২০০৩ সালে লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখক মনিকা আলি তার উপন্যাস ‘ব্রিক লেন’ লেখার পরে বাংলাদেশি, বিশেষ করে সিলেটের জনগণ বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। মনিকার বিরুদ্ধে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো সিলেটিরা। তাকে যেন বাংলাদেশে আসতে দেয়া না হয়, সেজন্য সভা সমাবেশও করা হয়। অনেক উগ্র হুঁশিয়ারি দিয়েছিল উগ্রপন্থী কিছু অন্ধ জনগোষ্ঠী। তার অপরাধ, তিনি তার উপন্যাস ‘ব্রিক লেন’ এ বাংলাদেশকে ছোট করেছেন (এটা উত্তেজিতদের অভিযোগ)!
এ প্রসঙ্গে একটি হাস্যকর ঘটনা হচ্ছে, মনিকা ‘ব্রিক লেন’ লিখেছিলেন ইংরেজি ভাষায়, যার বাংলা অনুবাদ নেই। কিন্তু এক সমাবেশে সিলেটের একটি ইউনিয়নের জনৈক চেয়ারম্যান মনিকার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, মনিকা বাংলাদেশকে ছোট করে লিখেছেন। তিনি বাংলাদেশকে বিতর্কিত করেছেন। তাকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া হবে না। সে এখানে আসার চেষ্টা করলে তাকে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত পাঠানো হবে। সে বাঙালি নামের কলঙ্ক’। এমন আরো অনেক কিছু বলেছিলেন তিনি।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সেই চেয়ারম্যান বইটি পড়েননি। আসলে পড়েননি তা নয়, তার পক্ষে মনিকা আলির ‘ব্রিক লেন’ পড়া সম্ভবও নয়। কেননা, চেয়ারম্যান ছিলেন অনেকটা অক্ষরজ্ঞাণহীণ। তবুও তিনি মনিকা বিরোধী! সাংবাদিকরা বিষয়টি বুঝতে পেরে তার কাছে জানতে চাইলেন, বইটি পড়েছিলেন কিনা? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, নাহ, শুনেছি তিনি (মনিকা) বাংলাদেশকে ছোট করে বই লিখছেন’!
আমাদের সমাজে এমন অক্ষরজ্ঞাণহীণ মানুষের অভাব নেই। আবার অক্ষর জ্ঞানযুক্ত মানুষও আছেন, যারা কেবল শোনার উপরই বিশ্বাস করেন। এই সংখ্যার লোক আমাদের সমাজে নেহাত কমন নয়। এ জাতিয় মানুষদেরকে অন্ধ বলা যায়। এরা যুক্তিতে বিশ্বাসী না। কোনো কিছুর বিচার বিশ্লেষণ করবে না। মূলত এরা কানের গোঁড়ায় হাত না দিয়ে চিলের পিছনে দৌঁড়াতেই পছন্দ করে। সম্প্রতি এই শ্রেণিটা দৌঁড়াচ্ছেন প্রধান বিচারপতির পিছনে।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অপসারণ দাবি করছেন অনেকেই। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটও একই দাবিতে সোচ্চার, কালো পতাকা মিছিলও করেছে। তাদের দাবি, সিনহা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সাথে তুলনা করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করেছেন, নিজেই বলেছেন তিনি শান্তি কমিটির লোক ছিলেন! এখানেও ওই সিলেটি চেয়ারম্যানের মতো হয়তো বেশিরভাগই প্রায় ৮০০ পাতার ইংরেজি রায় পড়েননি, অনেকেই হয়তো রায়ের পর্যবেক্ষণে পড়েননি।
সম্প্রতি ষোড়শ সংশোধনীর রায়কে কেন্দ্র করে আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন! বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলছেন, ‘প্রধান বিচারপতি নিজে বলেছেন তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। সুতরাং তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে থেকে পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছেন’। তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে ‘আমি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলাম’ এমন কথা প্রধান বিচারপতি বলেছেন তার কোনো তথ্য প্রমাণও কেউ উত্থাপন করতে পারে নি।
তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মামলায় প্রসঙ্গ এসেছি, কেন কিছু সংখ্যক মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার করা হচ্ছে, কেন সব অপরাধী, রাজাকারদের বিচার হবে না…। যখন এমন উঠেছিল, তখন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র সিনহা বলেছিলেন ‘ধরেন, আমি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলাম। কিন্তু জ্বালাও-পোড়ায়ে, খুন-ধর্ষণ করিনি। এখন এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ আর এই অপরাধ কি এক হবে…?’ এখানে প্রধান বিচারপতির বলা ‘ধরেন’ শব্দটাকে উহ্য রেখে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলছেন, ‘তিনি (প্রধান বিচারপতি) নিজে বলেছেন তিনি ‘শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন’। ব্যাপারটা একেবারেই বিকৃত। আর এই অংশটা ধরে অনেকেই চেঁচাচ্ছেন।
শুধ তাই নয়, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তিনি বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করেছেন, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করেছেন! যা আদতে সত্য নয়। আর সেটি ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণ পড়লেই স্পষ্ট হওয়া যায়।
প্রধান বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘No nation – no country is made of or by one person. If we want to truly live up to the dream of Sonar Bangla as advocated by our father of the nation, we must keep ourselves free from this suicidal ambition and addiction of ‘I’ness. That only one person or one man did all this and etc.’
যার বাংলা করলে দাঁড়াচ্ছে, ‘কোনো জাতি বা দেশ কোনো এক ব্যক্তিকে দিয়ে গড়ে ওঠে না, কিংবা কোনো একজন দ্বারা তা গঠিতও হয় না। আমরা যদি সত্যিই জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলায় বাঁচতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে আমিত্বের আসক্তি এবং এই আত্মঘাতি প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে হবে।’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি এই কথার মাধ্যমে কোথায়, কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করলেন?
কেউ কেউ বলেছেন রায়ে বঙ্গবন্ধুর নাম একবারও উল্লেখ করা হয়নি! যা একদমই ভুল ব্যাখ্যা। বরং পুরো রায়ে অন্তত তিনবার তিনটি স্থানে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ইংরেজিতে লেখা ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ের ৩০, ৫৪ ও ২০০ পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবেই বঙ্গবন্ধুকে ‘ ফাদার অব দ্য নেশন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, রায়ে তাও লেখা হয়েছে। তাহলে কোথায়, কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করেছেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা, সেটা কেউই স্পষ্ট করে তুলে না ধরেই হই চই শুরু করেছে! ভুলে গেলে চলবে না, বিচারপতি সিনহা ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় দেয়া বেঞ্চের অন্যতম সদস্য। কয়েক যুগ ধরে যখন বিভিন্ন বিচারপতি বিব্রত হয়েছেন ওই আলোচিত মামলায়, সেখানে তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।
এছাড়া প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে তিনি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সাথে তুলনা করেছেন! এ নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি তার এমপি মন্ত্রীরাও এ প্রসঙ্গ টেনে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছেন। একটি দেশের প্রধান বিচারপতি, আদালতের রায় নিয়ে সরকার দলীয়রা যেভাবে বলছেন, এটা সহজ বাঙলায় আদালত অবমাননার শামিল।
তবে সে যাহোক, প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানের রেফারেন্স কেন টেনেছিলেন? এর কিছুটা স্বচ্ছতা পাওয়া গেছে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের বক্তব্যে। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, “উনি (প্রধান বিচারপতি) বললেন, ‘আমরা কি উত্তপ্ত করছি, আপনারাই তো উত্তপ্ত করছেন, পাকিস্তানে রায়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী চলে গেলেন। আমাকে নানা রকম এজেন্সি থেকে ফোন দেওয়া হচ্ছে। অনেক মিডিয়ায় এসেছে আমি প্রধানমন্ত্রীকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারব। এটা ঠিক না।”
এই কথা দ্বারা প্রধান বিচারপতি খারাপ কী এমন বলেছেন? পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা তিনি কীভাবে করলেন? ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে তিনি কতটা চাপের মধ্যে ছিলেন সেটা কিন্তু এখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারপরও তিনি যে ধৈর্য ধরেছেন এবং এখনও ধৈর্য রাখছেন, সেটা কিন্তু অনেক বড় একটা বিষয়। তবে ক্ষমতাসীনরা অত্যন্ত ছোট মনমানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন তাকে সংখ্যালঘু, মণিপুরী, মৌলভিবাজারের উকিল, শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে কটাক্ষ করে। যা একেবারেই অভব্য আচরণ।
বিশেষ করে সংখ্যালঘু, উপজাতি হিসেবে অখ্যায়িত করে একটা জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। অথচ এই দেশে সবার অধিকার সমান। মুজিবনগর সরকারের ইতিহাস কিন্তু তাই বলে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাঙলার অর্থই হচ্ছে এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে। তাহলে কী একজন মানুষকে সংখ্যালঘু, উপজাতি বলে কটাক্ষ করার অপরনাম মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা হচ্ছে না? আশাকরি সবাই বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হবেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)