চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

প্রতিবাদেরও ভাষা থাকে!

ভাষা আর ভাষাহীন হতে পারে প্রতিবাদ। ভাষাহীন যে প্রতিবাদ তাকে মৌন প্রতিবাদ বলা হয়ে থাকে, তবে এই মৌন প্রতিবাদের মধ্যেও প্রতিবাদী ভাষা থাকে, বিমূর্ত।

বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া অর্থে এই মৌন প্রতিবাদের ভার সরব প্রতিবাদের চাইতে কোন অংশেই কম নয়। তবে সকল প্রতিবাদই আদতে একেক ধরনের প্রতিবাদ; সরব-নীরব যাই হোক না কেন! ভাষাহীন প্রতিবাদের মধ্যেও তাই থাকে এক প্রতিবাদের ভাষা, যে ধাক্কায় ভেঙে যায়-যেতেও পারে সকল অচলায়তন।

প্রসঙ্গের অবতারণা নীরব প্রতিবাদের কথা বলতে নয়, ভাষাযুক্ত প্রতিবাদের। তবে সেটা সুস্থ-স্থির চিন্তার। যার প্রকাশ মূলত লেখ্য শব্দ-বাক্য আর শ্রুত, কণ্ঠে। অবশ্য কণ্ঠে উচ্চারিত বেশিরভাগ প্রতিবাদে বক্তার বক্তব্যের প্রতিধ্বনি তার কানে পৌঁছার কারণে অর্থের চাইতে শব্দের ব্যাপকতা তার কাছে অনেক সময় বেশি।

এরপর আসে দর্শক-শ্রোতার কাছে। প্রতিবাদী কণ্ঠ অনেক সময় মাঠ গরম করার মত, উপস্থিতিকে আলোড়িত করার মত; বিশেষত তা যদি হয় খোলা মাঠে কিংবা ছাদহীন পরিবেশে তখন আরও বেশি শব্দের, ব্যঞ্জনার।

ভাষা কিংবা ভাষাহীন প্রতিবাদের এই পন্থাগুলো আদতে ব্যক্তি ও বিভিন্ন মাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব করে। ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যকার পার্থক্য বিস্তর হলেও ব্যক্তিচরিত্রের প্রকাশ অনেক সময় সংগঠনের নামেই প্রকাশিত হয়ে যায়। এখানে ব্যক্তির দুর্বলতা, চিন্তার দীনতা, সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতার প্রকাশ হয় যেমন তেমনিভাবে প্রকাশ হয় ঔদার্য, পরিপক্কতা ও ইতিবাচক মানসিকতার। অনেক সময় ব্যক্তির সমস্যায় সমষ্টিকে দায় নিতে হয়।

সংগঠনও হয়ে পড়ে বিতর্কিত। এখানে নেতৃত্বের গুণাবলী সামনে চলে আসে। নেতার যোগ্যতায় সংগঠন লাভবান হয়, আবার অযোগ্যতায় হয় ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে দেখা যায় কেবল নেতৃত্বের কারণেই কোন সংগঠনের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুণ্ণ হয় তেমনিভাবে হয় উজ্জ্বলও।

সাম্প্রতিক সময়ের ঘটে যাওয়া অভিনেত্রী ও ব্যবসায়ী শমী কায়সারের মোবাইল হারানোর পর ‘চোর’ সন্দেহে সাংবাদিকদের সঙ্গে অপমানজনক এক ঘটনায় প্রতিবাদ নিয়ে আলোচনা চলছে। অপমানের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপমান ফেরত দিতে চাইছেন অনেকে। তবে এই প্রতিবাদের পদ্ধতি কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, যা সমভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত।

গত ২৫ এপ্রিল ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) প্যাডে সংগঠনটির যুগ্ম সম্পাদক আকতার হোসেন সাক্ষরিত ‘সাংবাদিকদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা চান’ শিরোনামের এক বিজ্ঞপ্তিতে শমী কায়সারকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

এতে বলা হয়- ‘বিএফইউজে সভাপতি মোল্লা জালাল, মহাসচিব শাবান মাহমুদ, ডিইউজে সভাপতি আবু জাফর সূর্য ও সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, একজন শহীদ সাংবাদিকের মেয়ে হয়ে পিতার পেশার উত্তরসূরিদের ‘চোর’ বলে সম্বোধন করে শমী কায়সার প্রকারান্তরে তার পিতাকেই নিকৃষ্টভাবে অসম্মান করেছেন। শুধু তাই নয়, একজন সেলিব্রিটি হিসেবে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘মোবাইল ফোন হারানোর’ সূত্র ধরে যে আচরণ করেছেন তা সেলিব্রিটিদের প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তার মতো একজন অভিনেত্রী ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দনীয়’।

ওই বিবৃতিতে বিএফইউজে ও ডিইউজে নেতারা এ ধরনের নিকৃষ্টতম দুর্ব্যবহারের জন্য সাংবাদিক সমাজের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘নতুবা যত বড় সেলিব্রিটিই হোন না কেন তার সংবাদ বর্জন করা হবে। প্রয়োজন হলে তার সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়ে সাংবাদিক সমাজ নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করে জাতিকে বিস্তারিত জানাতে বাধ্য হবে।’

প্রতিবাদ ও ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানের কারণ- গত ২৪ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে ই-কমার্সভিত্তিক পর্যটন বিষয়ক সাইট ‘বিন্দু৩৬৫’র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি ও এফবিসিসিআইর পরিচালক শমী কায়সারের দুটি মোবাইল ফোন খোয়া যায়।

ঘটনা অবহিতির একপর্যায়ে শমী কায়সারের নিরাপত্তাকর্মীরা মিলনায়তনের মূল গেট বন্ধ করে দেন। শমী কায়সার উপস্থিত সবার দেহ তল্লাশি করার কথা বললে সাংবাদিকরা তাতে সম্মতি দেন। দেহ তল্লাশি শেষে সাংবাদিকরা বের হতে চাইলে তার নিরাপত্তাকর্মীরা সাংবাদিকদের ‘চোর’ বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। এতে সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ হন। এরপর সাংবাদিকরা ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চোর শনাক্ত করার উদ্যোগ নিলে দেখা যায়, অনুষ্ঠানের লাইটিংয়ের দায়িত্ব পালনকারী এক কর্মী মোবাইল দুটি নিয়ে বের হয়ে যান। ওই দৃশ্য দেখার পর সাংবাদিকদের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করেন শমী কায়সার।

শমী কায়সারের মোবাইল ফোন হারিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের দেহ তল্লাশি চালানো হলেও ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত আরেক সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টির দেহ তল্লাশি চালানো হয়নি, তল্লাশি চালানো হয়নি অভিনেত্রী জয়া আহসান, বিন্দু৩৫৬’র পদস্থ কারওসহ অন্যান্য অতিথিদের। অর্থাৎ শুরু থেকেই তারা সন্দেহের ঊর্ধ্বে। এদের বাইরে বাকি যারা তারা মোবাইল চুরি করতে পারেন এই সন্দেহে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের মধ্যে থেকে ‘চোর খোঁজা’ হচ্ছিল! তবু এনিয়ে কারও আপত্তি ছিল না; তবে আপত্তির জায়গা ছিল তল্লাশির পর সাংবাদিকেরা চলে যেতে চাইলে শমী কায়সারের নিরাপত্তাকর্মী কর্তৃক ‘চোর’ সম্বোধন। এবং এই অভব্যতা রীতিমত সীমা লঙ্ঘন, এবং শিষ্টাচার বহির্ভূত। এইধরনের ন্যক্কারজনক আচরণ অপ্রত্যাশিতও।

শমী কায়সারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের প্রতি এমন সন্দেহ পোষণ এবং চোর আখ্যা দেওয়ার প্রতিবাদ হয়েছে, এবং এই প্রতিবাদ হয়ত আরও কিছুদিন চলবেও।

এই প্রতিবাদ একটা সময়ে থেমে গেলেও এইধরনের অশিষ্ট আচরণ সহজে যে সকলেই ভুলে যাবে তা না, এর রেশ থেকে যাবে। তবে এই প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ কেউ যেভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেছেন তাও শিষ্টাচারের সীমা অতিক্রম করে।

আমাদের অনেকেই অনেক সময় ভুলে যান যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আরেকটা অন্যায়ের পথ ধরাও অন্যায়। এটা ঠিক যে শমী কায়সার অন্যায় করেছেন, অশিষ্ট আচরণ করেছেন নিজে এবং তার নিরাপত্তাকর্মীরা। তার সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানো যায়, কিন্তু সেই প্রতিবাদ ও নিন্দা শিষ্টাচার বজায় রেখেই করা সম্ভব। প্রতিবাদ আক্রমণের ভাষা নয়, প্রতিবাদ ন্যায়-ন্যায়ের ভেদ নির্দেশক।

ব্যক্তি পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সুনিয়ন্ত্রিত মাধ্যম নয়, এখানে ব্যক্তিই সর্বেসর্বা। নিজেদের খেয়ালখুশিমত অনেক কিছুই অনেকে করে থাকেন। এখানে ব্যক্তির অবারিত স্বাধীনতা। এই অবারিত স্বাধীনতার ভুবন মানুষের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশের যে অন্যতম মাধ্যম সে বোধ অনেকের থাকে না।

স্বনির্ধারিত এবং সম্পাদনাবিহীন এই মাধ্যমে মানুষ যা কিছু করে থাকে সেটাই তার ‘ক্লাস’। ঘটনার পর থেকে প্রতিবাদের নামে কেউ কেউ শমী কায়সারের ব্যক্তিগত চরিত্রে কালি দিতে চেয়েছে। এগুলোও অনাকাঙ্ক্ষিত।

রাজনৈতিক পরিচয়ে শমী কায়সার আওয়ামী লীগার। একাদশ সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। তার এই পরিচয়ের কারণে শুরুতে ধারণা করছিলাম সাংবাদিকদের প্রতি এমন অভব্য আচরণের পর সাংবাদিক নেতারা এনিয়ে হয়ত কিছু বলবে না।

আমার ব্যক্তিগত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক নেতাদের পক্ষ থেকে বিবৃতি এসেছে। তবে দুঃখজনক ভাবে সেই বিবৃতি অসংলগ্ন শব্দ-বাক্য আর অপেশাদার ইঙ্গিত দিয়ে। বিএফইউজে এবং ডিইউজের বিবৃতিতে উল্লেখ ‘প্রয়োজন হলে তার সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়ে সাংবাদিক সমাজ নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করে জাতিকে বিস্তারিত জানাতে বাধ্য হবে’- বাক্য প্রচ্ছন্ন হুমকির, এবং অপ্রত্যাশিত। সাংবাদিক নেতাদের এমন শব্দ-বাক্য আর ইঙ্গিত ব্যক্তিগতভাবে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকির মতই মনে হয়, যা তাদের পেশাদারিত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক!

শমী কায়সার ভুল করেছেন, অশিষ্ট আচরণ করা হয়েছে তার পক্ষ থেকে; এজন্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান এবং প্রতিবাদ করাটা অন্যায় নয়।

এক্ষেত্রে প্রতিবাদের ভাষা যৌক্তিক এবং সুস্থ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তার এই ভুলের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমরা যদি তার মত কিংবা তারচেয়ে বেশি ভুল করি বা ভুল পদ্ধতি গ্রহণের হুমকি দিই তবে শমী কায়সার আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য থাকল কোথায়?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)