পরীক্ষার কেন্দ্রেও নকল সরবরাহ করার সময়ে কয়েকজন অভিভাবককে কয়েকদিন পূর্বে গ্রেফতার হতে দেখা গিয়েছে। এ সব আলামত আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ধ্বংস করার পায়তারাস্বরূপ। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে প্রশ্নফাঁসের বিরুদ্ধে।
প্রশ্নপত্রফাঁসের সাথে দেশবিরোধী চক্র জড়িয়ে পড়েছে। কারণ, একটি দেশকে যদি ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাতে হয় তাহলে প্রথমেই ঐ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চক্রান্ত করে থাকে দেশবিরোধীরা। তাছাড়া, আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রশ্নফাঁসের সংস্কৃতির উপর ভরসা রেখে সারাবছর পড়াশোনা না করে প্রশ্ন ফাঁসের পায়তারা করে থাকে এবং সেটি কিন্তু হচ্ছে। একটি কথা আমাদের স্মরণে রাখা উচিত এই ছেলেমেয়েরা একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আমাদের দেশের নেতৃত্ব দিবে। যে ছেলেটি কিংবা মেয়েটি প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িয়ে পড়ছে তার কাছ থেকে ভবিষ্যতে দেশ কি পেতে পারে! একবার অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে সকলেই এ বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের অহংকার, তাদের সাফল্যেই আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে। তাদের জীবনযাত্রার শুরুতেই আমরা যদি তাদেরকে প্রশ্নফাঁসের মতো গর্হিত কাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই তাহলে তাদের মজ্জায় এ বিষয়টি স্থির হয়ে যাবে। যার ফলশ্রুতিতে সব জায়গায় সে ছলচাতুরি করার আশ্রয় নিবে কিংবা খুঁজবে। কাজেই এ ধরনের বিশ্রী সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া উচিত। যাতে করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মানুষের মত মানুষ হতে পারে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মানচিত্রকে সম্মানের সহিত তুলে ধরতে পারে। তাই প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে সকল এজেন্টকে (সরকার সহ মিডিয়া, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অভিভাবক, শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রী) একযোগে কাজ করতে হবে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বার্থেই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)