চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

প্রধানমন্ত্রী কতদিন একা সব সামলাবেন?

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ থাকায় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মন্ত্রিপরিষদকে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি মন্ত্রণালয়কে দায়মুক্ত করতে কী অবলীলায় জনগণের ঘাড়েই দায় চাপিয়ে দিলেন!

অথচ বিদেশে কী ঘটে? জাপানের কিউসু শহরের রেল লাইনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ওপর দিয়ে একটি শামুক পোকা চলতে গেলে শর্টসার্কিট হয়ে পোকাটির মৃত্যু হয়, ২৬টি ট্রেন চলাচল বন্ধ করা হল শর্ট সার্কিট হলো কেন সেটা বুঝতে৷

কুলাউড়ার রেল লাইনের নাটবল্টু ঢিলা ছিল, না কি নদীটি ব্রিজটির ওজন নিতে পারে নাই, নাকি চালক জোরে চালিয়েছেন, নাকি রেলের স্লিপার আনফিট ছিল এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চেষ্টা না করে মন্ত্রী বললেন অতিরিক্ত যাত্রী বহনই দুর্ঘটনার কারণ৷ সরকারি তদন্ত কমিটিও কি মন্ত্রীর বক্তব্যে সহমত হচ্ছেন? উপবন এক্সপ্রেসের বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় রেলমন্ত্রীর কি কোনো দায় নেই?

সংগত কারণেই আরও একটি প্রশ্ন জাগে অতিরিক্ত যাত্রী বহন দূর্ঘটনার দায় হলে রেলে লোকসানের দায় কার? রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ীই বছরে তাদের লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।  এ লোকসান মূলত নিজেদের পরিচালিত ট্রেনেই হচ্ছে। অন্যদিকে ইজারার ভিত্তিতে বেসরকারিভাবে পরিচালিত ট্রেন থেকে লাভ করছে রেলওয়ে। ইজারা দেওয়া ট্রেন হতে বছরে লাভ হচ্ছে ১৫ কোটি টাকা।  রেলওয়ে পরিচালিত ট্রেনে এই লোকসানের অন্যতম কারণ দুর্নীতি নয় কি?

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্র মতে, রেল বিভাগের দুটি অঞ্চলের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চল, রাজশাহীর আওতায় মোট ১৪২টি ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে আন্ত:নগর ট্রেন রয়েছে ৪৮টি, মেইল ট্রেন ৪৬টি, বিরতিহীন দুটি, আন্তর্জাতিক মৈত্রী এক্সপ্রেস চারটি ও লোকাল ট্রেন রয়েছে ৪২টি। এই ১৪২টি ট্রেনের মধ্যে রেলওয়ের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে ১০৮টি।

আর ইজারার ভিত্তিতে বেসরকারিভাবে পরিচালিত হচ্ছে ৩৪টি। যেগুলো ইজারা দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই লোকাল ও মেইল ট্রেন। মেইল ও লোকাল ট্রেনের যাত্রীরা টিকিট কাটতে চায় না বলে এগুলো লিজ দেওয়া হয়েছে। লিজে লাভবান কিন্তু নিজ দায়িত্বে পরিচালনায় কেন লোকসান?মৌলভীবাজার-সিলেট-রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক

এই লোকসানের কারণের কী ব্যাখ্যা দেবেন রেলমন্ত্রী? আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে আগাম টিকেটও পাওয়া যায় না৷ মানুষ সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে যেতেও টিকেট করছে৷ তবু কেন লোকসান? মৌলভীবাজারের ব্রিজটি অনেকদিন ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ ভাবেই চলে আসছিল৷ রেলমন্ত্রনালয়ের কি এই ঝুঁকি সারানোর কোন দায় ছিলো না? এমন ঝুঁকিপূর্ণ আরও অনেক ব্রিজের খবর বেরিয়েছে৷

সংবাদপত্রে এসেছে, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল রেলস্টেশনের কাছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা করা হয়েছিলো কয়েক মাস আগে থেকেই। ওই এলাকার রেল লাইন দীর্ঘদিন থেকে নড়বড়ে ছিলো বলে স্থানীয় এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন। রেল লাইনে ছিল না ক্লিপ। অবশেষে সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো।

২৩ জুন রাতে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি বরমচাল স্টেশনের ইসলামাবাদ এলাকার বড়ছড়া ব্রিজে লাইনচ্যুত হয়ে তার বগি খাদে পড়ে যায়। ক্লিপ ছাড়া নড়বড়ে রেললাইন নিয়ে ‘কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে’ দায়ী করে বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন প্রবাসী লুৎফর রহমান রাজু নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে কয়েকটি ছবিও দিয়েছিলেন৷ কেন তবু রেল কর্তৃপক্ষ তৎপর হলো না এই সমস্যা সমাধানে? নাকি এই সমস্যা সমাধানও প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হবে?

কারও অন্যায় বদলী,কারও ভাগ্নে অপহরণ,কারও ন্যায়বিচার না পাওয়া প্রভৃতি সমস্যার সমাধানও প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হয়৷ কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহের এক আইসক্রিম ব্যবসায়ীর সাথে প্রধানমন্ত্রীর কথোপকথন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে৷ নিখোঁজ হওয়ার ৮ দিন পরও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজীম আহমদ সোহেল তাজের ভাগ্নে সৈয়দ ইফতেখার আলম সৌরভের খোঁজ মেলেনি। তাকে জীবিত ফেরত পেতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সোহেল তাজ ও সৌরভের পরিবার।

সৌরভকে ফিরে পাওয়ার দাবীতে অনুষ্ঠিত ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন সোহেল তাজের মামাতো বোন ও সৌরভের মা সৈয়দা ইয়াসমিন আরজুমান। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নাম উল্লেখ করে চলতি বছরের ফ্রেব্রুয়ারি থেকে সৌরভকে বিভিন্ন সময় তুলে নিয়ে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ করেন। অভিযোগ সত্যি হলে কারা এই গোয়েন্দা সংস্থা? একজন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে কেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়কে নির্ভর না করে প্রধানমন্ত্রীকেই নির্ভর করতে হল?

টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে ৫ দিনের জোড় শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠান, মাদ্রাসাছাত্রদের দখল থেকে ইজতেমা মাঠ উদ্ধার ও ২০১৯ সালের ১১ থেকে ১৩ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্যও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তাবলিগের নিজামুদ্দীন মার্কাজের অনুসারীরা৷ ২৭ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই দাবি জানান।কিন্তু কেন?

তাহলে ধর্মমন্ত্রীর কাজ কী? আড়ংয়ে ন্যায্য অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তার অন্যায্য বদলিতেও প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে৷ আড়ংয়ে অভিযান পরিচালনাকারী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের কর্মকর্তাকে বন্ধের দিনে বদলি করা প্রসঙ্গে আদালত বলেছেন, বন্ধের মধ্যে বদলির এই আদেশ স্থগিতে প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। যদি সবকিছুতেই প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয় তাহলে সচিবরা কেন আছেন? তারা কি ওদের পকেটে ঢুকে গেছে?

এই অতিমাত্রায় প্রধানমন্ত্রী নির্ভরতা কি ভয়ের নয়? তবে কি সম্প্রতি রেল দুর্ঘটনার দায় প্রধানমন্ত্রীর? উনাকেই উদ্যোগ নিতে হবে চলাচল অনুপযোগী রেললাইন সংস্কারের? রেলমন্ত্রীতো অনায়াসে দায় চাপিয়ে দিল রেলযাত্রীদের ওপর৷ তবে কি আমরা এইসব যাত্রীদের বিচার দাবী করবো যারা সেদিন রেলে চড়ে এই দুর্ঘটনার কারণ হল?

পত্রিকার একটি শিরোনাম: ট্রেন উঠলেই কাঁপে সেতু, ভেঙে পড়বে যেকোনো সময়। এতে বলা হয়েছে, ঢাকা-মোহনগঞ্জ রেলপথের নেত্রকোনায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে দুটি রেলসেতু। জেলার ঠাকুরাকোনার কংশ নদীর ওপর রেলসেতুটি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেসময় মেরামত করা হয়েছিল। গত ৪০ বছরে এটি আর মেরামত করা হয়নি। এ অবস্থায় ৪০ বছর ধরে নড়বড়ে ওই সেতুর ওপর দিয়ে চলছে ট্রেন।

ফলে যেকোনো মুহূর্তে সেতু ভেঙে দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। তবে স্থানীয় রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব তাদের নয়। তবে এ দায়িত্ব কার? এটাও কি প্রধানমন্ত্রীর?

নেত্রকোনায় জোড়াতালি দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর ওপর দিয়ে চলছে ট্রেন৷ ঠাকুরাকোনা ও মোহনগঞ্জ সেতুর পিলারে ফাটল দেখা দেয়ায় যেকোনো সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। বর্তমানে রেল পারাপারের সময় সেতুগুলোতে কম্পনের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন আশপাশের লোকজন৷ ত্রুটিপূর্ণ রেলসেতুর তালিকা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷

কেন এই তালিকা প্রধানমন্ত্রীকে চাইতে হল? এ ব্যর্থতা কার? প্রধানমন্ত্রী ত্রুটিপূর্ন রেলসেতুর তালিকা জানতে চান আর রেলমন্ত্রী দুর্ঘটনার দায় ত্রুটিপূর্ণ রেলসেতুকে না দিয়ে দিচ্ছেন এর যাত্রীদেরকে? রেলমন্ত্রী কি পরিস্কারভাবে বলবেন যে মৌলভীবাজারের রেলসেতুটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল না?

নেত্রকোনার রেলসেতুতে দূর্ঘটনা ঘটলে এর দায়ও হয়ত প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে কারণ রেলমন্ত্রী নিশ্চয়ই তা এড়াবেন৷ মন্ত্রিপরিষদ সচিব রেলমন্ত্রীর কথাকেই ব্রিফ করলেন৷ কিন্তু কেন তিনি কি রেলমন্ত্রীর সচিব? জাতি কি এই দুর্ঘটনা সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদের বক্তব্য জানার অধিকার রাখে না?

প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে থাকা মন্ত্রী ও সচিবগণ কি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কোন কাজ করছেন নাকি এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নিজেদের কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করছেন? সবকিছুই যদি প্রধানমন্ত্রীকে করতে হয় তবে সচিবরা কেন আছেন? তারা কি ওদের পকেটে ঢুকে গেছে? হাইকোর্টের এই প্রশ্নের উত্তর আবশ্যক৷ সচিবরা কি প্রধানমন্ত্রীর কাজে কোন সহায়ক হচ্ছে?

নাকি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে ব্যবহার করে কেবল নিজেদের কর্তৃত্ব জাহিরেই ব্যস্ত রয়েছেন তারা? সবাই কেন জানি সকল ক্ষমতার উৎস প্রধানমন্ত্রী এটি প্রমাণেই ব্যস্ত রয়েছেন৷ কেউ কেউ এমন কথাও বলছেন যে তিনি দলের উর্ধ্বে চলে গেছেন৷

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের সিলেট-মাইজগাঁও-আখাউড়া রেললাইনের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার দুটি রেলসেতুর স্লিপারে লোহার বদলে বাঁশের ফালি লাগানো হয়েছে- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন প্রচারের প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, রেললাইনের স্লিপারগুলো যেন নড়তে না পারে, সে কারণেই বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছিলো।

তিনি বলেন, রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া রেললাইনের পাশে মাটি থাকে।  মাটির ওপরে পাথর থাকে।  কিন্তু রেলসেতুর ওপর স্লিপারগুলোর নিচে কিছু থাকে না।  ফলে যেহেতু দীর্ঘদিনের পুরনো স্লিপার, তা ট্রেন চলাচলের সময় নড়তে থাকে। ফলে লোহার রড দিয়ে একটির সঙ্গে আরেকটি জোড়া দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু রাতে এই লোহার রডগুলো খুলে নিয়ে যায়। সে কারণে এটি বাঁশ দিয়ে করা হয়েছে।

মন্ত্রীর এই বাঁশ তত্ত্বের কী ব্যাখ্যা হতে পারে? মন্ত্রীপরিষদে কি এই তত্ত্ব আলোচিত হতে পারে না? রাতে লোহার রড খুলে নিয়ে গেছে এ দায়ও হয়তো চোরের, রেল বিভাগের নয়!

আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ নাসিম বললেন, বাজেট বাস্তবায়িত না হওয়ার অন্তরায় হচ্ছে, যে যত বড় আমলা, সে তত ফাইল আটকে রাখে। যে যত ফাইল আটকায় সে তত বড় আমলা।

এই আমলাতন্ত্র আমাদের জন্য একটা সমস্যা। অভিযোগ রয়েছে, আমলাদের মধ্যে কিছু আছেন, দীর্ঘদিন ধরে সরকারকে বিব্রত ও ব্যর্থ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন৷ একথা সত্য হলে তা কেন প্রতিরোধ করা হচ্ছে না? সচিবরা তবে কার পকেটে? তারা কি প্রধানমন্ত্রী তোষণে ব্যস্ত থেকে প্রধানমন্ত্রীকেই ডোবাচ্ছেন না?

প্রধানমন্ত্রী একা সবদিক কয়দিন সামলাবেন? মন্ত্রীদের কার্যক্রম ও বক্তব্য কেন মন্ত্রিপরিষদে আলোচিত হচ্ছে না? মন্ত্রিপরিষদের সচিবের কাছে মন্ত্রীর বক্তব্য নয় মন্ত্রিপরিষদের বক্তব্য শুনতে চায় মানুষ৷

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)