চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

প্রতি বছরই বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ থাকে: মোশাররফ হোসেন

মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব পদে নিয়োগ পান এই বছরের ৩ জানুয়ারি। দুই বছরের চুক্তিতে তাকে এই নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ছিলেন। এনবিআর এ মো. নজিবুর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন মোশাররফ হোসেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর নরসিংদীর সন্তান মোশাররফ ১৯৮১ সালের বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি ২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সেতু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব পদে নিয়োগ পান। একই বছরের ২৯ জুলাই পদোন্নতি পেয়ে সচিব হন তিনি।

এ দায়িত্ব পালনকালে পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিতে কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনকে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় মোশাররফ হোসেনসহ সাত জনকে আসামি করে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। মামলার পর মোশাররফ হোসেনকে ওএসডি বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়।

ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট থেকে বের হওয়ার পর গণপূর্ত ভবনের সামনে থেকে মোশাররফকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে কয়েক দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করে পরে কারাগারে পাঠানো হয়। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামিন পান মোশাররফ হোসেন।

তদন্তের পর দুদক জানায়, আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দুদক চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর ২০১৪ সালের অক্টোবরে পদ্মাসেতু দুর্নীতি মামলার অবসান ঘটে। সচিব মোশাররফ হোসেনসহ সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতি দেয় আদালত। পরবর্তীতে কানাডার আদালতে দায়ের করা মামলাতেও খালাস পান আসামিরা।

এরপর ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর শিল্প সচিব পদে নিয়োগ পেয়ে মোশাররফ ২০১৬ সালের ১১ এপ্রিল জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। ওই বছরের ৩০ জুন অবসরোত্তর ছুটিতে পিআরএল এ যাওয়ার কথা ছিল মোশাররফের। তবে একদিন আগে ২৯ জুন পিআরএল বাতিল করে তাকে এক বছরের চুক্তিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব পদে রেখে দেয় সরকার।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে জেল খাটা মোশাররফ হোসেনকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তার কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। সম্প্রতি বর্তমান সরকারের প্রস্তাবিত চলমান বাজেটের নানা প্রসঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে কথা বলেন মোশাররফ হোসন ভুঁইয়া।

প্রশ্ন: অপ্রদর্শিত অর্থ নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা দিয়ে কয়েকটি খাতে বিনিয়োগ করলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না? এই বিষয়ে মানুষের আগ্রহ আছে। আরেকটি বিষয়-২০১২ সালের সংশোধিত ভ্যাট আইনটি কার্যকর হচ্ছে ১ জুলাই থেকে। সব মিলিয়ে এবারের বাজেট কেমন হলো?
মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া: প্রধানমন্ত্রী একটি যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন যে, বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি ৫০ মিনিটেরও বেশি সময় বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। তার বক্তব্যে যাবতীয় বিষয় উঠে এসেছে। বরাদ্দ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে কোন কোন খাতে কতো ভ্যাট, আয়কর, ডিউটি ইত্যাদি আদায় করবো এবং একই সাথে কী কী প্রণোদনা দিচ্ছি আমরা ব্যবসায়ীদেরকে তার সব তিনি বলে দিয়েছেন। অপ্রদর্শিত আয়কে কালো টাকা বলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে নানা কারণে কিছু কিছু টাকা মানুষের হাতে এসে যায়। যেমন, মনে করেন- কেউ যদি একটা জমি গুলশান বা অন্য জায়গায় বিক্রি করে সে যে টাকায় রেজিস্ট্রেশন করে এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা তার হাতে এসে যায়। শুধু এটা না।

আবার কখনো কখনো অনেক সময় দেখা যায় কারো কোন ভুলে টাকা এসে যায়। মনে করেন বিদেশ থেকে কেউ টাকা পাঠালো কিন্তু সেই টাকা সে যথাসময়ে রিপোর্ট করলো না, বিভিন্নভাবে খরচ করলো অথবা সে তার ইনকাম ট্যাক্স ফাইলে দেয়নি। সেসব কারণে যে টাকা তার হাতে এসে যায় এটি যদি সে সঠিকভাবে তার কাজে ব্যবহার করতে না পারে, বিনিয়োগ করতে না পারে তাই প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন যে, আজকাল বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। তাই আমরা এবার বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় সঠিকভাবে ব্যয় করার জন্যে কিছু কিছু খাতের কথা বলে দিয়েছি। এটি আগেও ছিল। সব বছর বাজেটেই অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ থাকে। জরিমানা দিয়ে বৈধ করার সুযোগ থাকে। আমরা জরিমানা ব্যতিত এবার যদি হাইটেক পার্ক এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল এইগুলোতে বিনিয়োগ করে তাহলে শতকরা ১০ শতাংশ হারে ট্যাক্স দিয়ে বিনিয়োগ করতে পারবেন। এটি একটি বিরাট প্রণোদনা আমরা দিলাম।বিনিয়োগকে এটি উৎসাহিত করবে। কেউ যদি সরাসরি বিনিয়োগ করতে চান সেটাও করতে পারবেন অথবা কেউ যদি দেশি এবং বিদেশী কোন বিনিয়োগকারীর সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার করে যেতে চান তাও পারবেন।

প্রশ্ন: অপ্রদর্শিত অর্থ আর অন্যায়ভাবে অর্জিত অর্থ অর্থাৎ ঘুষ, দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ- এই দুটিকে যদি আলাদা করা যায় কোনভাবে তাহলে নৈতিকতার মানদণ্ড এবং রেগুলার যারা ট্যাক্স দেন তাদের জন্যে স্বস্তির জায়গা থাকে?

মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া: যারা ঘুষ বা অবৈধভাবে আয় করেন তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন বা বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ইনকাম ট্যাক্স তৎপর আছেন। যাদের ট্যাক্স ফাইল নাই এবং যারা এই পর্যন্ত কিছুই হয় নাই কিন্তু সে যদি হঠাৎ করে কোটি কোটি টাকা এনে বিনিয়োগ করা শুরু করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আমাদের অ্যাকশন তো থাকবেই। সেই বিষয় বাদ দিয়ে আমরা যদি বিনিয়োগের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে এবারের বাজেটে যে সুযোগ আমরা দিয়েছি এর সুফল আসবে বলে আমরা মনে করি।

তাছাড়া রিয়েল এষ্টেট সেক্টরে একটা মন্দাভাব এতোদিন ছিল। আমরা এখানে কিছুটা সুষমকরণ করেছি যে, নির্ধারিত পরিমাণ ট্যাক্স দিয়ে প্রতিবর্গ ফুট হিসাব করে আমরা সেটা ধরেছি। সেই অনুযায়ী যদি তারা ট্যাক্স দিয়ে রিয়েল এষ্টেট সেক্টরে বিনিয়োগ করলে এই সেক্টর আরও চাঙ্গা হবে। এই সেক্টরকে আরও চাঙ্গা করতে আমরা আরও করতে যাচ্ছি তা হলো- রেজিষ্ট্রেশনের খরচ কমিয়ে দিয়েছি। এখন মূল্যের শতকরা ১৪-১৫ শতাংশের মতো লেগে যায় রেজিস্ট্রেশনে। এই খরচ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

প্রশ্ন: ভ্যাট আইন নিয়ে আপনি অবশ্যই বলবেন। বলা হচ্ছে যে, এই বাজেটে ধনীরা অনেক লাভবান হবেন? ইনকাম ট্যাক্সে সারচার্জ সোয়া দুই কোটি থেকে তিন কোটি করাকে ওয়েস্টেজ বলছেন অনেকে?
মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া: ধনীদের কথা বলা হচ্ছে এই জন্য যে, আমরা আমদানি শুল্ক বিভিন্ন জায়গায় কমিয়েছি। কমিয়েছি কোথায়? প্রডাকশন সেক্টরে যেসব ম্যাটেরিয়ালস কাজে লাগে বিশেষ করে র’ ম্যাটেরিয়ালস হিসেবে কাজে লাগে সেইগুলো কমিয়েছি এবং তার কারণে যদি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়- বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। দেশের ইকনোমিক অ্যাক্টিভিটিজ বাড়বে তখন কিন্তু গরীব মানুষ কাজ পাবে।

আপনি দেখেন- আমাদের দেশে এখন কেন দারিদ্রতা কমছে? কেন মঙ্গা নাই? সেটা হলো এই জন্যে যে, দেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে। দেশে যতো ইকনোমিক অ্যাক্টিভিটিজ বাড়বে ততো গরীব মানুষের সুবিধা হবে।কাজেই আমরা যে বড় লোককে আরও বড়লোক করছি তা নয়। আমরা ইনকাম ট্যাক্সে সারচার্জ দুই কোটি পঁচিশ লাখ থেকে তিন কোটি করেছি- তা হলো, যারা ইনকাম ট্যাক্স দেয় এই জায়গায় সারচার্জ যে খুব বেশি আসবে তা কিন্তু নয়। মূল যারা ধনী- দুই কোটি পঁচিশ লক্ষ বা তিন কোটি টাকা যারা ইনকাম ট্যাক্স যারা ৪/৫ বছর দেয় তাদেরই অ্যাসেট হতে পারে। কিন্তু মূল যারা ধনী তারা কিন্তু এর অনেক বড় এবং তাদের কাছ থেকে এবার নতুন একটা জিনিস আমরা বলেছি তা হলো, হাই ইনকাম ইনডিভিউজ্যুয়ালস- যাদের ৫০ কোটি টাকার অ্যাসেট আছে। তাদের কাছ থেকে এখন আমরা শূন্য দশমিক হারে কর ধার্য করেছি। কাজেই তারা আগে যে কর দিতো সারচার্জ এখন ৫-৬ লক্ষ টাকা বেশি দিবে। এই জিনিসটা এখনো কেউ বুঝতে পারেনি। পরবর্তী পর্যায়ে সেটা আসবে।

প্রশ্ন: ভ্যাট আইন নিয়ে কিছু বলবেন?
মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া: ভ্যাট আইনে আপনারা জানেন যে, দুই বছরের জন্যে একটা অব্যাহতি ব্যবসায়ীরা পেয়েছিলেন। তার মানে এই না যে, ভ্যাট ছিল না। ভ্যাট তো ছিলই। ১৯৯১ সালের আইন বলবৎ ছিল। এখন আমরা যে ২০১২ সালের আইনটি সরকার যেটা পাশ করেছে তাতে ব্যবসায়ীদের সুযোগ সুবিধার দিক দিয়ে অনেক বেশি কিছু ছিল। আর আরেকটি বিষয় এখানে আছে তা হলো- অনলাইন এবং ডিজিটালাইজড। সেটা হওয়ার ফলে যা হবে তা হলো- চাপ বেশি পড়বে না। মানুষের উপরে চাপ বেশি পড়বে না। ব্যবসায়ীদের উপরেও চাপ বেশি পড়বে না। আদায়টা ঠিকমতো হবে। সেই জন্যে এটি করা হয়েছে এবং এই বছর আমরা কয়েকটা স্ল্যাব রেখেছি। পাঁচ, দশ, পনের, সাড়ে সাত- এটা হলো সাধারণ। আর দুই থেকে শুরু করে এই পাঁচের ভেতরে কয়েকটা স্ল্যাব আছে। আমরা সহনীয় করার জন্যে এটিকে প্রথম দিকে যা ছিল, ভ্যাট টার্ন ওভার অব্যাহতি প্রথমে যেটা ৩০ লক্ষ টাকা আগে ছিল তা ৫০ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। এরপরে টার্ন ওভার কর যেটা ছিল সেটাকে আমরা ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত করেছি। তিন কোটি টাকা পর্যন্ত যাদের বার্ষিক টার্ন ওভার তারা ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট দিলেই হবে। আর এর পরে স্থানীয় ব্যবসায় পর্যায়ে সাধারণভাবে যারা ব্যবসা করেন তাদেরকে একেবারে নিম্ন ধাপে রেখেছি। 

প্রশ্ন: অর্থমন্ত্রী বারবার বলেছেন, এই আইনটি কার্যকর হলে মানুষের কমোডিটি অ্যাসেনসিয়াল এর উপরে কোন অভিঘাত আসেব না। এই বিষয়ে সংক্ষেপে জানতে চাই।
মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া: আমরা চিনি আমদানিরর উপরে কিছু শুল্ক বসিয়েছি। হিসাব করে দেখেছি- পাঁচ টাকা চিনির দাম বাড়বে। চিনির দাম পাঁচ টাকা বাড়লে কিছু হবে না। কারণ এখন ৪৫ টাকা দরে চিনি বিক্রি হয় এবং বাজারে খুচরা মূল্য ৫০ টাকা। এই ৫০ টাকা চিনি বিক্রি থেকে তা যদি ৫৫ টাকা হয় তাহলে কিছু আসবে যাবে না। কারণ হলো সবজি বিক্রি হয় ৭০-৮০ টাকা করে।

প্রশ্ন: সংক্ষেপে আরও কিছু বলবেন?
মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া: আমরা যে ভ্যাট আইনটি বাস্তবায়ন করছি এবং অন্যান্য যে কাস্টমস ডিউটি এবং ইনকাম ট্যাক্স যা করা হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষকে কোন কিছু অ্যাফেক্ট করবে না। সুষম এবং জনকল্যানমুখী বাজেট এবারে হয়েছে। দু্ই একটা জিনিসের মূল্য যদিও বাড়ে আমি বলছি- শুধু চিনি এবং দুই টাকা সয়াবিন তেলের দাম বাড়তে পারে। আর কোন কিছুর দাম বাড়বে না। কারণ ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স সয়াবিন তেলের বিক্রির পর্যায়ে ছিল না। এখন মাত্র ২-৩ পারসেন্ট ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স এতে আরোপ করা হয়েছে।