ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের আইনের আওতায় না আনায় দিন দিন ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংস্থাটি বলছে, এই বিপুল পরিমাণ ঋণ বর্তমান ব্যাংকিং খাতে অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা; যা গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে প্রতি বছর গড়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা করে। এই বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪১৭ শতাংশ, যদিও একই সময়ে মোট ঋণ বৃদ্ধির হার ৩১২ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ ঋণ বর্তমান ব্যাংকখাতে অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ।
টিআইবি বলছে, বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ হ্রাস এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলা হলেও তা কার্যকর করা হয়নি। বরং সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ ও পুনর্গঠনের সুযোগ দিয়ে আসছে। সর্বশেষ গত মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ ফেরত দিয়ে পুনঃতফসিলিকরণের মাধ্যমে ১০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিয়েছে।
টিআইবির ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বার বার পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় না করেই গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে গত মার্চ পর্যন্ত ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন সত্ত্বেও গত জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পুনরায় বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকায়।
টিআইবি বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের কারণে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেই ঘাটতি মেটাতে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার ১২ হাজার ৪৭২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়েছে।
এই বিপুল পরিমাণে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রধানত দুই ধরনের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ লক্ষ্য করা যায়। প্রথমতঃ বাহ্যিক প্রভাব; যার মধ্যে রয়েছে আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ব্যবসায়িক প্রভাব। দ্বিতীয়তঃ অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ; যার মধ্যে রয়েছে তদারকি সক্ষমতায় ঘাটতি, নেতৃত্বের সক্ষমতায় ঘাটতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় ঘাটতি এবং তদারকি কাজে সংঘটিত অনিয়ম দুর্নীতি।
এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যাংক খাতে কী সিদ্ধান্ত হবে বা আইনগত বা নীতিগত পরিবর্তন সেটি কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে না। এটি পাঁচতারা হোটেলে বসে বা যেখানেই হোক তাদের (ব্যাংক মালিকদের) সিদ্ধান্তেই হয়। পরবর্তীতে সেটিই নীতি হিসেবে পরিচালিত হয়।
ব্যাংকিং খাত সংস্কারে ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে ১০টি সুপারিশ করেছে টিআইবি। যেমন- ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এ খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন করতে হবে।
ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে।
যেখানে নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ৩ জন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির (খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ যেমন আর্থিক খাত ও সুশাসন বিষয়ক) সংখ্যা বাড়াতে হবে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আইনগুলোতে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সব ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে (যেমন- একই পরিবারের পরিচালক সংখ্যা ও পরিচালকের মেয়াদ কমানো, পর্ষদের মোট সদস্য সংখ্যা কমানো ইত্যাদি)।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল তৈরি এবং সেখান থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান করতে হবে। ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
আদালত স্থগিতাদেশ প্রাপ্ত খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার বিধান প্রণয়ন করতে হবে।
পুনঃতফসিল করে বারবার খেলাপি হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি, প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ, পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।
পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে।
তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।