চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

প্রধানমন্ত্রীর কাছে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মানিক আলীর দাবি

নভেম্বরের মাঝামাঝি। ঢাকায় শীত না পড়লেও ঢাকার বাইরে শীতের উপস্থিতি নাকি বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে- ফোনে জানালেন কুলাউড়ার বদরুল ইসলাম। বদরুল ইসলাম আমার স্বজন, কাতার প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। দেশে এসেছেন। আছেন কুলাউড়ায়। তিনি আমন্ত্রণ জানালেন সেখানে যাওয়ার জন্য। আমারও কাজ আছে। যেতে রাজি হয়ে গেলাম। সহকর্মী আদিত্যকে বললাম, চলো ট্রেনে করে যাই। ট্রেন জার্নি আমার বরাবরই পছন্দের।

এক ভোরে রওনা হলাম। সঙ্গে আদিত্য শাহীন ও তানভীর আশিক। ট্রেন খুব জনপ্রিয় এক বাহন। আমার সহকর্মীদের কাছে শুনি, ট্রেনের টিকিট নাকি পাওয়া যায় না। ট্রেনে সবসময় উপচেপড়া ভিড়। তারপরও বছরের পর বছর ট্রেন লোকসান গুনে যাচ্ছে। যাই হোক, সুন্দর একটা সকাল। ট্রেনের জানালায় চোখ রাখতেই মনে গুনগুন করে উঠল গান ‘দেখি এক চাঁদমুখ খোলা জানালায়।’

ভোরে রওনা হয়েছি, তাই নাশতা করে আসা হয়নি। ভাবলাম ট্রেনের নাশতাই খাওয়া যাক। অবাক হয়ে দেখলাম, ট্রেনে এখনও সেই ঐতিহাসিক কাটলেট পাওয়া যায়। মনে পড়ে সেই শৈশব থেকে দেখে আসছি এই কাটলেটটাকে। এখনও সেই রকমই শক্ত এবং তেলতেলে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়লেও কোনো এক অদ্ভুত কারণে বাড়েনি এর মান। যাত্রাপথে নানারকম লোকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। মানুষের সঙ্গে কথা বলাই আমার কাজ। কথা বলে জানতে পারি, কৃষির সঙ্গে সে মানুষটার সম্পর্ক কেমন, কৃষি নিয়ে সে কী ভাবছে। হোক সে সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী কিংবা বাদাম বিক্রেতা।

প্রায় ছয় ঘণ্টার জার্নি। পত্রিকা পড়ে, সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে সময় কেটে যাচ্ছিল। ট্রেনের জানালার দৃশ্যগুলোও পাল্টে যাচ্ছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। এর মাঝে এক তরুণ একজনকে নিয়ে ঢুকলেন আমার কামরায়। বললেন, ‘আমার বাবা। মুক্তিযোদ্ধা। আপনি এ ট্রেনে আছেন শুনে আপনাকে দেখতে এলেন।’ আমি উঠে গিয়ে আমার পাশে এনে তাঁকে বসালাম। আমাকে দেখতে এসেছেন, কিন্তু চোখের কালো চশমা বলে দিচ্ছে তিনি চোখে দেখেন না।

মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মানিক আলী। যুদ্ধ করেছেন ৪ নম্বর সেক্টরে। তিনি জানালেন, যুদ্ধে তিনি চোখ হারিয়েছেন। হারিয়েছেন বাম হাতটিও। প্রশ্ন করলাম, আপনি তো স্বাধীন দেশটাকে দেখতে পাননি! দেখতে ইচ্ছে করে না? বললেন, ‘দেখি তো এই দেশটাকে। মনের চোখ দিয়ে দেখি। যেমন আপনাকে দেখছি।’ জানতে চাইলাম, ‘আপনি তো আমার কাজগুলো দেখতে পাননি, আমার অনুষ্ঠানগুলো দেখেননি! তবে আমাকে জানলেন কীভাবে?’ তিনি বললেন, ‘আপনার কথা শুনেছি। আপনি কৃষকদের জন্য টিভি অনুষ্ঠান বানান। স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন।’

চোখ ও বাম হাত হারানো মুক্তিযোদ্ধা মানিক আলী

দীর্ঘক্ষণ কথা হলো তাঁর সঙ্গে। শুনলাম তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার গল্প, যুদ্ধের গল্প। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। পরীক্ষা না দিয়ে চলে গেলেন ভারতে। স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে চলে এলেন যুদ্ধের মাঠে। জুনিয়র লিডার উইং কমান্ডার এই যোদ্ধা কাজ করতেন মাইন বসানোর। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। চারপাশে আমাদের বিজয়ের কেতন উড়ছে। চূড়ান্ত বিজয়ের। ঠিক সে সময় ৭ ডিসেম্বর সিলেটে এক অপারেশনে মাইন বসাতে গিয়ে বিস্ফোরণের মুখোমুখি হলেন মানিক আলী। হারালেন চোখ ও বাম হাত।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে হাঙ্গেরি পাঠিয়েছিলেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। চোখের দৃষ্টি ফিরে পাননি। বাম কব্জিতে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম হাত। শরীরে এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন অসংখ্য স্প্লিন্টার। হাঙ্গেরি সরকার তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল টেলিফোন অপারেটিং বিষয়ে। শুধু প্রশিক্ষণ নয়, হাঙ্গেরির সরকার সেখানে তার চাকরির ব্যবস্থাও করেছিল।

মানিক আলী জানান, ‘বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার দেশের ছেলে, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে। সে নিজের দেশে থাকবে। দেশ তাকে চাকরি দেবে, বাড়ি দেবে। তার দায়িত্ব নেবে।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখেছিলেন। চাকরি দিয়েছিলেন টেলিফোন অপারেটর হিসেবে। মোহাম্মদপুরে একটা বাড়িও দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে এদেশের প্রেক্ষাপট বদলে যায়। বদলে যায় মানিক আলীর পাওয়া-না পাওয়ার হিসাবও। ছাড়তে বাধ্য হন মোহাম্মদপুরের বাসাটি। এরপর অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর মিলল পল্টনের একটি বাসা। সেখানেই আছেন এখনও।

তবে আফসোস নিয়ে বললেন মানিক আলী, ‘বাসাটির বরাদ্দ এখনও বুঝে পাইনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিঠি পর্যন্ত দিয়েছেন। তারপরও মেলেনি বরাদ্দের কাগজপত্র।’

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খুব গর্বিত মানিক আলী। আমাদের জন্যও তিনি চিরগৌরবের। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে মুক্তিযোদ্ধা মানিক আলীর একটাই দাবি, তিনি যেন তার জন্য বরাদ্দকৃত বাড়িটির কাগজপত্র বুঝে পান। তার প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে চান নিস্কণ্টক আবাস, মাথা গোঁজার ঠাঁই।

মানিক আলী বাংলাদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে লড়েছেন যুদ্ধের ময়দানে। স্বাধীনতার জন্য চরম মূল্যও দিতে হয়েছে তাকে। প্রশ্ন করেছিলাম, এই যে এত ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পেলেন, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাতে কি আপনি সন্তুষ্ট? বললেন, ‘দেশের মানুষ আগের চেয়ে ভালো আছে। এটা শুনে তৃপ্তি পাই। দেশের সব মানুষ যখন ভালো থাকবে, তখনই প্রকৃত স্বাধীন হবে দেশ।’

মানিক আলীর চার ছেলে, পাঁচ মেয়ে। ছেলেমেয়েদের সবাইকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তাদের অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত। এখন তাদের চোখেই দেখছেন ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মাথার ওপর একটি ছাদ তিনি রেখে যেতে চান। কথায় কথায় অনেক বেলা গড়িয়েছে। স্টেশনের পর চলে গেছে অনেক স্টেশন। তিনি গন্তব্যে চলে এলে বিদায় নেন। আমি চোখ রাখি ট্রেনের জানালায়। চা-বাগানের ওপর প্রথম দুপুরের রোদ ঝলমল করে ওঠে।

স্বাধীন বাংলাদেশের এই সৌন্দর্য মানিক আলী দেখতে পারেননি। আমাদের দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। মানিক আলীর প্রতি বিনয়ে মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। এমন অনেক মানিক আলীর ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে, এ আমার বিশ্বাস। এই বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বৈষম্যহীন সবুজ শ্যামল সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)